২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মালদ্বীপ : মুসলিম গণতন্ত্রের উত্থান ও পতন

-

তিন দশকের একনায়কতন্ত্র থেকে বের হয়ে আসার পর গণতন্ত্রের পথে প্রায় ১০ বছর পার করেছে মালদ্বীপ। বিরোধীদল তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার পর ২০০৮ সালের অক্টোবরে দীর্ঘ দিন মালদ্বীপের মতায় থাকা প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম শান্তিপূর্ণভাবে সরে দাঁড়ান। একই সাথে প্রথমবারের মতো একাধিক দলের অংশগ্রহণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন।
১০ বছর ধরে দেশটিতে বহুদলের অংশগ্রহণে নিয়মিত নির্বাচন হয়ে আসছে। ২০০৮ সালের পর গতকাল মালদ্বীপের ভোটাররা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। মতাসীন আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন দীর্ঘ দিনের পার্লামেন্ট সদস্য ও বিরোধী দলগুলো সমর্থিত ইব্রাহিম মাহমুদ সলিহ।
যেকোনো নতুন গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন খুবই উৎসাহ উদ্দীপনার বিষয়। কিন্তু মালদ্বীপে ইদানীং যা হচ্ছে, তাতে এ নির্বাচন গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে ীণ যেটুকু আশা এখনো আছে তা হলো, দুর্বল নির্বাচনব্যবস্থা সত্ত্বেও নির্বাচন মালদ্বীপের পুরনো স্বৈরতান্ত্রিক চেহারা বদলে দিতে পারে।
সংপ্তি গণতান্ত্রিক মুহূর্ত
জেলখানায় কয়েদি হত্যার ঘটনায় ২০০৩ সালে রাজপথ গণমানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে উঠলে মালদ্বীপে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। মালদিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টিÑ এমডিপি নেতা মোহাম্মদ নাশিদের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর জোট জনরোষকে কাজে লাগিয়ে গাইয়ুমকে পদত্যাগ করতে এবং নিরপে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করে। জোটের সমর্থনে ২০০৮ সালে গাইয়ুমকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো মালদ্বীপের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন নাশিদ। এর দুই বছর পর আন্তর্জাতিক পর্যবেক প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রিডম হাউজ’ মালদ্বীপকে সে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘ইলেক্টোরাল ডেমোক্র্যাসি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ও স্বীকৃতি দেয়।
কিন্তু নব অর্জিত এই ‘স্টেটাস’ বা সুনামের নীতি দেশের মাটিতে চর্চা করা হয়নি। মালদ্বীপের রাজনৈতিক নেতারা মতালোভী মনোভাব ও অসৎ রাজনীতি পরিত্যাগ করেননি। নতুন রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের নেতারা, পার্লামেন্ট সদস্যরা, বিচারপতিরা এবং রাজনীতিতে যারা পয়সা খরচ করেন, তারাও গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।
পর্বতসমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে নাশিদ নিজেও সরকারি কর্মকর্তা এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে একনায়কতন্ত্রের দিকেই পা বাড়ান। অপরদিকে, গণতান্ত্রিকভাবে মতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া চালু করার পরিবর্তে এবং কোনো শর্ত না থাকার পরেও, বিরোধীপ যেকোনোভাবে নাশিদকে মতা থেকে হটাতে উঠেপড়ে লাগে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি অংশের বিদ্রোহ এবং বিরোধীদের দাবির পরিপ্রেেিত ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন নাশিদ।
এরপর ২০১৩ সালে গাইয়ুমের ‘প্রোগ্রেসিভ পার্টি অব মালদিভস’ বা পিপিএম তার সৎভাই ইয়ামিনকে নাশিদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। পিপিএম এ সময় জমহুরি পার্টি ও ইসলামপন্থী আদালত পার্টির সাথে জোট বাঁধে, যারা ২০০৮ সালে গাইয়ুমের বিরুদ্ধে নাশিদের এমডিপি দলকে সমর্থন দিয়েছিল। এ জোট ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হতে সহযোগিতা করে ইয়ামিনকে।
নতুন একনায়কের আবির্ভাব
মতা গ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়ামিন নিজেও গণতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেয়া শুরু করেন এবং একই সঙ্গে ‘গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও উন্নয়নে’র কথা বলে এসব প্রতিষ্ঠানকে তার নিজের ও দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধ্য করেন।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে আনা ইয়ামিনের অন্যতম ল্েয পরিণত হয়। মতা গ্রহণের পরই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি নিজ দলের পার্লামেন্ট সদস্যদের মাধ্যমে সংবিধানে পরিবর্তন আনেন। এই সংশোধনী ব্যবহার করেই তিনি সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে এবং নি¤œ আদালতের বিচারপতিদের পদ থেকে সরিয়ে দেন। এই দুটি আদালতই এর আগে স্বাধীন হিসেবে পরিচিত ছিল। এ পদপে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। একই বছর সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ, তার নিজের ভাই গাইয়ুম, তার নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ আদিব, আদালত পার্টির নেতা ইমরান আবদুল্লাহ, দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত গাসিম ইব্রাহিমসহ বিরোধী সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নানা অভিযোগে ইয়ামিন জেলে ঢোকান।
