২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কী হবে জানি না, মহান আল্লাহর সাহায্য চাই

সংবিধান ও রাজনীতি  
-

প্রসঙ্গ : কারবালা ও হিজরি নববর্ষ
গত সপ্তাহের বুধবারে এবং তার আগের সপ্তাহের বুধবারে আমার লেখা কলামটি ছিল রাজনৈতিক বিষয়; এটাই স্বাভাবিক এবং আমার কাছ থেকে প্রত্যাশিত। গত বুধবার ৫ সেপ্টেম্বর আমার কলামে শেষের দিক থেকে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটি ছিল (ইংরেজি পরিভাষায় : সেকেন্ড লাস্ট বা পেন-আলটিমেট প্যারাগ্রাফ), রাজনৈতিক বক্তব্যের শেষ অনুচ্ছেদ। সেই অনুচ্ছেদে আটটি আঙ্গিকের কথা উল্লেখ করেছিলাম। শেষ আঙ্গিকটি ছিল নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো কী কী ওয়াদা দেয় এবং সেই ওয়াদাগুলোর সাথে জনগণের মনের চাহিদা বা সম্পর্ক কী, এ প্রসঙ্গে আমি লিখব বলেছিলাম। তবে উভয় দিনে ওই কলামটির সর্বশেষ অনুচ্ছেদে আমি নতুন হিজরি বছরের আগমন এবং মহররম মাসের আগমন এবং ৬১ হিজরি সালে কারবালার ময়দানে সংঘটিত ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনা তথা প্রিয় নবীজী সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রা:সহ তার পরিবারের তথা কাফেলার ৭২ জন শিশু-যুবা-প্রবীণ নারী-পুরুষের শাহাদতবরণের ঘটনা সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম। সেই মহররম মাস এসেই গেল। মহররম মাসকে স্বাগতম। আশা করি এই কলামের পাঠকগণ, ১০ মহররমের তাৎপর্য নিয়ে, কারবালার ঘটনার তাৎপর্য নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করবেন, লেখালেখি করবেন, আলাপ-আলোচনা করবেন। আমার নিজের অফিসেও সোমবার ১০ সেপ্টেম্বর বাদ মাগরিব আমরা কয়েকজন বসে এই একই বিষয়ে আলোচনা করেছি। বিদ্যমান পরিবেশ পরিস্থিতিতে বৃহত্তর আয়োজন হয়নি।

সচরাচর করা একটি প্রশ্ন
আজ বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর তারিখের কলামে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন-পূর্বকালীন ওয়াদা সম্পর্কে লেখার কথা। তবে তার আগে একটি অন্য বিষয়। আজকের এ কলামটি, যেটি পাঠক পড়ছেন ১২ সেপ্টেম্বর, সেই কলামটি লিখতে বসেছিলাম রোববার ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক থেকে ফিরে এসে রাত পৌনে ৯টায়। লেখার সময় মনে হলো, হিজরি নববর্ষ উপলক্ষে কিছু-না-কিছু বলা বা লেখা উচিত। তাই কলামের বড় অংশটিতে কিছু ধর্মীয় বক্তব্য এলো। কিন্তু বক্তব্যটি আমার মনগড়া নয় বা আমার নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। বক্তব্যটি কুরআনে বর্ণিত ঘটনাভিত্তিক পবিত্র কুরআনের ১৮ নম্বর সূরা (সূরা কাহফের আয়াত ৬০ থেকে ৮২ দ্রষ্টব্য)। পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত একটি ঘটনাকে আমি সাধারণ পাঠকসমাজের সামনে উপস্থাপন করছি এবং সাধারণ সামাজিক সাংসারিক ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ধর্মভিত্তিক সর্ব-আঙ্গিকের বাক্যের সমর্থনে। সেই সর্ব-আঙ্গিকের বাক্যটি কী? বাক্যটি হলো, মহান আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন, একজন মানুষ বা সমষ্টিগত মানুষের জন্য কোন কর্ম মঙ্গলজনক বা কোন কর্মটি মঙ্গলজনক নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা দয়াপরবশত এ সুনির্দিষ্ট জ্ঞানটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো-না-কোনো মানুষকে অবশ্যই দান বা প্রদান করতেই পারেন। অতি সম্প্রতি রাজনৈতিক কর্মী সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কাছে শুভাকাক্সক্ষীদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন থাকে, অনেকটা এ রকম ভাষায় : ‘ভাই দেশে কী হতে যাচ্ছে? অথবা ভাই দেশের খবর কী?’ ইত্যাদি। এর উত্তরে একজন মানুষ তথা রাজনৈতিক কর্মী সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম কতটুকুই বা বলতে পারবে? কারণ, বাস্তবেই তো কী হবে বা কী হবে না, সেটি মানুষ কল্পনা করতে পারে বা পরিকল্পনা করতে পারে; কিন্তু হুবহু বা সঠিক উত্তরটি জানেন একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা। তাই এই মৌলিক বাক্যটির মর্মের ওপর ভিত্তি করেই আজকের কলাম।

একটি সুপরিচিত তাফসির গ্রন্থ
বিভিন্ন জ্ঞানী ব্যক্তি কর্তৃক তথা বিভিন্ন সময়কালের আলেম, মুফতি তথা মুফাসসেরগণ কর্তৃক কৃত পবিত্র কুরআনের অনেক তাফসির ঘাঁটার সুযোগ বা অবকাশ আমার কাছে আছে; এর জন্য মহান আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। তবে তাফসিরে বর্ণিত কথাগুলো বা তাফসিরের ভাষ্য বোঝার জন্য আমার মেধা সব সময় যথেষ্ট নয়। সবগুলো তাফসিরই অতি সহজ নয়। সহজেই বোধগম্য অন্যতম তাফসিরের নাম হলো ‘তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন’। এ তাফসিরটির সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে বাংলা করেছেন (বর্তমানে মরহুম) বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ও অত্যন্ত সুপরিচিত মাসিক মদীনা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। এ প্রসঙ্গে একটু প্রেক্ষাপট নিচের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করছি।

সুপরিচিত তাফসির গ্রন্থটির প্রেক্ষাপট
হিজরি ১৪৪০ সাল সবে শুরু হলো, তাকে স্বাগতম। আজ থেকে ৩৯ বছর আগে যখন হিজরি চতুর্দশ শতাব্দী শুরু হয়েছিল। শুরু হওয়ার দু-চার বছর আগেই তৎকালীন সৌদি আরবের শাসনকর্তা, বাদশাহ ফাহাদ ইবনে আবদুল আজিজ, সৌদি আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। প্রকল্পটি ছিল দুনিয়ার সব ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ কপি ও তৎসহ তাদের নিজস্ব ভাষায় পবিত্র কুরআনের সঠিক অনুবাদ সহজলভ্য করা। প্রকল্পটি দুঃসাহসী ছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে পবিত্র মদিনা নগরীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স। সৌদি সরকারকে সহায়তা করেছিল অন্যতম বিশ্ব মুসলিম সংস্থা, যার নাম ছিল ‘রাবেতাতুল আলম আল-ইসলামী’। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম অঞ্চলের অধিবাসী মুসলিম জনসংখ্যা কোনো অবস্থাতেই ১৫ কোটি ছিল না এখন থেকে ৪০ বছর আগে। বাংলাভাষী এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সহজবোধ্য সংক্ষিপ্ত তাফসির গ্রন্থ প্রকাশ করার লক্ষ্যে বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স ও রাবেতার কেন্দ্রীয় উপদেষ্টাগণ মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ: রচিত এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কর্তৃক অনূদিত “তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন” গ্রন্থটি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রাবেতার অঙ্গসংস্থা ‘এদারাতুল কোরআন’ আট খণ্ডে সমাপ্ত বিরাট তাফসির গ্রন্থটি সংক্ষিপ্তকরণ ও সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করে ওই তাফসিরের বাংলা অনুবাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ওপর। তিনি অনেক পরিশ্রম করে তাফসিরখানা সংক্ষেপিত করে বাংলা ভাষাভাষী সর্বস্তরের পাঠকের জন্য সহজবোধ্য করে দিয়েছেন। আল্লাহ পাক এ মহতী উদ্যোগের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যোগ্য প্রতিফল দান করুন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কর্তৃক কৃত ও সংক্ষিপ্ত এক খণ্ডের তাফসির গ্রন্থটি ১৪৯৪ পৃষ্ঠার; অত্যন্ত উন্নত মানের ছাপা, অত্যন্ত উন্নত মানের মুদ্রণ, অত্যন্ত উন্নত মানের কাগজ এবং উন্নত মানের বাঁধাই। সেই সংক্ষিপ্ত বাংলায় অনূদিত তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন-এর ৮১১ থেকে ৮১৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে আমি যা লিখলাম তার বৃহদংশই সেখান থেকে হুবহু উদ্ধৃত, শুধু দু-চারটি শব্দ যোগ-বিয়োগ হয়েছে। সেখান থেকেই হুবহু উদ্ধৃত করছি।

খিজির আ: ও মুসা আ:-এর সাক্ষাতের প্রেক্ষাপট
পুরো ঘটনাটি হজরত উবাই ইবনে কাবের রেওয়ায়েতে বর্ণিত। বর্ণনা মোতাবেক রাসূলুল্লাহ সা:, মুসা আ: এবং খিজির আ:-এর মধ্যকার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি নি¤œরূপ। একদিন হজরত মুসা আ: বনি ইসরাইলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। জনৈক ব্যক্তি মুসা আ:কে প্রশ্ন করলেন : সব মানুষের মধ্যে অধিক জ্ঞানী কে? হজরত মুসা আ:-এর জানা মতে, তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ওই সমসাময়িককালে আর কেউ ছিলেন না। তাই প্রশ্নকারীর উত্তরে মুসা আ: বললেন : আমি সবার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর নৈকট্যশীল বান্দাদেরকে বিশেষভাবে গড়ে তোলেন। তাই মুসা আ:-এর জবাব তিনি পছন্দ করলেন না। এখানে বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার ওপর ছেড়ে দেয়াই ছিল উত্তম আদব। অর্থাৎ, এ কথা বলে দেয়া উচিত ছিল, আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন, কে অধিক জ্ঞানী। মুসা আ: উত্তর দেয়ার পরপরই ওই উত্তরের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসা আ:-এর প্রতি ওহি নাজিল হলো, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দাহ আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। এ কথা শুনে মুসা আ: আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানালেন, তিনি অধিক জ্ঞানী হলে তার কাছ থেকে জ্ঞানলাভের জন্য আমার সফর করা উচিত। তাই বললেনÑ ইয়া আল্লাহ, আমাকে তার ঠিকানা বলে দিন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নিন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের দিকে সফর করুন। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেখানেই আমার এই বান্দার সাক্ষাৎ পাবেন। এখানে আমি কলাম লেখক, স্থান বাঁচানোর জন্য কিছু ঘটনা বাদ দিয়ে ওই ধাপে চলে গেলাম, যেই ধাপে ওই জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়ে গেল। যেই জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে মুসা আ:-এর সাক্ষাৎ হলো তিনি ছিলেন খিজির আ:।

সাক্ষাৎ ও তিনটি ঘটনা
যথাবিহিত সালাম বিনিময়ের পর মুসা আ: বললেন, আমি আপনার কাছ থেকে ওই বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ তায়ালা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত খিজির আ: বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না হে মুসা। আমাকে আল্লাহ তায়ালা এমন এক জ্ঞান দান করেছেন, যা আপনার কাছে নেই। পক্ষান্তরে আপনাকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা আমি জানি না। মুসা আ: বললেন ইনশা আল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। আমি কোনো কাজে আপনার বিরোধিতা করব না। হজরত খিজির বললেন, যদি আপনি আমার সাথে থাকতেই চান, তবে কোনো বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে তার স্বরূপ বলে দেই। অতঃপর ঘটে গেল তিনটি ঘটনা। প্রথম ঘটনা। মুসা আ: এবং খিজির আ: সমুদ্রের পার ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একটি নৌকা এলে তাঁরা নৌকায় আরোহণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। নৌকার মাঝিরা হজরত খিজিরকে চিনে ফেলল এবং কোনোরকম পারিশ্রমিক ছাড়াই তাঁদেরকে নৌকায় তুলে নিলো। নৌকায় চড়েই খিজির আ: কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন। এই কর্ম দেখে হজরত মুসা আ: অস্থির হলেন এবং প্রশ্ন করলেন : তারা কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদের নৌকায় তুলে নিয়েছে। আপনি কি এরই প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙে দিলেন, যাতে সবাই ডুবে যায়? আপনি তো একটি অতি মন্দকাজ করলেন! উত্তরে খিজির আ: বললেন, আমি আগেই বলেছিলাম আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। তখন মুসা আ: পেশ করলেন : আমি আমার ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম; আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না। অতঃপর উভয়ে নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের কূল ধরে চলতে লাগলেন। দ্বিতীয় ঘটনা। হঠাৎ খিজির আ: একটি বালককে অন্যান্য বালকের সঙ্গে খেলা করতে দেখলেন। খিজির আ: স্বহস্তে বালকটির মস্তক তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন তথা বালকটি নিহত হলো। এই কর্ম দেখে হজরত মুসা আ: অস্থির হলেন এবং প্রশ্ন করলেন, আপনি একটি নিষ্পাপ প্রাণকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন। এটি একটি বিরাট গুনার কাজ করলেন। খিজির আ: বললেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। মুসা আ: দেখলেন বা অনুধাবন করলেন, এ ব্যাপারটি পূর্বাপেক্ষা গুরুতর। তাই মুসা আ: বললেনÑ এরপর যদি কোনো প্রশ্ন করি, তবে আপনি আমাকে পৃথক করে দেবেন। আমার ওজর-আপত্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। অতঃপর উভয়েই আবার চলতে লাগলেন। তৃতীয় ঘটনা। এক গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা গ্রামবাসীর কাছে খাবার চাইলেন। গ্রামবাসী সোজাসুজি অস্বীকার করল। হজরত খিজির আ: ওই গ্রামে একটি প্রাচীরকে পতনোন্মুখ (অর্থাৎ একটি দেয়াল প্রায় পড়ে যাচ্ছে পড়ে যাচ্ছে অবস্থা) দেখতে পেলেন। তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটিকে সোজা করে দিলেন। মুসা আ: বিস্মিত হয়ে বললেন, আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করল অথচ আপনি তাদের এত বড় কাজ করে দিলেন; ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খিজির আ: মুসা আ:কে বললেনÑ এখন শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটাই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়।

তিনটি ঘটনার ব্যাখ্যা
এরপর খিজির আ: ওপরে উল্লিখিত তিনটি ঘটনার প্রেক্ষাপট বা কারণ বা তাৎপর্য মুসা আ:-এর কাছে বর্ণনা করলেন, যেগুলো এখানে আলোচনায় আনছি না কলামকে সংক্ষিপ্ত রাখার জন্য। খিজির আ: উপসংহার টানলেন এই বলে, এ হচ্ছে সেসব ঘটনার স্বরূপ যেগুলো দেখে আপনি ধৈর্য ধরতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সা: এ ঘটনার বর্ণনা করে বলেন : হযরত মুসা আ:-এর প্রথম আপত্তি ভুলক্রমে, দ্বিতীয় আপত্তি শর্ত হিসেবে এবং তৃতীয় আপত্তি ইচ্ছাক্রমে হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সা: বর্ণনা অব্যাহত রেখে বলেছিলেন, প্রথম ঘটনার পর উভয়ে যখন নৌকায় ছিলেন এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন একটি পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসেছিল এবং সমুদ্র থেকে ঠোঁট দিয়ে এক চঞ্চু (তথা এক চুমুক) পানি তুলে নিয়েছিল। ওইটা দেখে খিজির আ: মুসা আ:কে বলেছিলেন : আমি খিজিরের জ্ঞান এবং আপনি মুসার জ্ঞান উভয়ে মিলে আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের মোকাবেলায় এমন তুলনা হয় না, যেমনটি এই পাখির চঞ্চুর পানির সাথে রয়েছে সমুদ্রের পানির। এই কলামের লেখক (ইবরাহিম) অন্যত্র থেকে ব্যাখ্যা ধার করে এখানে উপস্থাপন করছেন। সমুদ্রের পানি থেকে এক চুমুক পানি পাখিটি ঠোঁটে নিলো; সমুদ্রে যত পানি তার তুলনায় বা অনুপাতে এক চুমুক পানির অবস্থান নির্ণয় করা যেমন মানুষের জন্য অসম্ভব, তেমনি মহান আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের সাথে মানুষের জ্ঞান উদাহরণস্বরূপ খিজির আ: ও মুসা আ:-এর সম্মিলিত জ্ঞানের আনুপাতিক সম্পর্কও ওই এক চঞ্চু পানির মতো।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ভবিষ্যৎ ও আমার প্রার্থনা
রাজনৈতিক নেতৃবর্গ, রাজনৈতিক কর্মীরা চেষ্টা করতে থাকবেন, পরিকল্পনা করতে থাকবেন, কর্মসূচি প্রণয়ন করতে থাকবেন। বর্তমানে ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের লক্ষ্য আরো এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এবং এই চাওয়ার সপক্ষে তারা যুক্তি উপস্থাপন করেই যাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট ছাড়া অন্য সব দল, যারা রাজপথের বিরোধী দল; তারা চান বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা পরিবর্তন হোক এবং এই চাওয়ার সপক্ষে বিরোধী শিবিরেরও যুক্তি আছে। ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের অনুকূলে যুক্তি উপস্থাপন করেই যাচ্ছেন; বিরোধী শিবিরও যুক্তি উপস্থাপন করেই যাচ্ছেন। উভয় শিবিরের মতে তথা ক্ষমতাসীন ও বিরোধী শিবিরের মতে, (আমার ব্যক্তিগত মত এই কলামে উপস্থাপন করছি না) ক্ষমতায় থেকে যাওয়া বা ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়া, বাংলাদেশের মঙ্গলের জন্যই প্রয়োজন। জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, দুনিয়াবি নিয়মে আমরা যার যার চাহিদা উপস্থাপন করব এবং নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব; সরকারি ক্ষমতাসীন শিবির বা জনগণের বক্তব্য উপস্থাপনকারী রাজপথের বিরোধী শিবির। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য কী ঘটনা কী অবস্থা বা কী অবস্থান বরাদ্দ করে রেখেছেন, সেটি আমরা জানি না। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ৮৫ শতাংশের বেশি মুসলিম উম্মাহর অংশ। বাংলাদেশের মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক সমাজের অংশ। অতএব, বাংলাদেশের মানুষের ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদির সাথে দক্ষিণ এশিয়ার এবং বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক থাকতেই পারে। অতএব, দুনিয়াবি সব চেষ্টার পাশাপাশি, আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক সব চেষ্টার অতিরিক্ত আমরা মহান আল্লাহর কাছেও প্রার্থনা করতেই থাকব, বাংলাদেশের কল্যাণ বা মঙ্গলের জন্য, বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য, জুলুম ও বৈষম্যবিহীন সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার জন্য। বাংলাদেশের মানুষের জন্য, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জন্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্য, বাংলাদেশ শাসনকারী ক্ষমতাসীন সম্প্রদায়ের জন্য, বাংলাদেশের মজলুম জনতার জন্য যেটা ভালো বা যেটাই মঙ্গলজনক, যেটাই কল্যাণকর, সেটাই যেন আল্লাহ তায়ালা দান করেন; এটাই আমাদের প্রার্থনা। মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব জ্ঞানের মালিক। এরূপ উদাহরণ যেহেতু আছে, অতীতে তিনি বিশেষ বিশেষ বান্দাকে বিশেষ জ্ঞান দিয়েছেন, সেহেতু আমরা উৎসাহ বোধ করতেই পারি, তিনি বর্তমানেও তাঁর কোনো-না-কোনো প্রিয় বান্দাকে এরূপ বিশেষ জ্ঞান দিতেও পারেন। অবশ্যই আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে তথা গোপনে তথা আমাদের অগোচরে তথা অপ্রকাশিতভাবে এবং ওইরূপ প্রিয় বান্দারা বাংলাদেশের মানুষকে যেন সঠিক পথনির্দেশনা দিতে পারেন, তার সুযোগ-অবকাশ-পরিবেশ আমরা মহান আল্লাহর কাছে থেকেই কামনা করছি। আর কোনো নবী আসবেন না; কিন্তু নবীগণের আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানভিত্তিক উত্তরসূরি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বা সমাজে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন এটাই বাস্তবতা। সৎকর্মশীল বা সালেহিন বান্দারা আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন, এটাই বাস্তবতা। আমি কোনোমতেই নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না কোনো কিছু, কিন্তু কোনো একজন বিপদগ্রস্ত বান্দা তথা কোনো একটি বিপদগ্রস্ত বান্দার সমষ্টি, মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতেই পারে। আমরা সেই সাহায্য কামনা করছি। হ
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:);
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com


আরো সংবাদ



premium cement