২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শত্র“ নয়

-

বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো, বহু দলের ও মতের প্রতিযোগিতা। জাতীয় স্বার্থে এবং জাতির বৃহত্তর কল্যাণেই এটা প্রয়োজন, কারণ জাতীয় কল্যাণসাধনই গণতন্ত্রচর্চার মূল লক্ষ্য। আরেকটি কারণে এ প্রতিযোগিতা প্রয়োজন, তা হলোÑ জনগণের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণে কোনো দল কোনো দলকে অতিক্রম করে যেতে পারে, সেটাও দেশের জনগণের বিচার্য বিষয়। জাতীয় জীবনে ও রাজনীতিতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে দল এগিয়ে যায়, সেই দলই জনগণের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে। গণতন্ত্রে একটি রাজনৈতিক দলের জনগণের আস্থা অর্জনই সাফল্যের চাবিকাঠি। কোনো দল ক্ষমতায় গিয়ে যদি সে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করে বা সে প্রতিযোগিতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, তবে যে শুধু জনকল্যাণই ব্যাহত হয় না; জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার খর্ব হয়েছে বলেও ধরে নিতে হয়। একটি রাজনৈতিক দলের কাছে, জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াসই জনগণের মূল প্রত্যাশা। সেটাই ক্ষমতাসীন দলের কাছে জনগণের মুখ্য দাবি হয়ে ওঠে। অন্যথায় দেশে দেশে মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিত না। জেলে ফ্রি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাই বলে কারাবাস কারো কাম্য হয় না। মুক্ত আকাশ-বাতাসে স্বাধীন অধিকার নিয়ে মানুষ বাঁচতে চায়। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়Ñ ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,/ কে বাঁচিতে চায়,/ দাসত্বের শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে,/ কে পরিবে পায়।’ এ ছাড়া সোনার খাঁচার বাবুই পাখি ও বনের বাবুই পাখির কথোপকথনের কাহিনীও আমাদের অনেকেরই জানা। কাজেই যে সিস্টেম মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেয় না, তা গণতন্ত্র নয় এবং এটা কোনো দেশের মানুষ গ্রহণ করে না; হাজার বৈষয়িক কল্যাণ সাধন করলেও নয়। জনগণের কাছে ভাতের অধিকারের সাথে স্বাধীনতা ও অধিকারই অগ্রগণ্য।
জনগণের অধিকার হরণ করে দেশের ‘ব্যাপক কল্যাণ’ সাধন করেও কোনো দল দাবি করতে পারে না যে, ‘আমরা যেহেতু দেশের অনেক উপকার করেছি, সুতরাং আমরা ছাড়া আর কারো ক্ষমতায় আসার প্রয়োজন বা অধিকার নেই।’ কায়দাকানুন করে জনগণের স্বাধীন বিচারের অধিকার এভাবে খর্ব করা কোনোমতেই কাম্য নয়। একই দল যদি কোনো দেশে বারবার ক্ষমতায় আসে, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, যদি তা জনগণের স্বাধীন বিচারের ভিত্তিতে ঘটে। তাই গণতন্ত্রে জনগণের এই স্বাধীন নির্বাচনের পথটি উন্মুক্ত রাখার রেওয়াজ প্রতিষ্ঠা করাও ক্ষমতাসীন সরকার এবং অন্যান্য দলের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন দল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আরোহণের পথ সদা উন্মুক্ত রাখে, চূড়ান্ত বিচারে তা-ই জনহিতকর ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। এই ব্যবস্থায় জনগণ চাইলে কোনো দলকে বারবার ক্ষমতায় বসাতে পারে কিংবা বিদায় করতে পারে। তখন আর কারো কোনো অভিযোগ থাকে না। কোনো পক্ষ অভিযোগ করলেও তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। সে অভিযোগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমাতে অহেতুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ডেকে এনে তাদের ‘শায়েস্তা’ করতে হয় না। এটাই গণতন্ত্রের রীতি।
এর মানে এই নয় যে, সুষ্ঠু নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা কোনো দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন হবে না। শাসক দল যতই চৌকস হোক না কেন, তার ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবহির্ভূত দলগুলোর দায়িত্ব হলো আলোচনা-সমালোচনা করা; প্রয়োজন বোধে জাতীয় ও জনগণের স্বার্থে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে বুঝিয়ে দেয়া যে, তারা ভুল করছে। জনগণের ওপর সরকারের উৎপীড়ন-নিপীড়ন থাকলে সে আন্দোলনের সাথে জনগণ শামিল হয় এবং ক্ষমতাসীন দল সংশোধিত হতে বাধ্য হয় নতুবা ক্ষমতা ছাড়তে হয়। পেটোয়া বাহিনী দিয়ে সে আন্দোলন পণ্ড করা কোনোমতেই মেনে নেয়া যায় না। ছলে-বলে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার কৌশল গ্রহণ করা গণতন্ত্রের রীতি নয়। এ ক্ষেত্রে ব্রিটেনের টনি ব্লেয়ার এবং ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর কথা উল্লেখ করা যায়। আরো অতীতে গেলে, এমনকি ব্রিটেনের পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ী স্যার উইনস্টন চার্চিলের কথাও উল্লেখ করা যায়। যদি তারা গণরায়ে সাড়া না দিতেন তবে বিপর্যয় ঘটে যেত। প্রহসনের নির্বাচনের দায় সরকার না নিয়ে আজো বিরোধীদের যাবতীয় সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে উৎপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে এ দেশে। বর্তমান সরকারপ্রধানও বিরোধী দলে থাকাকালে হত্যার টার্গেট হয়েছিলেন, যা কাম্য নয়। বিরোধী দল রাজনীতিতে জনগণের পক্ষে ওয়াচ-ডগ হিসেবে কাজ করে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাই সরকারবিরোধীদের কোনো প্রকারেই শত্র“ ভাবা যায় না। তা না হলে গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র থাকে না। দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রয়োজনে শাসকদের বিরোধিতা অপরিহার্য। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে, ‘আল্লাহ তায়ালা যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে এই ভূখণ্ড ফেতনা ফাসাদে ভরে যেত; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকুলের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল।’ (সূরা বাকারা-২৫১)। এই ঐশীবাণীকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূল নিয়ামক বা চালিকাশক্তি বলে ধরে নেয়া যায়। বাংলাদেশে গণন্ত্রের এই মূল উদ্দেশ্য, আদর্শ ও রীতি চালু আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের বিদ্যমান গণতন্ত্রের স্বরূপ একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিবৃত করা যায়। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘চেঙ্গিস খান’ নামক একটি ইংরেজি ছায়াচিত্র দেখেছিলাম। এর একটি দৃশ্যে দেখানো হলো, চেঙ্গিস খানের গলায় গরুর গাড়ির চাকার মতো গোলাকৃতির কাঠের একটি অতিকায় বেড়ি পরিয়ে তাকে একটি পুকুরে নামিয়ে দিয়ে বলা হলোÑ ‘এবার সাঁতরাও’। বেচারা চেঙ্গিস বহু কষ্টে গলায় বেড়ির বোঝাসমেত পুকুরের পাড়ে উঠে এসে বসে পড়ল; সাঁতরাতে পারল না। কারণ এ অবস্থায় কেউ কি সাঁতরাতে পারে? আজ বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর অবস্থাও তাই। ‘সরকারি দল’ নিজেদের সুবিধামাফিক সংবিধান সংশোধন করে চেঙ্গিস খানের গলার বেড়ির মতো বিরোধীদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বলছে, ‘পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, যাদের ইচ্ছা হয়, আসুন। না আসলে আমাদের কিছু করার নেই।’ আজব কথা। জনগণ এবং বিরোধী দল কি এতই বোকা যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের এই প্রতিবন্ধক বেড়িটি তাদের চোখে পড়বে না? নিজেদের বিজয়ের সব ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী দলের প্রতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের এই আহ্বান গণতান্ত্রিক নয়; তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাধারণ শিক্ষার্থীও ঠাওর করতে পারে। বহু পোড়খাওয়া রাজনীতিক ও সাধারণ জনগণ তো পারেই। সরকারি দল কি এটা বোঝে না? বোঝে। তবে তাদের সর্বময় ক্ষমতা চাই। তাই এই পাকাপোক্ত ব্যবস্থা। বিরোধী দলকে নির্বাচনী বেড়িমুক্ত করে দিয়ে যদি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায়ে আবারো ক্ষমতায় আসার পথ থাকে, তবে কারো কিছু বলার নেই। কারণ, এটাই গণতন্ত্র। সরকার তাদের ভাষায় এত ‘উন্নয়নমূলক কাজ’ করার পরও সে ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছে না। এতেই বুঝা যায় তাদের উন্নয়নের দাবি কতটা লোক ঠকানো বা প্রচারসর্বস্ব। বলা যায় সরকারের উন্নয়ন প্রচারণা কেবলই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। যে দলের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা এসেছে, তারাই যদি জনগণকে এত ভয় পায়, তবে আর বোঝার বাকি থাকে না যে, তাদের হাতে জনগণ আসলে ঠকেছে। সেটা সম্ভবত সরকারও টের পেয়েছে। তাই এত সতর্কতা, জনগণকে এত ভয়।
আমাদের রাজনীতিকেরা জনসেবার কথা বলে থাকেন। অভিজ্ঞতা বলে জনসেবা নয়, ক্ষমতার লোভ ও লুটপাটই আমাদের দেশের রাজনীতিকদের বেশির ভাগের কাছে মুখ্য। তাই কেউ ক্ষমতা হারাতে চান না। সবাই ক্ষমতায় যেতে ও তা আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা এটাই দেখে আসছি। সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতার বাইরে থেকেও জনসেবা করা যায়। এতে তুষ্ট হয়ে জনগণ বিরোধী দলকে অধিকতর সেবা পাওয়ার জন্য স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসায়। আবার সরকারি দল সফল হলে তাকেই পুনর্বার সুযোগ দেয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতার লোভে সে পরিবেশটাই ভণ্ডুল করে দিয়েছে। সরকার স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনকে এত ভয় পাচ্ছে কেন? সরকারপ্রধান কথায় কথায় প্রতিপক্ষকে ‘চোর’ বলেন। কথায় আছেÑ ‘আকলমন্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি হায়।’ তাই নিদেনপক্ষে ব্যাংকলুটের প্রসঙ্গ তুলে এই অগণতান্ত্রিক সরকারের বিষয়ে বলাই যথেষ্ট। হ
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা

 


আরো সংবাদ



premium cement