ইয়ামিনের একনায়কতান্ত্রিক হঠকারিতার কারণে জোটের সদস্যরাই তার বিরোধিতা করা শুরু করে। এতে প্রেসিডেন্ট তার সাংবিধানিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাল। এ সময় আদালত ও নির্বাচন কমিশনবিরোধী পরে ১২ জন পার্লামেন্ট সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করে দেয়।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে ঘটে গেছে নাটকীয় ঘটনা। সর্বোচ্চ আদালত বিরোধী দলের সব নেতাকে মুক্ত করে দিয়েছেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান বিচারপতি ও নি¤œ আদালতের বিচারককে আটক করে। এর এক মাস পরই পার্লামেন্ট আবারো আইনে পরিবর্তন আনে এবং দুই বিচারপতিকে সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে আবারো নি¤œ আদালতের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইয়ামিন সরকার। তার এ ধরনের একনায়কসুলভ মনোভাব থাকার পরও রাজনৈতিক ও নাগরিক আন্দোলনের সুযোগ কিছুটা অবশিষ্ট আছে। এখনো রাজনৈতিক দলগুলো কাজ করতে পারছে। গণমাধ্যমের অস্তিত্ব আছে এবং যেকোনো সময় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। এখনো মতপ্রকাশের কিছু স্বাধীনতা অবশিষ্ট আছে, বিশেষ করে ইন্টারনেটে এবং আজও মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা কাজ করে।
অবশ্য, চিরদিনের মতো বদলে ফেলা আইন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ফলে এতটুকু স্বাধীনতাও ইয়ামিন যেকোনো সময় কেড়ে নিতে পারেন। এ ধরনের শাসনব্যবস্থাকে অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক জন কেন নাম দিয়েছেন ‘নতুন স্বৈরতন্ত্র’।
এর মাধ্যমে সেই সরকারকেই বোঝানো হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক আকাক্সা ও নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয় এবং অর্থনৈতিক স্বজনপ্রীতি, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগের মতাহরণ, মানুষের ওপর নজরদারি আর বিরোধীদের ওপর দমনপীড়নের মাধ্যমে শাসন মতার বিস্তার ঘটায়।’
গণতন্ত্রের জন্য সুখবর নেই
এমন একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও মালদ্বীপ্রবাসী গতকাল নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। এরই মধ্যে নির্বাচনী কারচুপির কিছু লক্ষণ প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় দায়ের করা মামলায় সাজা খাটার কারণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে।
স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও স্বাধীন বিচার বিভাগ নিয়েও সংশয় আছে। এর আগেও, বেশ কয়েক দফা নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে এবং ২০১৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল।
গতকালের নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপে হলেও তা হবে দুটি বাজে বিকল্পের মধ্য থেকে একটি বেছে নেয়ার মতো। একটি হচ্ছে গভীরতর একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ইয়ামিন। অন্যটি হলো সলিহ এবং একটি সম্ভাব্য অস্থিতিশীল সরকার, যারা দলাদলিতে ব্যস্ত থাকবে।
নাশিদের এমডিপি দল, জমহুরি পার্টি ও ইসলামপন্থী আদালাত পার্টি (যারা ২০১২ সালে নাশিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল) কর্তৃক সমর্থিত প্রার্থী সলিহ। তার সাথে আরো আছে পিপিএম থেকে বহিষ্কার করা সাবেক বিরোধী নেতা গাইয়ুম।
এই জোট বর্তমানে অভিন্ন শত্রু ইয়ামিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই জোট নির্বাচনে জিতলে ও সলিহ মতায় এলেও এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না যে, পরবর্তী সময়ে তারা একজোটভুক্ত হয়েই থাকবেন। বরং সাম্প্রতিক ঘটনা প্রমাণ করে, নিজেদের ন্যূনতম স্বার্থ হুমকির মুখে পড়লেই তারা আলাদা হয়ে যেতে পারেন। সলিহ যদি তার পূর্বসূরিদের মতো না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন, রাজনৈতিক মতবিরোধ দূর করতে উদ্যোগী হন, তখনো তাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। স্বার্থপর রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ব্যাপক দুর্নীতির প্রভাবে গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির পরিপালনে যেকোনো প্রতিশ্রুতি থেকে যেকোনো সময় হয়তো তিনি বের হয়ে আসতে পারেন। অন্যভাবে বললে, নির্বাচনে ইয়ামিন বা বিরোধী দল যেই বিজয়ী হোক না কেন, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় মালদ্বীপ এগিয়ে যাওয়ার আশা খুবই কম।হ

লেখক : ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট অস্ট্রেলিয়ার পিএইচডি গবেষক
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম


আরো সংবাদ



premium cement