উইঘুর মুসলিম : বিপন্ন অন্ধকার!
- সোলায়মান আহসান
- ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
চীন একটি কমিউনিস্ট দেশ। সিনহুয়া (সরকারি বার্তা সংস্থা) এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম কর্তৃক পরিবেশিত সংবাদই একমাত্র জানার উপায় চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। ফলে চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বা সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের খবর বাইরে আসে কদাচিৎ।
এমন একটি বিষয় নিয়ে এসেছে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিটি। জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের ওপর কী ধরনের নির্যাতন করা হচ্ছে, তার বর্ণনা দিয়ে এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে অবলিম্বে নির্যাতিত বন্দী ১০ লাখ উইঘুরকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ওই কমিটি।
বিবিসি পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা জাতিসঙ্ঘে দাখিল করা প্রতিবেদনে চীনে গণহারে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের আটকের তথ্য দিয়েছে। ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য বল প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। বেইজিং এ অভিযোগকে অস্বীকার করেছে। তারা বলছেÑ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশঙ্কায়’ ধর্মীয় কিছু উগ্রবাদীকে সংশোধন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। চীন মনে করে, জিনজিয়াং প্রদেশে অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী এই ইসলামি বিদ্রোহীরা।
জাতিসঙ্ঘের জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ কমিটি জানায়, উইঘুর মুসলিমদের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বেইজিং বেশ কিছু কারাগারে গণহারে উইঘুরদের আটকে রাখছে। এ ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আছে।
জাতিসঙ্ঘের প্যানেল অবৈধভাবে আটকের পদক্ষেপ বন্ধ করে এভাবে আটক সবার অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেছে।
বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর খবরাখবর আমাদের কাছে অল্পই আসে এবং বিকৃত ও আংশিক তথ্য আমরা পাই। এর কারণ, সংবাদ পরিবেশনের আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারা মুসলমানদের বৈরী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। দেশে দেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের অনেক ঘটনাই তথ্য লুকানোর অশুভ প্রক্রিয়ায় অগোচরেই থেকে যায়।
চীনের স্বায়ত্তশাসিত জিনজিয়াং প্রদেশে কারা বাস করে, তাদের জীবন যাপন কেমন, তারা কিভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক অধিকার হারা হয়ে আছে এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে, এসব তথ্য আমাদের গণমাধ্যম বেশি পরিবেশন করে না। এমনকি সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রদত্ত বিবৃতিটি (বিবিসি এবং রয়টার্স পরিবেশিত) আমাদের বেশির ভাগ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়নি।
চীন একটি বহুজাতিক দেশ। নানা কারণে দেশটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার সুবৃহৎ দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতিগোষ্ঠী ছাড়াও ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বাস করে। চীনে ধর্মও প্রচলিত বেশ কয়েকটি। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অভ্যুদয়ের পর থেকে ধর্মকে নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হলেও প্রধান প্রধান ধর্মানুসারীরা ব্যক্তিগত জীবন থেকে ধর্মকে মুছে ফেলেননি। চীনে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ, তাও, ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্ম প্রধান। চীনের ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ১০টি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তারা হলোÑ হুই, উইঘুর, কাজাখ, কিরগিজ, তাজিক, তাতার, উজবেক, তুংশিয়াং, সালার এবং পাওআন। তাদের মোট জনসংখ্যা দুই কোটি ৩২ লাখ (২০১২)। চীনের নানা জায়গায় মুসলমানরা বাস করলেও এই ১০টি সংখ্যালঘু জাতি প্রধানত উত্তর-পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং (স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল), নিংশিয়া (স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল), সাংহাই, কানসু প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত বেশি বাস করে। চীনের মোট জনসংখ্যার ১.৬৪ শতাংশ মুসলিম। সব সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম ২০ শতাংশ, যার ৯০ শতাংশই হুই এবং উইঘুর মুসলিম। আর চীনের ৫৮.২ শতাংশ মুসলিমের বাস জিনজিয়াং প্রদেশে। এ প্রদেশে ২৪ হাজার মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ বছরের পুরনো মসজিদও রয়েছে। এতে বোঝা যায়, এই অঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থান খুব প্রাচীন ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
মধ্য এশিয়ার সীমান্তসংলগ্ন চীনের সুবিশাল, পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে সম্প্রতি জাতিগত উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে চীনের বিপুল সেনা উপস্থিতি চোখে পড়ে। বেইজিং দাবি করছে, অঞ্চলটিতে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী’ তৎপরতায় লিপ্ত। এসব মোকাবেলা করতেই না কি তারা সেনা মোতায়েন করেছে। কিছু কথিত উগ্রবাদীকে সংশোধন ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে।
চীনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ জিনজিয়াং নানা কারণে আলোচিত। ওই প্রদেশে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস ১৩০০ বছরের বেশি পুরনো। টাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রি:) এবং সুং রাজবংশের (৯৬০-১২৭৯ খ্রি:) আমলে চীনে মূলত এ অঞ্চলেই ইসলাম ধর্মের প্রচলন হয়েছিল। আরব সওদাগরেরা চীনে আসতে শুরু করার সাথে সাথে ক্রমেই আরো বেশি সংখ্যায় মুসলমান চীনে আসতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে চীনেই বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। জিনজিয়াংয়ের আদি বাসিন্দা হচ্ছেন উইঘুররা। তারা ইসলামে বিশ্বাসী। উইঘুররা জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে তুর্কিঘনিষ্ঠ। চীনের অন্যসব এলাকার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী হান জাতিগোষ্ঠী ও তার শাসকদের থেকে উইঘুররা সম্পূর্ণ আলাদা। শত বঞ্চনা ও নির্যাতন সত্ত্বে¡ও অধিকারহারা উইঘুররা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য আঁকড়ে ধরে আছে শত শত বছর ধরে। সরকারিভাবে চীনা সাম্রাজ্যের সাথে নানা টানাপড়েন ও উত্থান-পতনের পর জিনজিয়াংকে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট চীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ হিসেবে। বেইজিং দাবি করে থাকে, জিনজিয়াং সবসময়ই চীনের অংশ ছিল। তবে এ দাবির সাথে বাস্তবতার ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে।
মধ্যএশিয়া ও তুর্কি ভাষাভাষী দেশগুলোর সাথে অঞ্চলটির একীভূত থাকার ইতিহাসকে চীন সবসময়ই উপেক্ষা করে আসছে। আজো জিনজিয়াংয়ে চীনাদের চেয়ে পশ্চিমের তুর্কিদেরই অধিকতর আপন বলে গণ্য করে উইঘুররা। এর বিপরীত অবস্থানে রয়েছে হান চীনারা। তারা মনে করে, জিনজিয়াংয়ের ওপর চীনা নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ বৈধ।
‘চাইনিজ মুসলিম ফর নর্থওয়েস্ট’ গ্রন্থের লেখক মাইকেল ডিলন বলেছেনÑ
এ অঞ্চলের অত্যন্ত জটিল রাজনীতি, অর্থনীতি ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সম্মিলিত কারণেই হয়তো অঞ্চলটির ওপর এত গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। জিনজিয়াং অঞ্চলটি বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামালসমৃদ্ধ এবং এর কৌশলগত অবস্থান রাশিয়া থেকে চীনকে নিরাপদ রেখেছে। এ বিরাট প্রদেশের প্রশাসনিক সম্পর্কভুক্ত ‘আকসাই চীন’ ভারতের সাথে বিতর্কিত। এর ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়েও মাথাব্যথা কম নয় চীনের। ভারতের দাবি, ওই অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের লাদাখের অন্তর্র্ভুক্ত। অপর দিকে, চীন ১৯৬২ সালের যুদ্ধে এর দখল নেয় যা তারা এখনো তাদের অধিকারে রেখেছে। তদুপরি, পাকিস্তান ‘আজাদ কাশ্মির’ থেকে কিছু অংশ ছেড়ে দেয় চীনকে। সবমিলিয়ে, আকসাই চীন (নতুন নাম) এখন চীনাদের ভূ-সীমাভুক্ত বলে দাবি করা হয়। চীনারা ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্যের নিরিখে পুরো লাদাখ অঞ্চল চীনের মূল মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি করে। ফলে চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত বিরোধ বেশ জটিল।
চীনের এক ষষ্ঠাংশ আয়তনবিশিষ্ট জিনজিয়াং (ফ্রান্সের তিন গুণ) দেশটির তুলার শতকরা ৩০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে। উপরন্তু ১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীনের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার স্থলও ছিল জিনজিয়াং। এ প্রদেশেই চীনের সবচেয়ে বড় সামরিক ট্রেনিং সেন্টার, ঝুরি ট্রেনিং বেস অবস্থিত, যেখানে গত বছর পিপলস লিবারেশন আর্মির ৯০তম প্রতিষ্ঠাদিবস উপলক্ষে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তাই নানা কারণে জিনজিয়াং প্রদেশ চীনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি, ওই প্রদেশের সংখ্যাগুরু অধিবাসী উইঘুর মুসলিমদের অধিকারের ব্যাপারে চীনের উদাসীন থাকা আর চলতে পারে না। উইঘুরদের কাছে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ হলো, চীনের ঘনবসতিপূর্ণ পূর্বাঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক হান চীনাকে এনে জিনজিয়াং প্রদেশে পুনর্বাসিত করা। ভূমিকম্পের আশঙ্কায় উইঘুরদের পুরনো বসতি বিল্ডিংগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে আর বসতি নির্মাণ না করা স্বভাবতই তাদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। সর্বোপরি, চীনের অর্থনীতির যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে তার ছিটেফোঁটাও এ প্রদেশে পরিলক্ষিত না হওয়া কি বিরাট প্রশ্নের সৃষ্টি করে না?
উইঘুর মুসলিমরা শান্তিপ্রিয়। এর পাশাপাশি, হুই সম্প্রদায়ের কেউ কেউ উত্তেজনা ছড়াতে চায় এই কথা বলে, তারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে চায়। আর এটা মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। বেইজিং দমন-পীড়ন নয়, সংলাপ ও সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করতে পারে। কারণ ওরা সশস্ত্র পথে নয়, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি জানিয়েছে। সংশোধনের নামে অন্ধকার বন্দিশালায় না পুরে আলোকিত পৃথিবীতে তাদের বাঁচার অধিকার দেয়াই সভ্যতা ও ন্যায়নীতির দাবি। হ
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা