২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন

-

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশ-বিদেশে ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন’ কথাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত। এটা জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ সফর শেষে দেশে আসার পর দলের মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ভারত সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়’। ভারত কিন্তু ৫ জানুয়ারি ’১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, তা চায়নি। বর্তমানে জাতিসঙ্ঘ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, ইইউসহ সবাই সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের দাবির মাধ্যমে দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল ‘বিএনপির ধানের শীষের’ অংশগ্রহণের দিকে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। বিএনপি এবং তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট বয়কট করার দরুন অংশগ্রহণমূলক হয়নি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। ১৫৪টি আসনের এলাকাধীন জনগণকে অর্থাৎ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তখন ভোট দেয়া থেকে ক্ষমতাসীনেরা বঞ্চিত রেখেছিল। এহেন প্রেক্ষাপটে ভারত ব্যতীত কোনো দেশই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। ওই নির্বাচনে বাদ বাকি অন্যান্য আসনে ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি ছিল। দেশ-বিদেশে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই এদিক দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ অবৈধ। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এই সংসদ ও সরকার প্রায় পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন রয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশের জন্য অবশ্য এটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচন গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠাতে সহায়তা ও স্বেচ্ছাচারী শাসনের পথকে আরো মসৃণ করেছে।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে একাদশ সংসদ নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ হবে না। তখন ৫ জানুয়ারির মতো ভোটারবিহীন নির্বাচনের পুনঃদৃষ্টান্তই স্থাপিত হবে। ক্ষমতাসীন জোট তাদের পরিধি বৃদ্ধি, ২০ দলীয় জোটের শরিকদের কিছু অংশে ভাঙন সৃষ্টি এবং জাতীয় পার্টিকে ‘বিরোধী’ দলের অবস্থানে নিয়ে বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের পাঁয়তারা, যত কিছুই করুন না কেন, ভোটারবিহীন নির্বাচনই শুধু দেশকে উপহার দিতে পারবেন। ৫ জানুয়ারির কলঙ্ক ঘুচানোর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। বিএনপির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির কোনো প্রয়োজন উপলব্ধি করা যাবে না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তাদের নেত্রীর মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে তীব্র আন্দোলন থাকবে। তাই এদেশে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ অর্থই বিএনপির অংশগ্রহণ। ক্ষমতাসীনেরা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সাথে সংলাপ ও সমঝোতা প্রয়োজন নেই বলে জোর গলায় প্রচার করে যাচ্ছেন। তবে বর্তমানে তাদের গলার স্বর নিম্নমুখী। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও এমপিরা জনসভা করে নৌকায় ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। পক্ষান্তরে দেশের বেশির ভাগ জনগণকে যে দল বিএনপি প্রতিনিধিত্ব করে, তার নেতারা ধানের শীষে ভোট চেয়ে প্রচার করার তুলনায় তাদের দেশনেত্রীকে বন্দিখানা থেকে বের করাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এক/এগারোর স্বৈরসরকারের সময়ে খালেদা জিয়ার নামে দায়েরকৃত শতভাগ মিথ্যা মোকদ্দমা ক্ষমতাসীনেরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য বহাল রেখেছেন। একটিতে সাজা প্রদানের নামে তাকে কারাবন্দী রেখে আরো অনেক মিথ্যা মামলা জুড়ে দিয়ে জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এক/এগারোর পর্যায়ে সৃষ্ট একই ধরনের কয়েকটি দুর্নীতির মামলা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও ছিল। ক্ষমতাসীন সরকার শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা সব তুলে নিয়েছে। অথচ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সৃষ্ট মামলাগুলো রেখে দিয়েছে। এর কারণ নিছক রাজনৈতিক। জনগণ অবিলম্বে তার মুক্তি চাচ্ছে। কারামুক্তির বিলম্বে ক্ষমতাসীনদের এ জন্য মূল্য দিতে হবে।
আইনের দোহাই দিয়ে বেগম জিয়া রাজনৈতিক বন্দী বলে নাটক সৃষ্টি করে সরকার প্রচারে বিভোর। খালেদার বিরুদ্ধে এতিমের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মাননীয় আদালত তাকে সাজা দেননি। সাজা হয়েছে কথিত অনিয়মের কারণে। সে টাকা যথারীতি সংশ্লিষ্ট ট্রাস্টের ফান্ডের নামে ব্যাংকে জমা থেকে সুদে-আসলে কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তা জেনেশুনেও প্রচার করে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া ‘এতিমের টাকা চুরি করেছেন’। জাতির জন্য তা কত বড় দুর্ভাগ্য, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। প্রথম দিকে, সবার ধারণা ছিল খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠালেও তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে মুক্ত হয়ে আসবেন। কিন্তু সরকার কোনো অবস্থায়ই তাকে মুক্ত হতে দিচ্ছে না। ‘মাদার অব ডেমোক্র্যাসিকে’ বিনা অপরাধে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য দীর্ঘ দিন বন্দী করে রাখা হয়েছে, যা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ।
জনপ্রিয় এই নেত্রীকে কারাবন্দী রেখে দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আদৌ কি সম্ভব? উত্তর, না। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার। এখন কার্যত দেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত, ভোটের অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত। এটা মুক্তিযুদ্ধের মূল মন্ত্রের পরিপন্থী। অথচ সরকার চলছে সংসদীয় পদ্ধতির নামেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হওয়া বিশ্বে নজিরবিহীন ঘটনা। ক্ষমতাসীনদের শরিক বাম দলগুলো কার্যত গণতন্ত্র চায় না। ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন থাকা লীগের জন্য পরম সৌভাগ্য। আওয়ামী লীগ ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আরো পাঁচ বছর এবং এমনকি ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক তেলেসমাতি কাণ্ড। পুলিশি শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রের আন্দোলনকে দমন, পীড়ন, গুম, খুনসহ বিরোধী নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। গণতন্ত্রের উদ্ধারের কাণ্ডারি যে নেত্রী, তিনি আজ বন্দিখানায়। ক্ষমতাসীনেরা ঈর্ষান্বিত হয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ‘আগুন সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে তার জনপ্রিয়তাকে আঘাত করতে চাচ্ছে। খালেদা সন্ত্রাসী নন, ক্ষমতাসীনেরা জানেন, তাদের জন্য এই দেশনেত্রী অগ্নিকন্যাসম। নির্বাচনের সময়ে তার কণ্ঠ জনগণের মধ্যে অমৃতসুধার মতো মনে হবে, ক্ষমতাসীনেরা তা নিশ্চিত ভেবেই আতঙ্কিত হয়ে তাকে বন্দী রাখতে চান।
বিএনপি তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাম যত বার উচ্চারণ করে, ক্ষমতাসীনেরা তার নাম বলেন এর বহুগুণ বেশি। কারণ, ক্ষমতাসীনেরা জানেন, হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের উদ্ধারের আপসহীন নেত্রী তাদের খাঁচায় বন্দী থাকলেও দেশে তার কোটি কোটি অনুসারী। অপর দিকে, উন্নয়নের নামে চলছে লুটপাট, গুম, খুন, মাদকের নামে ক্রসফায়ারে মানুষ খুন, মানবতা ভূলুণ্ঠিত, ব্যাংক লুটপাট, দুর্নীতি, ছাত্রলীগের অত্যাচারে ছাত্র ও শিক্ষক দিশেহারা, কোটা আন্দোলনের নিরস্ত্র ছাত্র এবং শিক্ষকদের ওপর মারমুখী আক্রমণ সত্ত্বেও পুলিশের নীরব ভূমিকা, সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়া ইত্যাদি ঘটেছে। সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকে কুষ্টিয়া আদালতের প্রাঙ্গণে সন্ত্রাসীরা রক্তাক্ত জখম করা এক নজিরবিহীন ঘটনা। এই নৈরাজ্য ও অরাজকতা থেকে মুক্তি চায়। দেশের জনগণ জেগে উঠবে এবং ক্ষমতাসীনদের পতনের বাঁশি বাজাবে।
দেশে বিরাজমান অপশাসনের অবসান ঘটাতে নির্বাচন সামনে রেখে ফলপ্রসূ আন্দোলনের ছক তৈরি করতে হবে। জনগণ ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং কুশাসনের অবসান চায়। ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্য সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক তা চান না। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে, বৈরী পরিস্থিতিতে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা সরকারের কৌশল। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। বিএনপি বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সেনা মোতায়েন এবং তাদের নেত্রীকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের দাবি করছে। এই যুক্তিযুক্ত দাবি মেনে নিলে নৌকার ভরাডুবি হবে। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থে এ দাবি মেনে নেয়া প্রয়োজন। দেশবাসীর ঐকান্তিক ইচ্ছা, দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক। এর অর্থ স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসান। কিন্তু জনগণের দাবি ক্ষমতাসীনেরা মেনে নেবে না যতক্ষণ জনগণ তাদের বাধ্য করছে রাজপথের আন্দোলনে।
গণতন্ত্রকে উদ্ধারের বিকল্প নেই। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিরোধী শক্তিগুলো এক প্লাটফরমে এসে গণতন্ত্র উদ্ধারের ডাক দিয়ে রাজপথে নামা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিএনপির সাথে সব বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামলে স্বৈরশাসনের অবসান হবে নিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বৈরাচারী আইয়ুবের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য মওলানা ভাসানী নেতৃত্ব দিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। ফলে আইয়ুবের লৌহ কপাট ভেঙে যায়। গণতন্ত্র শুধু বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার প্রয়োজনে নয়, দেশের এবং জনগণের প্রয়োজনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ দেশেরই লোক। গণতন্ত্র তাদেরও প্রয়োজন। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে যে দল ক্ষমতাসীন হবে, সেটিই হবে গণতান্ত্রিক সরকার। এমন সরকার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে না। নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনে সব দল সমান সুযোগ পাবে।হ
লেখক : সিনিয়র অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া


আরো সংবাদ



premium cement