২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বৈচিত্র্যময় জীবনের কৃতী পুরুষ

-

বেশ কয়েক বছর হলো, বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। চলে গেছেন বহু দূরে অজানা অচেনা এবং না ফেরার দেশে। পেছনে ফেলে গেছেন বন্ধু, সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের, ফেলে গেছেন অগণিত শুভানুধ্যায়ী, সুহৃদ, গুণগ্রাহী ও গুণসমৃদ্ধদের। তাহের কুদ্দুসের ছিল বর্ণাঢ্য কর্মময় বিস্তৃত জীবন। এ সৎ ও দেশপ্রেমিকের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের বলিয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত ‘সাহেব বাড়ি’তে। তার পিতা মরহুম আবদুল কাদের ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি পারিবারিক ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে দুঃসাহসিকতাপূর্ণ ভিন্ন জীবন বেছে নিয়েছিলেন।
পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারুণ্যোজ্জ্বল তাহের কুদ্দুস ১৯৫৬ সালে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন রিসালপুরস্থ পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমিতে। ১৯৫৭ সালে প্রশিক্ষণ শেষে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। চাকরি জীবনে তাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে, হতে হয়েছে অনেক চ্যালেজ্ঞের মুখোমুখিও।
গভীর আত্মপ্রত্যয়ী, দেশপ্রেমিক ও সাহসী তাহের কুদ্দুস সামনে এগিয়ে গেছেন, কখনো থেমে থাকেননি কিংবা পিছে তাকাননি। মেধা, শ্রম ও দৃঢ় মনোবলকে সম্বল করে তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। তাই অর্জন ধরা দিয়েছে তার কাছে, সাফল্য তার পা ছুঁয়েছে।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস এক সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেন ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে অংশ নিয়ে স্কোয়াড্রন লিডার এম কে বাশার বীর উত্তম (সাবেক এয়ার ভাইস মার্শাল ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান) এবং ফাইট লেফটেন্যান্ট তাহের কুদ্দুস সে যুদ্ধে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে অন্তত পাঁচবার বোমারু বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার জন্য তিনি ‘সনদে ইমতিয়াজ’ লাভ করেন। পাইলট অফিসার থাকাকালে গিলগিটে স্কাইপ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। পাকিস্তানের বিখ্যাত ডন পত্রিকায় বাঙালি এই অফিসারের কৃতিত্ব ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল।
স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে তাহের কুদ্দুস ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৭৭ সালে জাপানি রেড আর্মি কর্তৃক জাপানি এয়ার লাইনসের ছিনতাইকৃত বিমানের যাত্রীদের প্রাণরক্ষায় ছিনতাইকারীদের সাথে আলোচনায় অসীম সাহসিকতার পরিচয় রাখেন তিনি। যাত্রীদের মুক্তিপণ হিসেবে ছিনতাইকারীদের দাবি ছয় মিলিয়ন ডলার তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে ছয় বারে তা পরিশোধ করে সব যাত্রীকে মুক্ত করে অসামান্য কূটনৈতিক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ওই বিমান ছিনতাই ঘটনার সময়ে বিমানবাহিনীর কিছু সদস্যের বিদ্রোহের কবলে পড়েন এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ (সাবেক বিমান বাহিনীর প্রধান) এবং তদানীন্তন উং কমান্ডার তাহের কুদ্দুস। উভয়কে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে একটি গোপন কক্ষে বিদ্রোহী সেনারা আটকে রাখে। ওই সময় যে বিমানসেনা তাদের জীবন রক্ষা করেছিলেন, তাহের কুদ্দুসের সৎ ও নির্মোহ জবানবন্দির বদৌলতে সে বিচারে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পায় ওই কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য।
এ ঘটনার পর তাহের কুদ্দুস গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামের বিমানবাহিনীর ঘাঁটির অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ পিয়েছিলেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ তাকে নতুন জগতের জন্য প্রস্তুত করেছিল। তিনি ১৯৭৭ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। প্রবেশ করেন নতুন এক সংগ্রামী জীবনে। যোগদান করেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অচিরেই মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনপ্রিয় শিশুপার্ক নির্মাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কর্মমুখর অকান্ত পরিশ্রমী এক ব্যক্তিত্বের নাম গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প অনেকটা এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তিনি মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত পর্যটন শিল্পবিষয়ক সম্মেলনে আঞ্চলিক সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এত কিছুর পরও গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস খুঁজতে থাকেন সৃষ্টিশীল নতুন কর্মক্ষেত্র। আল্লাহ তায়ালা তার জন্য নতুন কর্মক্ষেত্রের সুযোগ প্রদান করেন। Securex নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করে দেশে যেন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। মেধা, সততা ও অকান্ত পরিশ্রমের ফলে তিনি সাফল্যের মুখ দেখতে সক্ষম হন। সময়কে পেছনে রেখে Securex কে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলেন তিনি। পেশার প্রতি একনিষ্ঠতা, সততা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ তাহের কুদ্দুস চূড়ান্ত সাফল্য ও মর্যাদা লাভে সক্ষম হন। লাভ করেছেন হাজারো অনুরক্তের শ্রদ্ধা। কুদ্দুসের কথার মধ্যে ছিল প্রত্যয়, স্পষ্টতা, প্রাঞ্জলতা ও সততার পরিচয়। তার মুখে ‘জানি না’ কিংবা ‘পারব না’Ñ এসব শব্দ শোনা যেত না।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাহের কুদ্দুস ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত কলাম লিখতেন। সুপরিচিত সাপ্তাহিক Holiday পত্রিকায় Bottom Line নামে কলাম দুই দশকব্যাপী লিখে সুলেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। লেখনীর মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সুধীমহলে। অনেক অপ্রিয় সত্য অকপটে বলে গেছেন। পেশাগত কাজের বাইরে তার পরিচিতি ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, অমায়িক স্বভাবের। তার সংস্পর্শে এলে তাকে ভুলে থাকা কঠিন ছিল। দানশীলতা ছিল তার আরেকটি মহৎ গুণ। সমাজের কল্যাণমূলক কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন; তেমনি অন্যকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। নিজ এলাকা হাজীগঞ্জে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়েছেন এবং মায়ের নামে ‘সুফিয়া চ্যারিটেবল কিনিক’ প্রতিষ্ঠা করে এলাকার গরিব মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। অবহেলিত ও গরিব মানুষের জন্য তার ছিল দরদ।
প্রতি ঈদেই এলাকার দরিদ্রের মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করতেন। তিনি ছিলেন খুবই সংবেদনশীল। পরিবারের প্রত্যেকের মতামতকে খুবই গুরুত্ব দিতেন তিনি। বিনয় ও নম্রতা ছিল তার সবচেয়ে বড় গুণ। স্নেহময় পিতা হিসেবে সন্তানদের নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতেন বেশি।
তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার পাশাপাশি নিয়ম মেনে চলা সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। সর্বদা বিনয়ী হওয়ার শিক্ষাই দিতেন। ছোট বড় সবার সাথে সমানভাবে মেলামেশার শিক্ষাও সন্তানদের দিয়েছেন। তার কর্তব্যনিষ্ঠা, আদর্শিক দৃঢ়তা, মেধার স্ফুরণ এবং নিরলস সৃজনশীল কর্মস্পৃহা তাকে আলাদা করেছে, এটি তার কর্মের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায়।
স্বল্প কয়েক বছরের পরিচয় হলেও গভীরভাবে মুগ্ধ হই আমার প্রতি তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, আস্থা ও ভালোবাসার জন্য। এসব কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। মৃত্যুবার্ষিকীতে আন্তরিক শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করছি। দোয়া করছি পরম করুণাময় আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। হ
লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের প্রফেসর


আরো সংবাদ



premium cement