২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থনৈতিক নির্ধারক ও উন্নয়ন ভ্রান্তি

-

তত্ত্বগত দিক দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশ কী পরিমাণ ভোগ-ব্যয় ও বিনিয়োগ করছে তার ওপর অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটা নির্ভর করে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, ভোগ করলে সম্পদের বিনাশ সাধিত হয়। আর এ কারণে বিজ্ঞজন থেকে শুরু করে সবাই ‘ভোগে সুখ নেই ত্যাগেই সুখ’ প্রবাদটি আওড়াতে থাকেন; কিন্তু ভোগের সাথে ব্যয় প্রত্যয়টি যোগ হয়ে প্রবাদটির যথার্থটা অনেকটাই ভুল প্রমাণ করেছে। ধর্মমত অনুযায়ী, কোনো কাজ সম্পাদনে চেষ্টার গুরুত্বকে সফলতার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে দিক দিয়ে অর্থনীতির ভোগব্যয় তত্ত্বটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। ভোগ তখনই বাড়ে, যখন মানুষের হাতে অনেক টাকা থাকে এবং যখন মানুষ ভোগের নিবৃত্তে ব্যয় করার সক্ষমতা লাভ করে। আর এই ভোগব্যয় মেটাতে মানুষ শ্রম দিয়ে থাকে। একজন বা কিছু মানুষের শ্রমের মাল্টিপ্লায়ার প্রভাব আছে। একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির শ্রমের মাধ্যমে সে নিজেই একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় উপকৃত হয়, ব্যাপারটি এ রকম নয়। বরং গোটা জাতি সেখান থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপকৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের একজন শ্রমিকের শ্রম দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শ্রমিকের এই শ্রমের দরকার হতো না, যদি না তাকে ভোগ করতে হতো। সুতরাং ত্যাগের চেয়ে ভোগ বা ভোগব্যয়ের রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থার উন্নয়নে মাল্টিপ্লায়ার প্রভাব থাকায় ত্যাগের চেয়ে বরং ভোগের গুরুত্ব বেশি দেয়া শ্রেয়। আর এর মাধ্যমে ধর্মমত অনুযায়ী, ‘মানুষের জীবনে শ্রম ছাড়া আর কিছু নেই’, এই বিষয়টিরও যথার্থতা প্রমাণ সম্ভব হয়। এই প্রক্রিয়ায় ভোগব্যয় একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হয়।
অন্য দিকে, আমরা যদি বিনিয়োগের বিষয়টির ওপর অর্থনীতির প্রভাব বিবেচনা করি, সে ক্ষেত্রে এর দু’টি দিক বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। একটি হলোÑ বিনিয়োগকে ব্যয় হিসেবে দেখা হয়। যেমনÑ ভোগব্যয় মেটানোর পর অধিক শ্রম দিয়ে অর্জিত উদ্বৃত্ত অর্থ মানুষ ব্যয় করে মুনাফা লাভের নিমিত্তে, যাকে বিনিয়োগ বলা হয়ে থাকে। আর একটি হলো, সরকার থেকে জনসাধারণের ভোগের নিমিত্তে প্রদেয় ব্যয়। এভাবে ব্যয়ই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আনায় দারুণভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে উদ্বৃত্ত অর্থের বিনিয়োগ যদি বিশেষ কোনো কোম্পানি বা বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) হয়, সে ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিদেশী বিনিয়োগ একটি দেশে মূলত কার্যকর হয় তিনটি প্রক্রিয়ায়। যেমনÑ বিনিয়োগ, পুনঃবিনিয়োগ ও ঋণ হিসেবে। বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদেশী কোম্পানিগুলো মুনাফা অজর্ন করে এবং মুনাফা আরো বেশি লাভের জন্য পুনঃবিনিয়োগ করে। কখনো কখনো এই কোম্পানিগুলো একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে আহরিত মুনাফার তুলনায় আরো বেশি মুনাফা লাভের জন্য তারা বিনিয়োগ উত্তোলন করে অন্য দেশের অন্য খাতে বিনিয়োগ করে। এ প্রক্রিয়ায় যখন তারা বিনিয়োগ ও মুনাফা উভয়ই অর্জন করে, তখন এফডিআই পরিমাণের দিক দিয়ে নেতিবাচক অঙ্ক দেখাতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের এফডিআইয়ের পরিমাণ নেতিবাচক ছিল। শুধু তাই নয়, যেহেতু বিদেশী বিনিয়োগের খুব বেশি উঠা-নামা হয় ও স্বল্প মেয়াদে এর ফলাফল লাভ সম্ভব হয় না, এ কারণে, একটি দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্টস ব্যালেন্সে এ ধরনের বিদেশী বিনিয়োগের কারণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নের একটি ধাপ পাড়ি দিয়ে আর একটি ধাপে উন্নীত হতে যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ভোগ, ভোগ-ব্যয় যা বিনিয়োগের পথকে প্রশস্ত করে ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেÑ এর জন্য রাষ্ট্রকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে মুনাফালোভী সিন্ডিকেট যেন পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোগ-ব্যয়কে কমাতে না পারে, সে দিকে লক্ষ করতে হবে। অর্থনৈতিক তত্ত্বানুযায়ী, অর্থের চলমানতা বজায় থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমুন্নত থাকে।
হোক তা বৈধ অথবা অবৈধ পথে, তবে যদি না অর্থ অলস অর্থে রূপান্তরিত হয়। এ কথা সত্য, অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ অলস অর্থে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এক. অর্থের মালিকেরা ট্যাক্স দেয়ার ভয়ে তা বিনিয়োগ করে না। কেননা, বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে। দুই. দুদকের নজরদারি সক্রিয় থাকায় অত্যধিক অর্থ ব্যাংকে জমা রাখতেও অনেকে ভয় পায়। এ কারণে অর্থ অলস হতে বাধ্য। সুতরাং বৈধ পথে অর্থ উপার্জনই বরং শ্রেয়। এক দিকে যেমন তা ভোগ ও ভোগব্যয় বাড়বে, অন্য দিকে আয়ের অসমতা কমাতেও সহায়তা করবে। ভোগব্যয় বেড়ে যাওয়া ও আয়ের সমতা উভয়ই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
আমরা বিদেশী বিনিয়োগ আহ্বান করব, এটা ঠিক। তবে সেটা যেমন উৎসাহিত করব, তেমনি বিদেশী বিনিয়োগের পূর্বশর্ত যেন আমাদের জন্য সহজ শর্তে হয় সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট মহলকে যথোচিত নিতে হবে। উল্লেখ্য, ট্রেড রিলেটেড ইনভেস্টমেন্ট মেজারস (ট্রিমস) বিদেশী কোম্পানিগুলোর যে একচেটিয়া ক্ষমতা দিয়েছে, তা অনেকাংশেই বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অধিক মুনাফা লাভে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ বিনষ্ট হয়। এ অবস্থাকে দারিদ্র্যের অত্যধিকতা বলে আখ্যা দেয়া হয়। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন যাত্রায় দারিদ্র্যের অত্যধিকতাকে অগ্রাহ্য করতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে দরকষাকষিতে যেকোনো মূল্যেই হোক দেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রাখতে হবে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে, যা বিশ্বায়নের কুশীলবেরা স্বীকৃতি দিয়েছে। আর তা অবলোকন করে আমরা উল্লসিত ও প্রশংসা কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তবে আমরা এর চ্যালেঞ্জগুলো মোটেই মাথায় নিচ্ছি না, যা হিতে বিপরীত হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। যেহেতু আমরা উন্নয়নের একধাপ পেরিয়ে এসেছি, এখন থেকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আর সফট লোন পাওয়া সম্ভব হবে না। শুধু লোনই নয়, বৈদেশিক সাহায্যের পথ আর ঢালাওভাবে উন্মুক্ত থাকবে না। ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ সমস্যাগুলো তুলনামূলক প্রকট হবে। আগামী দিনের আকাশচুম্বী বাজেট বাস্তবায়নে উপরিউল্লিখিত বিষয়গুলো বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আর এ কারণে অনেকেই বলছেন, বিদ্যমান অবস্থায় থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় অগ্রগতি সাধন যতটা বেশি সম্ভব হচ্ছে, ঘোষিত উন্নয়নপ্রক্রিয়া আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে।
বিজ্ঞজন থেকে শুরু করে সবাই ওয়াকিবহাল, জাতিসঙ্ঘ ও আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন ধাপ উন্নীতকরণের মানদণ্ড আলাদা আলাদা। পৃথকীকরণ এই মানদণ্ডের পেছনে তাদের উদ্দেশ্যই বা কী তা এখন প্রশ্নাতীত। তবে এটি একটি ধোঁয়াশা বৈ কিছুই নয়। যারা আজকে আমাদের দেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তারা আজকে উন্নতির চরম শিখরেÑ এর পেছনে ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে বাংলার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বিশিষ্ট পশ্চিমা পণ্ডিত এডমন্ড বার্ক উদ্ধৃত করেছেন, ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে পশ্চিমারা আমাদের সম্পদ লুট করে তাদের শিল্পায়নপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে। এ কারণে তাদের কাছ থেকে আমাদের স্বীকৃতির কোনো যথার্থতা আছে বলে আমি মনে করি না। তাদের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়ন ভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে জটিলতায় রূপান্তরিত করার কোনো উদ্যোগ কি না তা ভেবে দেখতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণের আছে অদম্য প্রতিভা ও স্পৃহা উভয়ই। মুক্তিযুদ্ধ দিয়েছে তাদের এক অনড় মনোবল ও দৃঢ়তা। কোনো কুটিল প্রক্রিয়ায় এর জয়যাত্রাকে কেউ রুখতে পারবে না। কারো স্বীকৃতি নয়, বরং নিজ স্বীকৃতি, শ্রম, মননশীলতা ও দৃঢ়তা আমাদের প্রেরণা জোগাবে আগামী দিনের উন্নয়ন-প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে। আমরা স্বল্পোন্নত না উন্নয়নশীল তা আমলে না নিয়ে বরং পরিবর্তনের রোডম্যাপ অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে যেতে হবে। উন্নয়ন ভ্রান্তি যেন আমাদের উন্নত হতে কান্ত না করে সেই মনোবল নিয়ে রাষ্ট্র ঘোষিত ২০৪১ সাল যেন হয় আমাদের স্বপ্ন। এই স্বপ্নই হতে পারে আমাদের প্রেরণা, উন্নয়ন ভ্রান্তি নয়।হ
লেখক : ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ ফর পলিটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি), ঢাকা

 


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে হিট স্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় স্ত্রীর ২৭ স্থানে স্বামীর ধারালো অস্ত্রের আঘাত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ১২ উপজেলায় মানববন্ধন রোববারই খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবার ক্লাসসহ ৪ নির্দেশনা ময়মনসিংহ ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ঈদ পুনর্মিলনী বাস্তবায়নের আহ্বান ৩ গণকবরে ৩৯২ লাশ, ২০ ফিলিস্তিনিকে জীবন্ত কবর দিয়েছে ইসরাইল! মৌলভীবাজারে বিএনপি ও যুবদল নেতাসহ ১৪ জন কারাগারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট কারীদের চিহ্নিতকরণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ১২ দলীয় জোটের কলিং ভিসায় প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরার সময় মারা গেল মালয়েশিয়া প্রবাসী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিবকে আটকের অভিযোগ হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেলে কার্গো জাহাজডুবি : একজন নিখোঁজ, ১১ জন উদ্ধার

সকল