১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন

-

প্রফেসর কাজী জাকের হোসেনের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী ২১ জুন। স্যারের লেখা বই ‘বিশ^জুড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসের জন্য তৃতীয় বিশে^র কাছে ঔপনিবেশিক শক্তিকে ক্ষমা চাইতে হবে’। বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে এ লেখা শুরু করছি। ‘প্রাকৃতিক পরিবেশের কথাই বলতে যাচ্ছি। অনেক বক্তৃতা শুনি বা পোস্টার দেখি যাতে লেখা থাকেÑ ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। শুনতে ভালোই লাগে। যেকোনো গাছ লাগালেই পরিবেশ বাঁচে না। আমাদের বলতে হবে, দেশী গাছ লাগান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচান। ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ’ বলতে গেলে অপ্রাকৃতিক পরিবেশের কথা এসে যায়। পার্থক্যটা আমাদের অত্যন্ত গভীরভাবে বুঝতে হবে। আমাদের দেশে যেকোনো গাছ লাগালেই যদি প্রাকৃতিক পরিবেশ বেঁচে যেত, তাহলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা নয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়ার প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবেশ বিভিন্ন ধরনের। কোনো একটি স্থানের বায়ু, পানি, তাপ, মাটির ধরন ও গুণাগুণের ভিত্তিতে সে স্থানে উদ্ভিদ জন্মে। এটাই নিয়ম এবং এটাই প্রাকৃতিক। একইভাবে উদ্ভিদের ধরনের ওপর ভিত্তি করে সেখানে প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। আলো, বায়ু, আবহাওয়া, পানি ও মাটির সমন্বয়ে সে স্থানে অজৈব পরিবেশ গড়ে ওঠে, তার ওপর নির্ভর করে যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবির্ভাব হয়, তাকে বলা হয় জৈব পরিবেশ। এ অজৈব ও জৈব পরিবেশে মুক্তভাবে সে স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলে। পরিবেশবিদ্যায় ‘পরিবেশগত পরামর্শ’ বলে একটি কথা আছে। সংক্ষেপে বলা যায়, উদ্ভিদহীন একটি স্থানে যখন কোনো উদ্ভিদ জন্মায়, তখন পরিবেশে পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ ওই গাছের কারণে পরিবেশ ভিন্ন রূপ নিয়েছে, যেখানে আগের গাছ টিকতে পারে না এবং ভিন্ন এক গাছ জন্মায়। একইভাবে ভিন্ন এক প্রাণীর উদ্ভব হয়। এ ধরনের পরিবর্তন কয়েকবার ঘটার পর শেষ পর্যায়ে যে উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখা দেয়, তাকে বলা হয় ‘কাইমেটিক কাইমেক্স’ বা চূড়ান্ত পর্যায়। অজৈব পরিবেশগত কোনো বিপর্যয় দেখা না দিলে একটি স্থানের জৈব পরিবেশ সঠিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে সে স্থানে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কৃত্রিম উপায়ে সুন্দরবনের অজৈব পরিবেশের পরিবর্তন না ঘটালে সেখানে গোলপাতা থাকবে, তারপর পরিবর্তন হতে হতে সুন্দরী গাছ দেখা দেবে, হরিণ থাকবে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার থাকবে। কৃত্রিমভাবে যদি অজৈব পরিবেশের পরিবর্তন করে ফেলে, তবে সব ওলটপালট এবং বিলীন হয়ে যাবে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে মিঠাপানির প্রবাহের ভয়াবহ ঘাটতি দেখা দেয়ার ফলে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে কী কী ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটতে পারে, তা অজানা নয় মোটেও। মজার কথা, বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়াম উপলক্ষে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা ঢাকা এলে বিভিন্ন এলাকায় বেড়াতে যেতে চান। এটা স্বাভাবিক। আমরাও সে দেশে গেলে এভাবে কোনো জায়গা দেখতে যেতে চাই এবং তারা যথাসাধ্য সে ব্যবস্থা করেন। আমরাও তাদের আশা পূর্ণ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু যদি বলিÑ চলুন, রাজশাহী ঘুরে আসি। দেখবেন, গঙ্গা, তথা পদ্মার বুক ফেটে কেমন চৌচির হয়ে গেছে। আরো দেখবেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে ট্রাক-বাস ছুটে চলছে এবং গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। এ কথা শুনলেই তারা করজোড়ে বলেনÑ দোহাই দাদা, ওদিকে যেতে বলবেন না...। এ কথার রহস্য পাঠক নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন।”
বইটিতে তিনি জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুনের উদ্দেশে কিছু কথা লিখেছিলেন। প্রথমেই তিনি ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ শিরোনামে যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলো, তিনি পৃথিবীর প্রায় ৩৫টি দেশ ভ্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে যে উপলব্ধি অর্জন করেছিলেন এবং পৃথিবীর ইতিহাস পড়ে যা জেনেছিলেন, তা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন ওই ৩৫টি দেশ ভ্রমণে শিক্ষা, কনফারেন্স, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের কারণে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতার কথা। তার সুদীর্ঘ জীবনের গবেষণার ফলাফলও উঠে এসেছে। তার প্রকাশভঙ্গির মাঝ থেকে বেরিয়ে আসছে, যেকোনো গাছ লাগালেই পরিবেশ বাঁচে না। তিনি সব সময়ই বলতেন- দেশীয় ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছ লাগান, তবে একক কোনো গাছ নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন তা হুবহু এখানে দেয়া হলোÑ ‘ আমাদের প্রাণী জগৎ ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্রিটেন কিভাবে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তা নিয়ে কাউকে কথা বলতে শুনি না। আসলে ব্যাপারটা কী ? উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের অনেকেই বোধ করি, এ নিয়ে মাথা ঘামান না। কারণ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম. সিলেট বা মধুপুর বনাঞ্চলের প্রায় ৮০ শতাংশ যে কৃত্রিম বন; তারা হয়তো ভাবেন না।
প্রথমেই প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করেছি। মনে হচ্ছে, অনেক উদ্ভিদবিজ্ঞানী অর্থকরী যেকোনো গাছ হলেই তাকে মেনে নিতে পারেন। কিন্তু আমরা প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা তা পারি না। সবাই জানি, একস্থানের প্রাণী স্থানীয় উদ্ভিদের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু স্থানীয় প্রাণী স্থানীয় উদ্ভিদের সাথে হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তনের ফলে উদ্ভিদের ওপর একান্ত নির্ভরশীল। তাই যে উদ্ভিদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যেসব প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে, সে উদ্ভিদ না হলে সেসব প্রাণী টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং আমগাছটা কেটে ফেলে সেখানে বহু মূল্যবান মেহগনি লাগিয়ে দিলে চমৎকার কাঠ হয়তো পাবেন; কিন্তু সে আম গাছকে আশ্রয় করে যেসব কীটপতঙ্গ, পাখি ও পশু বেঁচেছিল; সেগুলো ওই অচেনা গাছ থেকে বাঁচার জন্য কোনো সাহায্য পাবে না। যদি বাড়িতে দুÑচারটি মেহগনি লাগান, আর সব যদি দেশী গাছ থাকে; তবে তেমন সমস্যা হবে না। কিন্তু বাড়িজুড়ে যদি মেহগনি, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি বিদেশী গাছ লাগান এবং সারা দেশে যদি ওইসব গাছ দিয়ে চমৎকার বনাঞ্চল গড়ে তোলেন, তবে সুন্দর বাগান পাবেন। কিন্তু প্রাণীরা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। এখন সেটাই হচ্ছে। অনেক গাছ আছে, যার পরাগায়ন কীটপতঙ্গ ও পশুপাখি দিয়েই হয়; সেসব গাছ উৎপাটন করলে আপনার বাগানটি কেমন দেখাবে?”
এ ছাড়াও তিনি সব সময় বুঝাতে চাইতেন যে, আমাদের দেশে নানা রকম ফলের গাছ রয়েছে যা থেকে আমরা তথা প্রাণিকুল অনেক সুবিধা পেয়ে থাকি। যেমন ফল, কাঠ, ছায়া, আশ্রয়স্থল প্রভৃতি। উপরন্তু সার্বিক পরিবেশের সুস্থতাও বজায় থাকছে। আমাদের দেশে প্রায় ৪৫ প্রজাতির কাঠের গাছ রয়েছে; রয়েছে অনেক প্রজাতির ঔষধি গাছ। ঝোপঝাড় লতা ঘাসকেও অবজ্ঞা করলে চলবে না। সব মিলিয়েই সুস্থ আমাদের পরিবেশ। শুধুমাত্র কাঠের গাছ লাগালে কাঠ পাওয়া যাবে, মানে একের ভেতর এক এবং এটা একক পদ্ধতি যা পরিবেশের সুস্থতা রক্ষা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যদি বিদেশী গাছ হয়, যেমন মেহগনি, ইউক্যালিপটাস, অ্যাকাশিয়া প্রভৃতিÑ তা হলেতো সব শেষ! পরিবেশের ধ্বংস অনিবার্য। সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের সর্বনাশ প্রথমে আমরা করিনি; করেছে কারা? ওরা বিতাড়িত হওয়ার পরেও এখনো চলছে এ ধ্বংসযজ্ঞ ! এর কারণ অজ্ঞতা বা বর্বরতা এবং আমাদের অসততা ও লোভ। বিপুল জনসংখ্যার দেশ আমাদের। আধুনিক বিশে^ জনসংখ্যা কোনো সমস্যা নয়। এতটুকুন এই দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ যদি না খেয়ে না মরে, তা হলে দুঃখ কোথায়? চাইলে সবই সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেম। নইলে যেমন চলছে তেমনই চলবে। পৃথিবীতে কোনো সভ্য জাতি কি নিজের দেশের ক্ষতি করে? তারা কি ভূমি দখল, বাড়ি দখল, পাহাড় দখল, পার্ক দখল, খাল দখল, মাদক ব্যবসা, গাছ কাটা, পাহাড় কাটা, চোরাকারবার, এমনকি প্রশ্ন ফাঁসের মতো দস্যু বৃত্তির মাধ্যমে পয়সা অর্জন করে বিদেশে সেকেন্ড হোম কিনছে? সুইস ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছে? এত ক্ষুদ্র একটি দেশে কে কাকে না চেনে? আন্তরিকভাবে চাইলে কি এসব নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়?
এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পরিবেশ রক্ষা সূচকে বিশে^র ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯তম। শুধু আফ্রিকার দারিদ্রপীড়িত দেশ বুরুন্ডি এ তালিকায় বাংলাদেশের নিচে রয়েছে। তা হলে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব কেন দেয়া হচ্ছে না? আশা করছি, দুর্বৃত্তদের ঠেকানোর মাধ্যমে পরিবেশরক্ষার উদ্যোগ নেয়া হবে। এখন গাছ লাগানোর মওসুম। আমরা কী গাছ লাগাব, সে উদ্দেশ্যেই স্যারের বইয়ের উদ্ধৃতিগুলো তুলে ধরা হলো।হ
প্রফেসর কাজী জাকের হোসেনের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
প্রফেসর প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
মোস্তাফিজের বিকল্প ভাবছে চেন্নাই, দলে ভিড়িয়েছে এক ইংলিশ পেসার বিদেশ যাওয়া হলো না আশরাফুলের, বাসচাপায় মামাসহ নিহত ‘সন্ত্রাসীদের ঘরে ঢুকে মারা’ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া মাতৃভূমি রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য : সেনাপ্রধান ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সাথে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ১ হাজার টাকার জন্য পেশাদার ছিনতাইকারীরা খুন করে ভ্যানচালক হারুনকে দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় : মতিউর রহমান আকন্দ টানা ১১ জয়ে ডিপিএলের প্রথম পর্ব শেষ করলো আবাহনী দেশে করোনায় আরো একজনের মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনের অংশ নিতে মানা সবল-দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার কাজ শেষ হতে কত দিন লাগবে?

সকল