২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সড়কে দীর্ঘ হচ্ছে প্রাণহানির সারি

-

সম্প্রতি ইউরোপের বুলগেরিয়ায় ভয়াবহ এক বাস দুর্ঘটনায় ১৭ যাত্রী নিহত হয়। সাথে সাথে তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়। ছোট মন্ত্রী নয়, একেবারে জাঁদরেল মন্ত্রী। মন্ত্রীত্রয় হলেন পরিবহন, স্বরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক উন্নয়ন মন্ত্রী। তিন মন্ত্রীই তাদের পদত্যাগের কথা জানান (সূত্র রয়টার্স ও এএফপি-বণিক বার্তা ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। এ রকম একটি ঘটনা বিশেষ করে একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিগত ৪৭ বছর ঘটেনি। ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা আশা করা যায় না। পশুপাখির জীবনের যতটুকু নিরাপত্তা আছে, তা-ও আমাদের নেই। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা ভরে থাকে ডজন ডজন মৃত্যুর সংবাদ। নিরাপত্তা এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। মানুষ স্বভাবজাত স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়। সেটা বহু বছর ধরে ‘গরুর রচনা’ লেখার মতো হয়ে গেছে। নিরাপদ সড়ক চাইÑ এ রচনা এখন মানুষের মুখে মুখে। হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থী নিরাপদ সড়কের জন্য প্রায় ৯ দিন মানুষের বিবেককে জাগাতে চেয়েছিল। যারা বিবেককে জাগাতে চায়, তাদের আজ রাজনীতির খোলসে আবদ্ধ করা হয়। আর যারা বিবেকে পচন ধরায়, তাদের নিয়ে রমরমা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এ এক আজব দেশÑ নাম তার বাংলাদেশ। কোরবানির ঈদের আগে ও পরে ১৩ দিনে সড়কে ২৩৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয় ২৫৯ জন যাত্রী। ১৩ দিনের হিসাব মতে, এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে আরো ৯৬০ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। (ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সংবাদ সম্মেলন ৩১ আগস্ট ২০১৮)।
বিগত তিন বছরে ঈদুল আজহার ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় একটি চিত্র এখানে তুলে ধরছি। ২০১৬ সালে ১৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২৪ যাত্রী, আহত হয় এক হাজার ৫৫ জন। ২০১৭ সালে ২১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২৫৪, আহত হয় ৬৯৬ জন। ২০১৮ সালে ২৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২৫৯, আহত হয় ৯৬০ জন (২০১৮ জুন পর্যন্ত হিসাব)। এ হলো ঈদযাত্রায় তিন বছরে আহত ও নিহত যাত্রীর সংখ্যা। এবার আসুন বিগত চার বছরে সারা বাংলাদেশে কত মানুষ নিহত, আহত ও পঙ্গু হয়েছে তার একটি হিসাবের দিকে তাকাই। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছয় হাজার ৫৮১টি। নিহত মানুষের সংখ্যা আট হাজার ৬৪২ জন, আহত হয় ২১ হাজার ৮৫৫ জন, চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করে এক হাজার ৩০৫ জন। ২০১৬ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা চার হাজার ৩১২টি। নিহত হয় ছয় হাজার ৫৫ জন, আহত হয় ১৫ হাজার ৯১৪ জন মানুষ, পঙ্গুত্ব বরণ করে ৯২৩ জন। ২০১৭ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা চার হাজার ৯৭৯টি। নিহত মানুষের সংখ্যা সাত হাজার ৩৯৭ জন। আহত হয় ১৬ হাজার ১৯৩ জন এবং পঙ্গুত্ববরণ করে এক হাজার ৭২২ জন। ২০১৮ সালে দুর্ঘটনার (২০১৮ জুন পর্যন্ত হিসাব) সংখ্যা দুই হাজার ৮৬০টি। এতে প্রাণ হারায় তিন হাজার ২৬ জন মানুষ। আহত হয় আট হাজার ৫২০ জন (সূত্র- বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদন ৩১ আগস্ট ২০১৮)।
শুধু মৃত্যু নয়, চলন্ত বাসে হয় গণধর্ষণ। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ লিখেছেÑ ফের চলন্ত বাসে প্রতিবন্ধী তরুণীকে গণধর্ষণ, ইনকিলাবে ২ সেপ্টেম্বর লিড নিউজ ছিলÑ এখন মৃত্যুর ঠিকানা সড়কে ঝরল ১৫ প্রাণ। প্রতিনিয়ত সড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর লাইন। মানুষ এখন মৃত্যু পরওয়ানা নিয়ে বাসে উঠছে। বাংলাদেশে সড়কে কোনো আইনই সক্রিয় নয়। কিছু দিন আগে এক টাকা দুই টাকা নিয়ে তর্ক করে এক যাত্রীকে ফেলে দিয়ে পিষে মেরে ফেলল বাসের চালক ও হেলপার। বর্তমানে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত এবং আতঙ্কিত শব্দ হলোÑ সড়কে মৃত্যু। প্রতিদিন মৃত্যুর লাইন দীর্ঘ হচ্ছে।
