২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভূমিকম্প : ঝুঁকিতে জাতীয় নিরাপত্তা ও অগ্রগতি

-

দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প সব চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে। সাম্প্রতি আমাদের নিকটবর্তী দেশ নেপালে ভূমিকম্পে প্রায় আট হাজার মানুষ মারা গেছে। এটা এর তির এবং ধ্বংসলীলার কথা আবার স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ছাড়া জাপানসহ কয়েকটি দেশে দফায় দফায় ভূমিকম্পে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
প্রশ্ন আসে তখনই, যখন রানা প্লাজার উদ্ধারকাজে সাধারণ মানুষকে জীবন বিলিয়ে দিতে হয়। তাদের কেউ জোর করে উদ্ধারকাজে আনেনি। মানবতার খাতিরে এসেছেন। ধবংসস্তূপে চাপাপড়া মানুষের বাঁচার আকুতি দেখে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। কিন্তু আমাদের উদ্ধার ব্যবস্থা কি এত নাজুক এবং ধীর যাতে সাধারণ মানুষের সাহায্য নিতে হয়েছে? আসলে কি উদ্ধারকাজে কোনো সমন্বয় ছিল? দেশে চার লাখের মতো সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং ফায়ার সার্ভিসের মতো সংস্থা থাকার পরও কেন বেসামরিক মানুষের সাহায্য লেগেছিল, এর কোনো সদুত্তর হয়তো নেই। রানা প্লাজা ধসে হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারালে আমাদের প্রকৃত ঝুঁঁকি কত বেশি তা সহজেই অনুমান করা গেছে।
সবাই জানি, রাষ্ট্র টাকা বানাতে পারে না। বেশির ভাগ রাষ্ট্রের অর্থের প্রধান উৎস জনগণের ট্যাক্স। বাংলাদেশ কি এর চেয়ে ব্যতিক্রম? আমাদের মাটির নিচে তেলের অফুরন্ত ভাণ্ডার নেই। নেই অসাধারণ স্ন্দুর কিছু দ্বীপ, যা এই দেশের জিডিপিতে অবদান রাখবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গড়ে ওঠে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অসহায় কিছু শ্রমিকের আয়ে।
রানা প্লাজায় উদ্ধার চালাতে গিয়ে যা হিমশিম খেতে হয়েছে, যখন দেশজুড়ে দুর্যোগ হবে তখন কী রকম মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে, তা ভেবে দেখা উচিত এখনই। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে। আমাদের আশপাশে নেপাল ও মিয়ানমারে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। নেপালের জনসংখ্যার অনুপাতে যদি ৯ হাজার মানুষ মারা যায়, আমাদের দেশে সেই সংখ্যা ৫০ হাজারের কম নয়। এখনো নেপালে ৪০ লাখ লোক আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করছে। তার মানে, ওদের প্রায় সবারই বাড়িঘর কিছু-না-কিছু তিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণত ১০০ বছর পরপর নির্দিষ্ট অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হয়। আর আমাদের দেশে গত ১০০ বছরে বড় ভূমিকম্প হয়নি। ফলে এর ঝুঁঁকি থেকেই যাচ্ছে। ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় ঢাকার অবস্থান তেহরানের পরই।
আমরা এমন অবস্থায় চলে এসেছি, যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, বরং তি হলে তা কমানোর চেষ্টা করা জেতে পারে। বলা হচ্ছে retrofitting বা নতুন উপকরণ দিয়ে বাড়ি করার কথা। কিন্তু এর খরচ এবং ঝামেলা বিবেচনা করে কোনো মালিক তার বাড়িতে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন বলে মনে হয় না। পুরনোর প্রতিস্থাপন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মালিক শুধু নিজের তি করবেন না; ওই ভবনের বাসিন্দাদের তিও করবেন তখন। বড় কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানলে অসংখ্য রানা প্লাজা আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসবে আর আসবে স্বজন হারানো মা-ভাই আর বোনের আকুল আহাজারি। সেই সময় কি পাওয়া যাবে এত স্বেচ্ছাসেবক? হাজারো রানা প্লাজা যখন ধসে যাবে, তখন কে কাকে উদ্ধার করবে? পত্রিকায় পড়লাম, খুলনা সিটি করপোরেশন সব ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলছে। এটি বেশ সময়োপযোগী একটি পদপে। আসলে প্রতিটি বাড়িকে ভূমিকম্প সহনীয় করা সম্ভব নয়। তবে মানুষের বাঁচার উপযোগী করা যেতে পারে। সবার সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো পদপে আছে বলে মনে হয় না। এ েেত্র টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্র জনস্বার্থে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সঞ্চার করতে পারে। এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিষয়, ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয়। অপর দিকে, যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছেÑ তার তালিকা সম্পূর্ণ নয়।
আসলে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হলে তা শুধু কিছু মানুষ বা এলাকার তি করবে না, সমগ্র দেশে এর প্রভাব পড়বে। দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে তিগ্রস্ত হতে পারে। ১৯৭২ সালে নিকারাগুয়ায় ভূমিকম্প দেশটির জিডিপির ৪০ শতাংশ তি করেছিল। ৬.২ মাত্রার এই ভূমিকম্পে প্রায় ৫৩ হাজার ঘরবাড়ি তিগ্রস্ত হয়, ছয় হাজার মানুষ মারা যায় এবং ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। শহরের চারটি হাসপাতালের এক হাজার ৬০০ বেড ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। আগুন নেভানোর যন্ত্র প্রায় সব ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েক দিন ধরে আগুন জ্বলতে থাকে শহরের বিভিন্ন স্থানে। শহরের পানি সঞ্চালন এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ৯০ শতাংশ অচল হয়ে পড়েছিল।
আমরা বর্তমানে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছি। ল্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া। কিন্তু প্রকৃতি এক নিমিষেই এই লক্ষ্য নস্যাৎ করতে পারে। নেপালে ভূমিকম্পে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের তি হয়েছে, যা এর জিডিপির অর্ধেক। নেপাল একসময় ল্য নির্ধারণ করেছিল ২০২২ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার, যা এখন প্রায় অসম্ভব। যদি তা করতেই হয়, তবে তাদেরকে আট শতাংশ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে হবে। এটা তারা গত দশকে করতে পারেনি এবং এই ধ্বংসস্তূপের ওপর তা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
IHS Global Insights এর জরিপ অনুসারেÑ নেপালের তিগ্রস্ত অবকাঠামো বিনির্মাণে দরকার প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। নেপালের তুলনায় আমাদের জনসংখ্যা এবং অর্থনীতি দুটোই আকারে বড়। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি আর সতর্কতা কোনোভাবেই নিকারাগুয়ার চেয়ে বেশি নয়। একটি ভবনে তির পরিমাণ যদি গড়ে ২০ লাখও হয় এবং মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে রাজউকের জরিপ অনুসারে, যদি শুধু ঢাকা শহরে ৩৩ হাজার ভবন তিগ্রস্ত হয়, তবে মোট য়তির পরিমাণ প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব ভবন মেরামত করতে লাগবে আরো ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা। এ েেত্র আমরা শুধু ভবনের খরচ বিবেচনা করলাম। কিন্তু ভাবতে হবে, এসব ভবনে বসবাসকারী, ব্যবসা পরিচালনাকারী মানুষের কথা, তাদের মালিকানাধীন পণ্য ও জিনিসপত্রের কথা। এসব ভবনের বেশির ভাগ মানুষ বাসস্থান হারাবেন এবং সেই সংখ্যা ৩৩ হাজার ভবনের জন্য গড়ে ৫০ জন হিসাব করলে ১৬ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হবে। সম্প্রতি নেপালে দেখেছি, মানুষ খোলা আকাশের নিচে দিন যাপন