২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

দি মেসেজ অব দি কুরআন ‘হুর’ ও মানবসৃষ্টির ব্যবস্থা

-

মুহাম্মদ আসাদের এ তাফসিরের অনুবাদে literal বা শাব্দিক অর্থ না করে বরং মর্মবাণী তুলে ধরা হয়েছে। এ ধরনের অনুবাদ মাওলানা মওদূদী তার ‘তাফহীমুল কুরআনে’ করেছেন। তিনিও তার দৃষ্টিভঙ্গিতে কুরআনের শাব্দিক অনুবাদ না করে অনুবাদে মূল ভাব তুলে ধরেছেন। মুহাম্মদ আসাদ তার তাফসিরের নোটে (যেখানে তিনি শাব্দিক অনুবাদ করেননি, সে ক্ষেত্রে) শাব্দিক অনুবাদও দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং যারা শাব্দিক অনুবাদ চান, তারা এ তাফসিরে শাব্দিক অনুবাদ পেয়ে যাবেন। মুহাম্মদ আসাদ এমন এক মহান ব্যক্তি ছিলেন, যিনি নিজের মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও দু’টি বিদেশী ভাষা আরবি ও ইংরেজিকে পুরোপুরি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। আসাদের আরবি ও ইংরেজি যথাক্রমে আরব ও ইংরেজদের থেকেও উন্নত। এটি একটি অসাধারণ বিস্ময়।
মুহাম্মদ আসাদ তার তাফসিরে সংক্ষেপে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নোট সংযোজন করেছেন। এসব নোটে তিনি যে শুধু নিজের উপলব্ধি তুলে ধরেছেন তা নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে বিতর্কমূলক বিষয়গুলোতে পূর্ববর্তী আলেমদের মতামতও তুলে ধরেছেন। তিনি ইসলামের মানবতাবাদী ও যুক্তিবাদী ধারার প্রতিনিধি। অবশ্য, আমার জানা মতে তিনি কোথাও ইসলামের মূল spirit বা ভাব থেকে সরে যাননি কিংবা অকারণে অন্য সভ্যতার কাছে নতজানু হননি, যদিও কেউ কেউ এ রকম মনে করে থাকেন। তার তাফসিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি লিঙ্গ পক্ষপাতিত্ব’ (gender bias) থেকে মুক্ত। এটি তার সাফল্য। অনেক তাফসিরে এটি দেখা যায় না।
উদাহরণ : সূরা নিসার প্রথম আয়াতের অনুবাদ ও তার নোট দ্রষ্টব্য।
অনুবাদ : ‘নফস’-এর যেসব বিভিন্ন অর্থ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে আত্মা, মন, জীবিত প্রাণ, জীবন্ত সত্তা, মানুষ, ব্যক্তি, নিজ (ব্যক্তিগত পরিচয় হিসেবে), মানবজাতি, জীবনের মূল, মূলনীতি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে প্রাচীন তাফসিরকারগণ ‘মানুষ’ অর্থটি গ্রহণ করেছেন এবং ধরে নিয়েছেন যে, এর অর্থ হচ্ছে আদম। কিন্তু মুহাম্মদ আবদুহু এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন (মানার চতুর্থ খণ্ড) এবং এর পরিবর্তে ‘মানবজাতিকে’ প্রাধান্য দিয়েছেন। কেননা এ অর্থ দ্বারা মানবজাতির সাধারণ ভ্রাতৃত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, যা হচ্ছে এ আয়াতের বক্তব্যের লক্ষ্য। একই সাথে তিনি অযৌক্তিকভাবে এটাকে বাইবেলে বর্ণিত আদম ও হাওয়া সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিতও করেননি। আমার অনুবাদে ‘জীবিতসত্তা’ (living entit) ব্যবহার করেছি, একই যুক্তির ভিত্তিতে। ‘জাওজাহা’ (তার সঙ্গী) সম্পর্কে লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, জীবজন্তু বা প্রাণীর ক্ষেত্রে ‘জাওজ’ (জোড়া, জোড়ার একজন বা একজন সঙ্গী) পুরুষ ও নারী, দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় অথবা পুরুষ-স্ত্রী বোঝায়। সুতরাং মানুষের ক্ষেত্রে এটি বোঝায় একজন নারীর সঙ্গী (স্বামী) এবং একজন পুরুষের সঙ্গী (স্ত্রী)। আবু মুসলিম থেকে রাজি উল্লেখ করেছেন, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন তার সাথী (অর্থাৎ যৌনসঙ্গী) এর নিজ জাতি থেকে (মিন জিনসাহা)’, এটা মুহাম্মদ আবদুহুর উপরোল্লিখিত মতকে সমর্থন করে। ‘মিনহা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘এর থেকে’ স্পষ্ট করে আয়াতের শব্দের সাথে সঙ্গতি রেখে, জীববিজ্ঞানের এ সত্য যে, দুই লিঙ্গই (পুরুষ ও নারী) একই ‘জীবন্ত সত্তা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
আসাদ তার তাফসিরে অনেকগুলো বিষয়ে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত, কিন্তু কুরআনের আয়াতের অর্থের আওতাধীন, ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে দাসীদের বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীরূপে গ্রহণ এবং হুর সম্পর্কিত ব্যাখ্যার কথা উল্লেখ করা যায়।
সূরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতের প্রথমাংশের অনুবাদ তিনি এভাবে করেছেনÑ প্রায় সব তাফসিরকারের মতে, ওপরের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আল মুহসানাত’-এর অর্থ ‘বিবাহিতা নারী’ যাদের তোমরা আইনসম্মতভাবে ‘মা মালাকাত আইমানুকুম’ (তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক, অর্থাৎ তোমরা যাদের আইনসম্মতভাবে মালিক) দ্বারা প্রায়ই জিহাদে ধৃত নারী দাসীদের বোঝানো হয় (৮:৬৭ আয়াতের নোটটি দেখুন)। যেসব তাফসিরকারক এ অর্থ নিয়েছেন, তারা মনে করেন যে, এমন নারীকে বিবাহ করা যায়, তাদের মূল দেশে তাদের স্বামী থাকুক বা না থাকুক। কিন্তু এর বৈধতার বিষয়ে নবীর সাহাবিদের মধ্যে এবং পরে অন্যদের মধ্যে মৌলিক মতবিরোধ ছাড়াও বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের তাফসিরকার মনে করেন, ‘মা মালাকাত আইমানুকুম’-এর অর্থ এখানে ‘যাদেরকে তোমরা বিবাহের মাধ্যমে আইনসম্মতভাবে অধিকারী হয়েছ’। এভাবেই তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন। রাজি এ আয়াতের এবং তাবারি তার এক ব্যাখ্যা এভাবেই করেছেন (আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ এবং অন্যদের উল্লেখ করে)। রাজি বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন, এখানে ‘বিবাহিত নারীর’ (আল মুহসানাত মিনান নিসা) উল্লেখ ( যেহেতু তা নিষিদ্ধ নারীর উল্লেখের পর এসেছে) করা এ বিষয়ে জোর দেয়ার জন্য যে, একজনের বৈধ স্ত্রী ছাড়া আর কারো সঙ্গে যৌনসহবাস নিষিদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ আসাদের সূরা মুমিনুনের তাফসিরের ৩ নম্বর নোটও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তেমনিভাবে ‘হুর’ সম্বন্ধেও তিনি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি সূরা ওয়াকিয়ার ৮ নম্বর নোটে লিখেছেনÑ
অনুবাদ : বিশেষ্য ‘হুর’ শব্দটির আমি অনুবাদ করেছি ‘জীবনসঙ্গী’। এ শব্দটি পুংলিঙ্গ ‘আহওয়ার’ এবং স্ত্রী লিঙ্গ ‘হাওরা’ শব্দের বহুবচন। আহওয়ার এবং হাওরা দ্বারা এমন এক ব্যক্তিকে বুঝায় যিনি ‘হাওয়ার’ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ‘হাওয়ার’ দ্বারা প্রধানত বোঝায় ‘চোখের গভীরভাবে সাদা হওয়া এবং চোখের মণির উজ্জ্বল কালো হওয়া (কামুস)।’ সাধারণ অর্থে ‘হাওয়ার’ দ্বারা বোঝায় শুধু সাদা হওয়া (আসাস) অথবা একটি নৈতিক গুণ হিসেবে ‘পবিত্রতা’ (তাবারি, রাজি এবং ইবনে কাসিরে ৩:৫২ আয়াতের ‘হাওয়ারিউন’, শব্দের ওপর আলোচনা)। সুতরাং যুগ্মশব্দ ‘হুর ইন’ দ্বারা মোটামুটিভাবে বোঝায় ‘পবিত্র ব্যক্তিগণ (বা আরো স্পষ্টভাবে পবিত্র সঙ্গী), যাদের চোখ খুব সুন্দর (এটি হচ্ছে ‘ইন’ শব্দের অর্থ, এ শব্দটি ‘আয়ান’ শব্দের বহুবচন)’।
সাধারণভাবে হুর দ্বারা সাধারণত নারী বোঝানো হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, আগের যুগের বেশ কয়েকজন তাফসিরকার, যাদের মধ্যে হাসান আল বসরিও রয়েছেন, এর অর্থ করেছেন ‘মানবজাতির মধ্যে সৎকর্মশীল নারীরা’ (তাবারি)। এমনকি, বিগত ওইসব দাঁতহীন মেয়েরাও ‘নতুন মানুষ’ হিসেবে পুনরুত্থিত হবেন (আল হাসানকে এভাবেই রাজি উল্লেখ করেছেন তার তাফসিরে ৪৪:৫৪ আয়াতের ব্যাখ্যায়)।
মুহাম্মদ আসাদের পুরো তাফসিরই একটি অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। মুহাম্মদ আসাদ তার তাফসিরের শেষে চারটি সংযোজনী যোগ করেছেন। এসব সংযোজনীর বিষয় হচ্ছেÑ ‘কুরআনের রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার’, ‘আল মুকাত্তায়া’, ‘জিন’ এবং ‘মিরাজ’ সম্পর্কে। এ সব কয়টিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনী।
কুরআনের তাফসিরে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সবসময়ই ছিল ও থাকবে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে মতবিরোধ খুবই স্বাভাবিক। বড় চিন্তাবিদদের ক্ষেত্রে এটা সবসময়ই হয়েছে। যারাই তাফসির সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করতে চান, তাদের অবশ্যই মুহাম্মদ আসাদের তাফসির পড়া উচিত, যেমন পড়া উচিত এ যুগের এবং অতীতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তাফসিরগুলো। হ
লেখক : সাবেক সচিব,
বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement