২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বিদেশে গেলেই মানুষের ভাগ্য খোলে না

আত্মপক্ষ
-

আমি একসময় কিছু দিনের জন্য ছাত্র হিসেবে ইউরোপে ছিলাম। এ সময় হঠাৎ একদিন আমার সাথে আমাদের দেশের একজন খুব উচ্চপদস্থ কর্মচারীর দেখা। আমাদের মধ্যে বিবিধ প্রসঙ্গে বেশ কিছু কথা হয়। একসময় তিনি আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেন, আমার উচিত হবে বিদেশে থেকে যাওয়া। দেশে গিয়ে কোনো উপযুক্ত চাকরি আমি পাব না। তাকে আমি বলি, তবু আমি দেশে ফিরব। কেননা বিদেশ, বিদেশই। আমি এর ইতিহাসের অংশ নই। ভাষা সংস্কৃতির দিক থেকে এর সাথে তেমন নৈকট্য কোনো দিনই গড়ে তুলতে পারব না। তা ছাড়া আমার গায়ের রঙ এদের থেকে ভিন্ন। সারা ইউরোপজুড়েই কম বেশি বিরাজ করছে, ওই যাকে বলে বর্ণবৈষম্য। এ ছাড়া ধর্ম-বিশ্বাসজনিত কারণেও আছে বেশ কিছু বিরোধ। এত সব বিরোধের সমন্বয় করার মতো শক্তি আমার নেই। তাই ফিরব নিজের দেশে। অবশ্য ভারত থেকে যাওয়া কিছু মুসলমান ছাত্রের সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল, তাদের অবস্থা নিজ দেশে হয়ে পড়েছে খুবই সঙ্কটজনক। কেননা ভারতে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। আবার অন্যত্রও তারা হলেন বিদেশী। তারা আসলে হয়ে পড়েছেন স্বদেশহারা ব্যক্তি। ভুগছেন এক অনিকেত চেতনায়। একদিন কলকাতা থেকে যাওয়া একজন বাংলাভাষী হিন্দু মহিলার সাথে আলাপ হয়। তিনি বলেন, বিদেশে এসে তিনি বাস করছেন অনেকদিন, কিন্তু তিনি কোনো স্থায়ী চাকরি পাননি। বিদেশে এসেছিলেন পড়াশোনা করতে। কিন্তু ফিরি ফিরি করেও ফেরা হয়নি দেশে। কিন্তু এখন দেশে ফিরে যে কোনো চাকরি পাবেন, এমন সম্ভাবনাও কম। অন্য দিকে বয়স হয়েছে, বিয়ে থা করে সংসারী হবেন এমনও ভাবতে পারছেন না। ছেলেদের চাইতে দেশছাড়া হলে, মেয়েরা পড়েন অনেক বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে।
কদিন আগে (১২ জুন ২০১৮) প্রথম আলো কাগজে একটি সংবাদ নিবন্ধ পড়লাম। যার বিষয়বস্তু হলো, গত কয়েক মাসে সৌদি আরব থেকে কয়েক শ’ নারীশ্রমিক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এই প্রবন্ধটির নাম ‘তাঁরা মানুষ এবং নারী, ক্রীতদাসী নন।’ প্রবন্ধটি লিখেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। যিনি হলেন এদেশের একজন খ্যাতনামা লেখক ও সাংবাদিক। ঘটনাটি যেহেতু ঘটেছে সৌদি আরবে, তাই অনেকের কাছে মনে হতে পারে, ইসলামে নারীর মর্যাদা নেই। তাই এরকম ঘটনা ঘটতে পেরেছে। কিন্তু ইসলামের সাথে এই ঘটনার কোনো যোগাযোগ নেই। মক্কায় সারা বিশ্ব থেকে মুসলিম নারীরা যান হজ করতে। নারীদের ক্ষেত্রে হজ করতে যাওয়ার নিয়ম হচ্ছে, তাদের সাথে তাদের স্বামী অথবা এমন কোনো আত্মীয় যেতে হবে, যার সাথে তাদের কোনো বিবাহ হতে পারে না। একা নারীরা হজ করতে যেতে পারেন না। সৌদি আরবের একটি নারীপ্রতিষ্ঠান বলেছে, সে দেশে কোনো নারীর একা কাজ করতে আসা উচিত নয়। তাদের কাজ করতে আসা উচিত স্বামী-স্ত্রী একত্রে। হজের সময় নারী-পুরুষ একসাথে কাবা শরিফ সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। এই প্রদক্ষিণ করার সময় নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা চলে না। কিন্তু তবুও হজ-ব্রত পালনের সময় ঘটে না কোনো যৌন-দুরাচার। হজের সময় কাবাগৃহের কাছে অথবা সন্নিকটে কোনো পশুহত্যা চলে না। অনুসরণ করা হয় অহিংসা পরমধর্মের নীতি। হজ করার সময় কোনো সেলাই করা জামা পরা চলে না। আগে পুরুষকে হজের সময় মস্তক মুণ্ডায়ন করতে হতো। কিন্তু এখন চুল ছোট করে কাটলেই চলে। হজের ওপর প্রভাব পড়েছে বৌদ্ধ ধর্মের। কেন এই প্রভাব পড়েছে, তা হয়ে আছে একটি গবেষণারই বিষয়। কিন্তু এখন বিদেশ থেকে নারীরা সৌদি আরবে যাচ্ছেন একা চাকরি করতে। বিত্ত অর্জনের লক্ষ্যে; তীর্থ করতে নয়। আর তাই তাদের জীবনে ঘটছে ভয়াবহ লাঞ্ছনা। ইসলামে দাস প্রথা তুলে দেয়া হয়নি। কিন্তু দাসদের সাথে করতে বলা হয়েছে খুবই মানবিক ব্যবহার। বলা হয়েছে, দাসদের মুক্ত করে দেয়া হলো সবচেয়ে পুণ্যের কাজ। ইসলামে ক্রীতদাসীদের সাথেও করতে বলা হয়েছে খুবই সদয় ব্যবহার। ইসলামে ক্রীতদাসীদের গণিকা ব্যবসায় নিয়োজিত করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে একটি বহুলপ্রচলিত হাদিস হলোÑ আল্লাহ সবচেয়ে খুশি হন ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিলে। আর সবচেয়ে দুঃখিত হন স্ত্রীকে তালাক দিলে, যদিও তা হয় আইনসম্মত। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল (আরবিতে অরেস্তু) বলেছেন, দাসপ্রথা স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলামে তা বলা হয়নি। যদিও মুসলিম বিশ্বে এরিস্টটলকে বলা হয়েছে জ্ঞানীদের গুরু (আল-মুয়াল্লিম আল-আওয়াল)। সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, ‘তারা মানুষ এবং নারী, ক্রীতদাসী নন। কিন্তু ক্রীতদাসীদের সাথেও দুর্ব্যবহার করতে বলা হয়নি ইসলামে। এ কথাটি মনে রাখলে আমরা এক্ষেত্রে কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হবো না।
ছেলে আর মেয়েদের ভূমিকা কোনো মানবসমাজে কোনোদিন এক রকম ছিল না। মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানবশিশু জন্মের পর মাতৃদুগ্ধ পান করে বাঁচে। নারীরা গৃহকর্ম করেছেন। তার একটা কারণ, মানব শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান। এটা পুরুষের কোনো ষড়যন্ত্রের ফল নয়। মেয়েরা কেবল গৃহকর্ম করেননি, গৃহের চারপাশে করেছেন শাকসবজির আবাদ। কৃষিকর্মের সূচনা হতে পেরেছে মেয়েদের প্রচেষ্টারই মাধ্যমে। পুরুষ গিয়েছেন মাছ ধরতে; মেয়েরা যাননি। প্রথমে মৎস্যশিকারি মানুষ গ্রাম গড়েছেন নদীর ধারে অথবা সমুদ্র তীরে। এভাবে গড়ে উঠেছে গ্রাম বা স্থায়ী জনপদ। এর মধ্যে পুরুষের কোনো ষড়যন্ত্র দেখতে যাওয়া একেবারেই ভুল। কিন্তু অনেক বামচিন্তক বলেন যে, মেয়েদের গৃহবন্দী করেছেন পুরুষেরা। মেয়েরা করেছেন ঘরের কাজ। আর পুরুষরা করেছেন বাইরের কাজ। এটা বাস্তব কারণেই হয়ে উঠেছে। এটা কেউ কোনো পরিকল্পনা করে করেছেন এমন নয়। শ্রমবিভাজন অর্থনীতির অন্যতম গোড়ার কথা। ঘরের কাজকে খাটো করে দেখার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। নারী গৃহকর্মে নিয়োজিত থেকেছেন বলেই পুরুষেরা করতে পেরেছেন বাইরে মৎস্যশিকার। কোনো একজন চিন্তক লেখকের লেখায় পড়েছিলাম, মেয়েদের রান্নাঘরমুখী করে তোলা থেকে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু কেন? মানুষ রান্না করে খায়। রান্না দিয়ে হলো তার সভ্যতার অথবা সংস্কৃতির বিশেষ পরিচয়। তাকে বাদ দিলে তার সভ্যতা ও সংস্কৃৃতির অনেকখানি বাদ পড়ে যায়। মানুষ পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছে প্রধানত সন্তান প্রতিপালনের জন্য। আর তাই চেয়েছে, নারীরা হন সুমাতা ও সুগৃহিণী। আজ এই আদর্শটিকে সম্পূর্ণই বদলে দেয়ার চেষ্টা চলেছে। ফলে সমাজজীবনে ঘটতে পারছে বিশেষ বিশৃঙ্খলা। আমরা বিত্ত অর্জনের জন্য নারীদের পাঠাচ্ছি একা, দূর বিদেশে; তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করেই। আমাদের দেশে পরিবেশবাদীরা সুন্দরবনের বাঘ রক্ষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু ভাবছেন না, নিজেদের দেশের নারীদের দূর বিদেশে একা গিয়ে চাকরি করার বিপদ সম্পর্কে। এরা অনেকে বলছেন, দেশে পর্যটন শিল্প বাড়াতে হবে। কিন্তু অনেক দেশে পর্যটন শিল্প হয়ে উঠেছে সমাজজীবনের বিশেষ ক্ষতির কারণ। কেননা, এর ফলে নারীরা অনেকেই হয়ে উঠেছেন বারবনিতা। আমরা আমাদের দেশে পরিবার ও তার ওপর নির্ভরশীল সমাজজীবনকে রক্ষার চাইতে জীবজন্তু রক্ষার প্রতি জোর দিচ্ছি যেন বেশি। আমাদের দেশের নারীদের দুর্গতির একটা কারণ হলোÑ নারী স্বাধীনতার ভ্রান্ত ধারণা। যার নিরসন হয়ে পড়েছে জরুরি।
বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ যাচ্ছেন ইউরোপে। এদের লক্ষ্য স্বচ্ছ অর্থনৈতিক জীবন লাভ। কিন্তু তাদের অনেকের জীবনেই তা জুটছে না। নেমে আসছে পরম দুঃখ-যন্ত্রণা। অনেক বাংলাদেশী ইউরোপে অভিবাসী হতে গিয়ে মরছেন সমুদ্রে ডুবে। আবার অনেকে ইউরোপে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার ফলে করছেন আত্মহত্যা। ১৯ জুন ছিল আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস। এই দিবসের আলোচনায় এসব ঘটনার কথা উঠে এসেছে (প্রথম আলো, ২১ জুন ২০১৮)। প্রথম কথা, এরা শরণার্থী বলে বিবেচিত হতে পারে না। কেননা এরা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপে যাচ্ছেন না। যাচ্ছেন উন্নত অর্থনৈতিক জীবনের স্বপ্নে। কিন্তু সেটা হতে পারছে না। এভাবে বিদেশে মানুষ যাওয়া যতদূর সম্ভব বন্ধ করতে হবে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩

সকল