২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রসঙ্গ : উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা

-

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকেই একাদশ সংসদ নির্বাচন তথা জাতীয় নির্বাচন করবে, এটা অবধারিত। আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কোনো দল বা জোট পরপর দু’বার ক্ষমতায় যেতে পারে না। এর কারণ হলোÑ এক দিকে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি তথা লুটপাট, দলীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দুর্বৃত্তপনা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি; অন্য দিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া, মিথ্যা মামলা, জেল-জুলুম, হয়রানি, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও ধরপাকড় এবং দমনপীড়ন। উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জঙ্গিবাদের হুমকিকে রাজনীতিকীকরণ করেছে। এর সুযোগ নিয়ে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা এখনো যেন জরুরি অবস্থায় আটকে আছেন। উল্লিখিত কারণে জনগণ ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং সুযোগ পেলে বা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের ওপর মনের ঝাল মিটিয়ে নেবে। সুতরাং সরকারের মনোভাব, জনগণকে বিশ্বাস করা যায় না এবং তত্ত্বাবধায়ক কিংবা সহায়ক যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এ ধরনের সরকারের দরকার নেই! এ কারণে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দাবিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এ যেন ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠে আর জায়গা নেই বলে অন্যদের উঠতে নিষেধ করা।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, জাতি হিসেবে আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ হলেও জনগণ এত দ্রুত ১৯৯৪ থেকে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের কথা বিস্মৃত হয়নি। সেই আন্দোলনের সময় চরম নৈরাজ্য নেমে এসেছিল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রকাশ্যে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে প্রতিপক্ষের এক যুবককে হত্যা করা হয়েছিল। আর অবরোধ করে পুরো দেশ অচল করে দিয়েছিল এবং বাসে আগুন ও গানপাউডার দিয়ে মানুষ মারা হয়েছিল। আন্দোলনের অংশ ও কৌশল হিসেবে কথিত জনতার মঞ্চ এক দিকে যানবাহন চলাচলে স্থবিরতা এবং অন্য দিকে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। উল্লেখ্য, প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী এ ধরনের কোনো ফোরামে যোগদান করতে পারেন না। এহেন হঠকারী কাজ একটা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সে কারণে দেশদ্রোহিতার শামিল। জনতার মঞ্চ ছিল নেহাত একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের মঞ্চ। অন্য দিকে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ছিল এ দেশের জনগণের যথাক্রমে ভাষাগত ও জাতিগত অস্তিত্বের লড়াই।
ভাবতে অবাক লাগে, সেই আওয়ামী লীগ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামগন্ধও সহ্য করতে পারছে না। তারা ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘দানব’ বললেও এর কুশীলবদের বিচার তো করেইনি, বরং একজনকে বিদেশে যাওয়ার জন্য সেফ প্যাসেজ দিয়েছে এবং আরেকজনকে প্রাইস পোস্টিং দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিল। এটা এক ধরনের দ্বিচারিতা। এর সঙ্গে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের যোগসূত্র রয়েছে বলে গুঞ্জন আছে। এখন সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে, কিন্তু ১৯৯৬ সালেও তো সংবিধান ছিল। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য সংবিধান সংশোধনে বাধ্য করা হয়েছিল বিএনপিকে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য অতীতের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মন্দ বলা যায় না। এক-এগারোর আগের সব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। উচ্চ আদালত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের অধীনে করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ) সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি উচ্চ আদালতের মতের অনুরূপ সুপারিশ করলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা পাল্টে যায় এবং তার অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে দেয়া হলো।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় থেকে এবং সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার অতীত অভিজ্ঞতা মোটেও শুভ নয়। বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের অধীনে অতীতে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচন, যে নির্বাচনে বিএনপি সব ক’টিতে জয়ী হয়। সুতরাং ‘অংশগ্রহণমূলক’ হওয়াই শুধু যথেষ্ট নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়াও আবশ্যক।
প্রধানমন্ত্রী ও তার দল সংবিধান কার্ড খেলার পর হাল আমলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার লক্ষ্যে মহাসড়কে ওঠা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ধুয়া তুলেছেন। ভাবখানা এমন, উন্নয়নে শুধু তাদেরই পারঙ্গমতা আছে, অন্য কোনো দলের নেই। এর মধ্যে একটা আমিত্ব এবং আত্মম্ভরিতার ভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় অবদান আছে অতীতে ক্ষমতায় ছিল এমন সব দলের। উন্নয়ন কারো একচেটিয়া অধিকার ও পারদর্শিতার বিষয় হতে পারে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে তো বর্তমান সরকারের দৃঢ় উক্তি (না দম্ভোক্তি?) অনুযায়ী তাদেরকে অনন্তকাল ক্ষমতায় রাখতে ও থাকতে হয়। আর সে ক্ষেত্রে তো ভোটারবিহীন নির্বাচন কিংবা ক্ষমতা জবরদখল সবই বৈধ করতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, উন্নয়ন বলতে শুধু নির্মাণকাজ বা বস্তুগত উন্নয়নকে বোঝায় না। গণতন্ত্র তথা আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা থাকলে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মুক্ত গণমাধ্যম না থাকলে সার্বিক ও প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। ভৌত উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও উন্নয়ন জরুরি। অন্যথায় অন্য সব উন্নয়ন টেকসই হয় না। গণতন্ত্রের উন্নয়ন হলে এর অনিবার্য ফল হিসেবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটবে।
ক্ষমতাসীনদের ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে, তারা শুধু ক্ষমতা উপভোগই করছেন না, আস্বাদনও করছেন। এ প্রসঙ্গে Freedom at Midnight বই থেকে আওয়ামী লীগের এক সময়ের বিখ্যাত সভাপতি মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক দর্শন-সংক্রান্ত একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছিÑ His political philosophy was simple, once a man had been elected to office, there was never any reason to leave it. (Freedom at Midnight-Dominique Lapierre and Larry Collins, page 275)। বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাও এমন রাজনৈতিক মন্ত্রে পুরোপুরি দীক্ষিত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সুতরাং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করাকে নিদান হিসেবে ধরে নিয়ে কালনিরবধি ক্ষমতার আস্বাদন করতে তারা দৃঢ়সঙ্কল্প। আর এ কারণেই তাদের ক্ষমতায় থাকার যত ফন্দিফিকির এবং বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়াকে জেলে পুরে সরকারি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আগাম ভোট চাওয়া শুরু।
গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলো অধিকারের সমতা, যা এ দেশে হরণ করা হয়েছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ক্ষমতার গুরুতর অসাম্যের মধ্যে নিহিত থাকে অবিচার (তর্কপ্রিয় ভারতীয়- অমর্ত্য সেন, পৃষ্ঠা : ১১৫)। প্রসঙ্গত বলতে হয়, গণতন্ত্র আজ রাহুগ্রস্ত। প্রশাসন ও পুলিশ দলীয় ব্যাধিগ্রস্ত এবং সুশাসন নির্বাসিত। নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণ আস্থা রাখতে পারছে না। নির্বাচনকে মাথায় রেখে সংসদ সদস্যদের ইচ্ছামাফিক প্রকল্প গ্রহণ করা এবং নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া ও ভোটকেন্দ্রে সেনা মোতায়েনের দাবির বিরোধিতা করায় বিশিষ্টজনেরা বলছেন, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। সিটি নির্বাচনগুলোর চালচিত্র থেকেই তা স্পষ্ট। এ অবস্থায় আগামী সংসদ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, এমন আশা সুদূরপরাহত বলেই আশঙ্কা হয়।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

 


আরো সংবাদ



premium cement