২-৯১৮ বণিক বার্তায় লিখেছেÑ চার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১২ জন। সড়কে প্রতিযোগিতা, গতিময়তা-জীবনের দামে নয়, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গবেষণার তথ্যমতে প্রতি বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতি হয় বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি হারায় দেশ। ইনকিলাব ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ লিখেছেÑ সড়কে গেল সাত প্রাণ। সাভারে তিনজন, নোয়াখালীতে দুইজন লালমনিরহাট ও গাজীপুরে একজন করে মোট সাতজন প্রাণ হারায়। আহত অর্ধশতাধিক। কালের কণ্ঠ ৫-০-১৮ লিখেছেÑ সড়কে ১১ জেলায় ১১ জন নিহত। ঢাকা, গাজিপুর, সাতক্ষীরার তালা, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, নওগাঁ, রংপুরের বদরগঞ্জ, কক্সবাজারের চকরিয়া, মাদারীপুরের শিবচর, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুরের নগরকান্দা এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় আলাদা সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়েছে। কালের কণ্ঠে লিখেছেÑ সাভার ও সেনবাগে সড়কে ঝরল পাঁচ প্রাণ (০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮), বণিক বার্তায় লিখেছেÑ চার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৯ জন (৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮) বাংলাদেশে সড়কে এত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে কেনÑ এ নিয়ে টকশো প্রতিদিন হচ্ছে। নগরবিদেরা, বিশেষজ্ঞরা নানা বক্তব্য দিচ্ছেন প্রতি বছর ধরে, কিন্তু সড়কে মৃত্যুর লাগাম কেউ টেনে ধরতে পারছে না। কারণÑ সারা দেশের গণপরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে, যারা সড়ক নৈরাজ্যকেই তাদের মুনাফা অর্জনের মূল টার্গেটে পরিণতি করেছে। এদের প্রভাবের কাছে যানবাহন নিবন্ধনের বিধিবিধান গণপরিবহন ব্যবসাসংক্রান্ত আইন-কানুন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাদের কায়েমি স্বার্থের কাছে গণপরিবহন খাতের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে আছে। বর্তমান সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী ওই সংগঠনগুলোর বড় মাপের নেতা। দোষী এবং দোষীর বিচারের মাঝখানে যদি কেউ শক্তিশালী দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যান, বিচারের বাণী তখন চুপচাপ আড়ালে বসে শুধু চোখের পানি ফেলে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ৩ আগস্ট ২০১৮ প্রথম আলোতে এক বিবৃতিতে বলেছেনÑ গণপরিবহন খাতকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে চলতে দেয়া উচিত। সড়ক আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। এখানে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ হবে না।
সম্প্রতি নানা জরিপে দেখা গেছে, সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ৯ লাখ ভুয়া চালক। এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যান ও দুর্ঘটনার কারণ বলে বিশেষজ্ঞদের মতামতে উঠে এসেছেÑ কিন্তু সড়ক ব্যবস্থাপনায় যারা রয়েছেন তারা এসব বিষয় আমলে নিচ্ছেন না। এখন দেখার বিষয় আর কত মানুষ, কত ছাত্র মরলে বাংলাদেশের মন্ত্রী-এমপিদের টনক নড়ে। পত্রিকায় উঠেছে, ছাত্র মরে বাসে মন্ত্রী হাসে। অবশ্য বেফাঁস কথা বলায় বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রীরই কিছুই হয় না। অতীতেও হয়নি। অথচ সারা বিশ্বে বেফাঁস কথা বলার জন্য মন্ত্রিত্ব হারানোর ঘটনা কম নয়। ২০১৭ সালে জাপানে পুনর্গঠনমন্ত্রী এবং কানাডার ক্রীড়ামন্ত্রী পদত্যাগ করেন। পত্রিকায় দেখলাম, লাখ লাখ লাইসেন্সহীন ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। কয়েক লাখ ফিটনেসহীন গাড়ি রাস্তায় চলছে। তাদের কারণেই সড়ক নিরাপদ থাকছে না, এটা কেন সরকার বুঝতে চাইছে না? সড়কের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা বেশির ভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত। ঘুষ খেয়ে গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়। গাড়ির বৈধ ডকুমেন্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ইন্স্যুরেন্সের মতো অতি সাধারণ বিষয়গুলোও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর। ট্রাফিক অব্যবস্থা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে প্রয়োজন সততা ও নিয়মানুবর্তিতাÑ এ ছাড়া আর কিছুই প্রয়োজন নেই। ৯ দিনে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তা প্রমাণ করে দেখিয়েও দিয়েছে, তারপরও টনক নড়ছে না সরকারের উচ্চ মহলের। অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের হাতে যখন গাড়ির স্টিয়ারিং থাকে, তখন সেই গাড়ি তো দুর্ঘটনায় পড়বেই। সিঙ্গাপুরে গাড়ির চালক হতে হলে তার নি¤œতম বয়স হতে হবে ৪০। এ রকম আইন কি আমাদের দেশে আছে? ঢাকার সড়কপথে শব্দদূষণ স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করে গেছে বহু আগেই। ঢাকার সড়কপথে কোন গাড়ি কোন রাস্তায় চলবে তারও কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। লেগুনা, রিকশা, ট্রাক, প্রাইভেট কার, বাস, ময়লার গাড়ি, বড়-সিমেন্টের গাড়ি, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক যানবাহন একই রাস্তায় অনবরত এবং বেপরোয়াভাবে চলছে। এসব কারণে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা বিশ্বের সর্বনি¤œতম অবস্থানে পৌঁছেছে। হ
লেখক : গবেষক ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement