২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ধান নিয়ে নৈরাজ্যের নেপথ্যে চাল রফতানির অনুমতি!

পাকা ধানক্ষেতে আগুন লাগিয়ে কৃষকের অভিনব প্রতিবাদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

সরকারের কাছ থেকে চাল রফতানির অনুমতি আদায় করার কৌশল হিসেবে মিলমালিকেরা সিন্ডিকেট করে ধানের বাজারে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে তারা বলছেন, গুদামে আগের বছরের প্রচুর পরিমাণ চাল অবিক্রীত থাকায় তারা ধান কিনতে পারছেন না। আবার ভর্তুকি মূল্যে ধান কেনার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে সেটিও কাজে লাগছে না মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে। সরকার প্রতি মণ ধান কেনার জন্য এক হাজার ৪০ টাকা প্রদান করলেও কৃষকের হাতে যাচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। বাকি টাকা চলে যাচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, মিল মালিক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে। এ নিয়ে সারা দেশে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও চাল রফতানির অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগোচ্ছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে দু-এক দিনের মধ্যে সীমিত পরিমাণে চাল রফতানির অনুমতি দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সাথে গত ১৮ এপ্রিল সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসে দেশ থেকে চাল রফতানির প্রস্তাব দিয়েছেন চালকল মালিকরা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ওই দিন একটি লিখিত প্রস্তাব দেয়া হয়। দেশে এই মুহূর্তে যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বৃত্ত চাল রয়েছে। প্রস্তাবপত্রে তারা বলেন, রফতানি করার সুযোগ না দিলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই যুক্তিতে তারা দেড় থেকে দুই লাখ টন চাল রফতানির অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তাদেরকে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান। কিন্তু গত এক মাসেও এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে এ বছর বোরো মওসুমে ১ কেজি চাল উৎপাদনে ৩৬ টাকা খরচ পড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল, দেড় লাখ টন আতপ চাল এবং দেড় লাখ টন ধান সংগ্রহ করবে। কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা দরে সেদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা দরে আতপ চাল এবং ২৬ টাকা দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। গত ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ধান-চাল সংগ্রহ চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। অভিযোগ উঠেছে, সরকার প্রতি মণ ধানের জন্য এক হাজার ৪০ টাকা খরচ করলেও সে টাকা কৃষক পাচ্ছে না। চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। কারণ কৃষক সরাসরি ধান-চাল সরবরাহ করতে পারছেন না। ধরা দিতে হচ্ছে কোনো না কোনো মাধ্যমের কাছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, গত অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। গতিশীলতার এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৪ কোটি ৭২ লাখ টন। বিপরীতে ২০৫০ সালে ২১ কোটি ৫৪ লাখ লোকের খাদ্যচাহিদা পূরণে ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন চালের প্রয়োজন হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে বার্ষিক কত টন চালের প্রয়োজন তার কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য সরকারি কোনো দফতরে নেই। কৃষি বিভাগের কাছ থেকে খাদ্যশস্যের বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে থাকে খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু চালের গুদাম, মজুদ, আমদানি ও উৎপাদন তথ্য থাকলেও চাহিদা বা কতটুকু চাল ভোগ করা হয়, তার কোনো তথ্য সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।

চাল রফতানির প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী এই প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের দেশে চালের চাহিদা সাড়ে তিন কোটি টনের মতো। এ বছর উৎপাদন হয়েছে চার কোটি টনের মতো। দেশে এখনো ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র দুই লাখ টন চাল রফতানির অনুমতি চেয়েছি আমরা। তিনি বলেন, সরকার আমাদেরকে ধান কেনার জন্য বলছে। কিন্তু গুদাম খালি করতে না পারলে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে আমরা রাখব কোথায়? আমরা কৃষকের স্বার্থে চাল রফতানির অনুমতি চেয়েছি। রফতানির অনুমতি না দিয়ে পুরান চালে গুদাম ভর্তি করে রাখলে কৃষক ও সরকার উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সরকারের একাধিক সূত্রের তথ্যানুযায়ী, চাল রফতানির অনুমতি দেয়ার মতো ঝুঁকি সরকার নিতে চাচ্ছে না। ২০১৭ সালে দেশের হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যার কারণে চাল সঙ্কটের বিষয়টি এখনো তাদের সতর্ক করে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য, কোনো কারণে দেশের চাল উৎপাদনকারী যেকোনো একটি এলাকায় বছরের একটি ফসল নষ্ট হয়ে গেলেই ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি দেশে এই মুহূর্তে কক্সবাজার এলাকায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। কাজেই চাল রফতানির মতো এই ঝুঁকি নেয়ার সময় এখনো আসেনি। এ ছাড়া কৃষকের কথা বলা হলেও এই মুহূর্তে কৃষকের গোলায় কোনো চাল নেই। চাল রয়েছে আড়ৎদারদের গুদামে। এই গুদাম খালি করতেই ব্যবসায়ীরা রফতানির অনুমতি চেয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা বাড়তি মুনাফা করতে চাচ্ছেন। এতে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে নানামুখী চাপে শেষ পর্যন্ত সীমিত পরিমাণে চাল রফতানির অনুমতি দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

এ দিকে ধানের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ার জন্য বড় কোম্পানিগুলোর আধিপত্যকে দায়ী করে বাংলাদেশ অটো রাইচমিল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম গতকাল শনিবার অভিযোগ করেছেন, কিছু ব্যাংক সিটি ও এসিআই গ্রুপসহ কয়েকটি বড় কোম্পানিকে ধান কেনা বাবদ ২০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা মূলধন দিচ্ছে। অথচ ছোট রাইচ মিলগুলোকে ৫০ লাখ টাকাও দিতে চাইছে না। তিনি বলেন, টাকার অভাবে দেশের প্রায় ৭০ ভাগ রাইচ মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে কৃষকরা ওই সব মিলে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে পানির দরে ধান কিনে মজুদ করছে সিন্ডিকেটে থাকা ওইসব বড় কোম্পানি। সরকারিভাবে ধান-চাল কেনার ক্ষেত্রে নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কাও করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। 

খোরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, ২০০৫ সাল থেকে দেশে ব্যাপক হারে অটো রাইচ মিল গড়ে ওঠে। এ সময় থেকে কৃষকরা নতুন উদ্যমে ধান চাষ করে রাইচ মিলগুলোতে বিক্রি করতে থাকে। সে সময় কৃষকদের এ ধরনের সমস্যা হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি বড় বড় কোম্পানি রাইচ মিল খুলে ধান কেনার জন্য ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। তাদের দাপটে ৭০ ভাগ রাইচ মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা আর ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছেন না। আবার সরকার যে নিয়ম মেনে ধান ক্রয় করার জন্য টাকা দিয়ে থাকে এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী সেখানেও ভাগ বসিয়ে কৃষকদের টাকা আত্মসাৎ করছে। এই অবস্থায় কৃষক ও দেশ বাঁচাতে হলে প্রকৃত কৃষক শনাক্ত করে কৃষিঋণ বিতরণের দাবি জানান তিনি। 

এ দিকে ধানের দাম নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা দ্রুতই সমাধান করা হবে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গতকাল রাজধানীর আইডিইবি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেছেন, ইমিডিয়েট সমাধান হচ্ছে, যদি ধান রফতানিতে যাই। রফতানিতে যাওয়ার চেষ্টা করব। হারভেস্ট হয়ে গেলে সিদ্ধান্ত নেবো। এ সমস্যার সমাধান করব। এ মুহূর্তে সরকারের হাতে ধান কিনে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ধানের দাম বাড়ানোর একমাত্র উপায় হলো, চাল রফতানি করা। এটাও আমাদের চিন্তাভাবনা করে করতে হচ্ছে। গতবারের মজুদ ৮ থেকে ১০ লাখ টন ধান এখনো অবশিষ্ট আছে বলে জানান মন্ত্রী। তিনি এবং খাদ্যমন্ত্রী এ বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন জানিয়ে ড. রাজ্জাক বলেন, প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।


আরো সংবাদ



premium cement
মোরেলগঞ্জে মাছ ধরতে গিয়ে নদীতে ডুবে কিশোরের মৃত্যু আল-আকসায় কোনো ধরণের সহিংসতা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হলো তৃতীয় জুমআর জামাত ‘পেশাগত স্বার্থে সাংবাদিকদের ঐক্যবব্ধ হতে হবে’ গাজাবাসীর প্রধান কথা- ‘আমাদের খাবার চাই’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান

সকল