করছে। ঢাকা শহরে কি সে পরিমাণ খোলা জায়গা আছে? আর যে পরিমাণ ঘরবাড়ি ধসে পড়বে, তাতে অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ছোটখাটো নানা ধরনের কলকারখানা থাকবে। লাখ লাখ মানুষ যখন কাজ হারিয়ে পথে বসবে, সেই অবস্থা কিভাবে সামাল দেয়া হবে? সম্প্রতি আমরা দেখেছিÑ গ্যাস লাইন থেকে সৃষ্ট আগুন অনেক মানুষের জীবন নিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বিভিন্ন জায়গায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের চিন্তা হয়ে পড়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকা আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও ভূমিকম্পে এর আশপাশের জেলাগুলো এমনকি চট্টগ্রামেও বড় ধরনের তি হতে পারে। একটি বড় ভূমিকম্পে যতটা না প্রাণহানি হবে, তার চেয়ে অবকাঠামো ধ্বংস হবে বেশি। এটা উৎপাদনের উপকরণগুলোর ব্যাপক তি পূরণের কাজটি অনেক কঠিন করে দেবে। বলে রাখা ভালো, একটি ভূমিকম্প দেশকে অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে নিতে পারে। দেশে খাদ্য সঙ্কট, আর্থিক মন্দা, ব্যাপক বেকারত্ব দেখা দিতে পারে; এমনকি জিডিপি কমে যেতে পারে।
আইলা ও সিডর এ ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছে। ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা মোকাবেলায় আমাদের যতটুকু সাফল্য এবং প্রস্তুতি আছে, তার অর্ধেকও ভূমিকম্প মোকাবেলায় নেই। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়Ñ এসব সাইকোনে যতটুকু তি আমাদের হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি তি করার সামর্থ্য রাখে মাঝারি ধরনের একটি ভূমিকম্প। বন্যায় জনপদ ডুবে যায়, মাঠের ফসল নষ্ট হয়, মানুষ বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে ভোগে এবং গৃহপালিত পশুপাখি মারা যায়, নিঃসন্দেহে এসব কিছু সাধারণ কৃষক আর জনগণের জন্য কষ্টের। বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে যায়, কিন্তু পানি নেমে গেলে আবার সুন্দরভাবেই ব্যবহারযোগ্য হয়ে যায়। গাছপালা অনেক মরে যায়, যাদের মাটির ঘর তাদের খুব কষ্ট হয়; মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু তা আবার আবাদ করলে বেশ ভালো ফলন হয়। কিন্তু ভূমিকম্পে কাঁচাপাকা ঘর নির্বিচারে ধসে যায়, এর সাথে বন্যার তুলনা চলে না। এ তি টাকার অঙ্কে বহু গুণে বেশি। মাঠের ধান একবার নষ্ট হলেও তিন মাস পর আবার চাষ করা যায়। অন্য দিকে, ভূমিকম্পে তি পূরণে বছরের পর বছর লেগে যাবে। তাই সময় এসেছে ভূমিকম্প মোকাবেলায় যথযথ পদপে নেয়ার। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের উন্নয়নের ল্যমাত্রার সব সূচক চুরমার করে দিতে পারে কয়েক মিনিটের তাণ্ডবে। বিদ্যমান ভবনগুলোকে কিছু করা গেলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এমনকি এসব ভবনকে চিহ্নিত করাও সরকারের পে প্রায় অসম্ভব। তারপরও ভবন নির্মাণ থেমে নেই। নির্মাণাধীন ভবনের তালিকা করে যথাযথ নজরদারিতে আনা সম্ভব। সেসব বিল্ডিংয়ে সংশ্লিষ্ট কোড মেনে চলা হচ্ছে কি না তা দেখা উচিত এবং সরকারি সংস্থাগুলোকে আরো বেশি দায়িত্বপরায়ণ হতে হবে। স্থাপনাকে শুধু মালিকের মনে না করে দেশের মনে করতে হবে। মনে রাখতে হবেÑ একটি ভূমিকম্প শুধু সম্পদের মালিকের তি করবে না, এর সামগ্রিক প্রভাব সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপরই পড়বে।


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও মিরসরাইয়ে জুস খাইয়ে অজ্ঞান করে লুট, মূল হোতা গ্রেফতার বৃষ্টি কামনায় ঈশ্বরগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর ইসতিসকার নামাজ আদায় কুবিতে আল্টিমেটামের পর ভিসির কার্যালয়ে তালা ঝুলাল শিক্ষক সমিতি

সকল