২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গায়েবি মামলার হিড়িক

চলতে ফিরতে দেখা
-

এর কাছাকাছি বিষয় নিয়ে গত সপ্তাহেও আমরা লিখেছিলাম। কিন্তু এক সপ্তাহের ব্যবধানে সে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে গায়েবি মামলার একেবারে হিড়িক পড়ে গেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সক্রিয় নেতাকর্মী কিংবা সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এই গায়েবি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। তা ছাড়া যারা সত্য প্রকাশ করতে চান, তারাও সরকারি রুদ্র রোষের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে এখন সত্য প্রকাশ ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় এক মাসে কতজন মারা গেল সে তথ্যও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। সে রকম তথ্য প্রকাশ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কারাগারে গিয়েছিলেন। তিনি এখন জামিনে মুক্ত। তার বিরুদ্ধে প্রথমে দেয়া হয়েছিল চাঁদাবাজির মামলা। সেটি ডাহা মিথ্যা ও বানোয়াট। সে কথা প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি কারাগারে থাকতে থাকতেই তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে বিস্ফোরক মামলা। চাঁদাবাজির মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন, বিস্ফোরক মামলার পরিণতি জানতে সময় লাগবে।
তবে নতুন করে দায়ের করা বিস্ফোরক আইনের মামলায় পুলিশ মোজাম্মেল হককে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করেছে। ওই মামলায় বলা হয়েছে, চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি মিরপুর ১৩ নম্বরে বিআরটিএ’র কার্যালয়ের পেছন থেকে ৩৫টি পেট্রলবোমাসহ আবিদুর আহসান নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনায় আবিদুরসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও ৪০ থেকে ৪৫ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারাসহ বিস্ফোরক উপাদানাবলি আইনের ৩/৬ ধারায় মামলা হয়। মামলায় বলা হয়, দুষ্কৃতকারীরা সবাই মিলে দেশে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি, সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ, সরকার ও জনসাধারণের সম্পত্তি ধ্বংস, ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে গাড়িতে পেট্রলবোমা মেরে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারাসহ বিস্ফোরক উপাদানাবলি আইনে অপরাধ করেছে। ওই মামলায় মোজাম্মেল হক চৌধুরীর নাম উল্লেখ ছিল না। তবে ৮ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানার এসআই রায়হানুর রহমান মোজাম্মেল হককে কাফরুল থানার বিস্ফোরক আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখানোর অনুমতিসহ ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান। এতে বলা হয়, আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, মোজাম্মেল হক এজাহারভুক্ত পলাতক আসামিদের সহায়তায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ঘটনা ঘটান।
এ ঘটনার সরেজমিন তদন্ত করে এক সহযোগী পত্রিকা। তারা বিআরটিএ কার্যালয়ের পেছনে স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের অন্তত ১০ জনের সাথে কথা বলেন। ফুটপাথের একজন চা-দোকানি ওই প্রতিবেদককে জানান, ৪ ফেব্রুয়ারি এই গলি থেকে পুলিশ ককটেলসহ কাউকে গ্রেফতার করার কথা শোনেননি কিংবা দেখেননি। দোকানে বসেছিলেন একজন রিকশাচালক। তিনি বলেন, এই এলাকায় থাকেন, কিন্তু এমন কথা শোনেননি। পাশে বিআরটিসির স্টাফ কোয়ার্টার মার্কেটের একটি স্টেশনারি দোকান মালিক বলেন, ‘এ ধরনের খবর জানি না কিংবা শুনিনি।’ আরেক বাসিন্দা জানান, ‘ককটেল বা পেট্রলবোমা উদ্ধার হলে আমরা শুনব না, তা হতে পারে না।’ আর চাঁদাবাজির মামলার বাদি দুলাল মিয়া, ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। সুতরাং মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা দু’টি মামলাই গায়েবি। মূল কথা হলো, ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় যে আড়াই শ’ লোকের মৃত্যু হয়, সে পরিসংখ্যান না প্রকাশ করার জন্য মোজাম্মেল হককে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল; কিন্তু তিনি সে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে দেন।
এ রকম ঘটনা এই একটিই নয়, ভূরি ভূরি। বিশেষ করে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে নয়াপল্টনে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ দেখে সরকার একেবারে ভড়কে গেছে। আর তার পর থেকেই শুরু হয়েছে এমন আজগুবি আর গায়েবি মামলা। গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ফাইয়েদুল আলম ছেলের চিকিৎসার জন্য গত ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় সিঙ্গাপুর যান। ওই দিন বেলা ১১টায় জেলা শহরে বিএনপি নেতাকর্মীদের মানববন্ধনে লাঠিপেটা করে পুলিশ। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যানবাহন ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাতে মামলা করে পুলিশ। সেই মামলায় সিঙ্গাপুর যাওয়া ওই নেতাকেও আসামি করা হয়। একই ধরনের মামলার অভিযোগ উঠেছে শ্রীপুরে। সেখানে ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নাশকতার অভিযোগে করা মামলায় উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সিরাজ কাইয়াকে আসামি করা হয়েছে। অথচ তার স্বজনেরা বলেছেন, তিনি চিকিৎসার জন্য এক সপ্তাহ ধরে ভারতে অবস্থান করছেন।
এমনি ঘটনা আরো আছে। ওয়ারী থানাধীন লুৎফুল হকের বয়স ৮২ বছর। তিনি গুরুতর অসুস্থ। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনির চিকিৎসার জন্য তিনি গত ৪ আগস্ট থেকে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর তিনি বাড়ি ফিরে গেছেন। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা এমনই নাজুক যে, অন্য কারো সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। ল্যাবএইডে চিকিৎসার সময় তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও পুলিশ দেখতে পেয়েছে যে, বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর ওয়ারীতে সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রের এক সমাবেশে ৩ সেপ্টেম্বর এই লুৎফুল হকও অংশ নিয়েছেন। এই মামলার ৯৬ জন আসামির একজন লুৎফুল হকও। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী এই নাশকতামূলক কাজের জন্য তারা আর কে মিশন রোডের বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাবের খেলার মাঠে সমবেত হয়েছিল। তার ছেলে রেজাউল হক জানান, মামলা দায়েরের দু’দিন পর গত ৫ সেপ্টেম্বর তাকে হুইল চেয়ারে করে জামিনের জন্য আদালতে নিয়ে যান তারা। আদালত চার্জশিট দাখিল পর্যন্ত তাকে জামিন দিয়েছেন।
এ রকম ঘটনা আরো আছে। বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা সাব্বির আহমেদ আরিফকে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটি যখন ঘটে তখন তিনি দেশেই ছিলেন না। তার ভিসা, ইমিগ্রেশন ও হোটেল ডকুমেন্ট, বর্ডিং পাস প্রভৃতি পরীক্ষা করে দেখা গেছে তিনি সেপ্টেম্বরের ১ থেকে ৪ তারিখ পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন। সাব্বির বলেছেন, পুলিশ সব সময় আমার পিছু নেয় বলে আমি বাড়িতেই থাকতে পারি না। তাই আমি যখন ইন্ডিয়ায় ছিলাম তখন আমি আসামি হয়েছি। এই মামলার অপর আসামি মো: ইব্রাহিম ওয়ারী থানা যুবদলের একজন নেতা। গত বছর ১২ নভেম্বর জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, তার বিমান টিকিট, ইমিগ্রেশন এবং হোটেল ডকুমেন্ট বলে যে তিনি ৭ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত তার ছোট বোনের চিকিৎসার জন্য চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে ছিলেন। তার আইনজীবী এসব কাগজপত্র আদালতে দাখিল করলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে এখন ১৬টি মামলা ঝুলছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন তবে পুলিশ তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন তিনি সে ধরনের কোনো কাজ করেননি। পুলিশের এসআই উৎপল দত্ত মামলার বিবরণে লেখেন যে, তিনি এবং আরো কিছু পুলিশ সদস্য তিন সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাবের খেলার মাঠে সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে উপস্থিত হন। কিন্তু পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে যায়। পরে এলাকার লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে এসআই উৎপল সেখানে সমবেত হওয়া ৯৬ জনকে চিহ্নিত করেন এবং নাশকতায় জড়িত আরো বহুসংখ্যক লোক চিহ্নিত করতে পারেননি।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় ওই খেলার মাঠে যান। গিয়ে তিনি দেখতে পান ডজনখানের ছেলে সেখানে ক্রিকেট খেলছে। তাদের কাছে তিনি জানতে চান, ৩ সেপ্টেম্বর ওই খেলার মাঠে বিএনপির লোকজন সমবেত হয়েছিল কি না। কিন্তু তারা বলে, আমরা এখানে প্রত্যেক দিন খেলতে আসি, আমরা এ রকম কোনো ঘটনা দেখিনি বা শুনিওনি। ওই খেলার মাঠের আশপাশের কমপক্ষে ১০ ব্যক্তি বলেছেন, ৩ সেপ্টেম্বর এখানে তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। খেলার মাঠ ৮ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং এই মাঠে প্রবেশ বা বের হওয়ার জন্য একটি মাত্র দরজা রয়েছে। উৎপল তার মামলায় বলেছেন, তিনি এসব কথা জেনেছেন ঘটনার আশপাশের লোকজন ও দোকানদারদের কাছ থেকে। কিন্তু দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি আশপাশের কমপক্ষে ১৫ দোকানের মালিক-শ্রমিকের সাথে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি এখানে এ ধরনের তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। একজন দোকানদার হাসতে হাসতে বললেন, এই খেলার মাঠে বিএনপির লোকজন জড়ো হয়েছিল এ কথা আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম। এ বিষয়ে উৎপলকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। ঘটনার চমৎকারিত্ব এখানেই শেষ নয়। আরেকটি পত্রিকা রিপোর্ট করেছে, বিএনপির চকবাজার থানার আহ্বায়ক আবুল আজিজুল্লাহ নাশকতামূলক কাজ করেছে। কিন্তু আজিজুল্লাহ তার ২৬ মাস আগে ২০১৬ সালের মে মাসে ইন্তেকাল করেছেন। তবে ৫ সেপ্টেম্বর দায়ের করা পুলিশের মামলায় বলা হয়েছে, আজিজুল্লাহ অন্য নেতাদের সাথে মিলে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এ প্রসঙ্গে মামলার বাদি এসআই কামালউদ্দিন বলেন, সাক্ষীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এটি যাচাই করার জন্য তার হাতে কোনো সময় ছিল না। তবে যদি কোনো মৃত ব্যক্তির নামে মামলা দায়ের করা হয়ে থাকে তাহলে সংশোধন করা হবে। দেশজুড়ে আসলে এখন এ পরিস্থিতি চলছে। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের চাপে রাখা, ভয়ভীতি দেখানো, মামলা-হামলা ও গ্রেফতার করে তাদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য সরকার এমন নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করছে। সরকার জনগণের ভোটের ওপর মোটেও নির্ভর করতে চাইছে না। কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর তারা পুলিশ, ছাত্রলীগ ও হেলমেটবাহিনী দিয়ে যে নির্যাতন চালিয়েছে তাতে এই বিপুল ছাত্রসমাজের ভোটের আশা তারা করতে পারেন না। তেমনিভাবে স্কুল-কলেজের যেসব তরুণ শিক্ষার্থী সদ্য ভোটার হয়েছেন তাদের ওপরও যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তাতেও নতুন ভোটারদের ভোট আশাও সুদূর পরাহত।
সুতরাং সরকারের হাতে থাকল কী? তাদের হাতে আছে র্যাব পুলিশ বিজিবি প্রশাসন আর ডাণ্ডা। কিন্তু পৃথিবীতে যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে যে জনতার শক্তির সামনে তাদের প্রতিরোধের মুখে সেসব বাহিনী খড়কুটোর মতো উড়ে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত জনগণেরই জয় হয়। হ
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement