ইন্টারনেটের গতি ফোরজি থেকে টুজি করলে ক্ষতি কী?
- বিবিসি বাংলা
- ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:০০, আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:০৫
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের সময় কিছুদিনের জন্য ইন্টারনেটের গতি কমানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের আইন-শৃঙ্খলা সমন্বয় সভায় ইন্টারনেটের গতি ফোর জি থেকে টু জি'তে নামিয়ে আনার সুপারিশ পেশ করা হয় কমিশনের কাছে।
কিন্তু ইন্টারনেটের গতি ফোর জি থেকে কমিয়ে টু জি'ত নামিয়ে আনলে তার কী ধরণের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এ.বি.এম. মইনুল হোসেন মনে করেন, ইন্টারনেটের গতি কমালে শুধু সাময়িক নয়, দীর্ঘমেয়াদেও বিভিন্ন রকম ক্ষতি হতে পারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে।
কার্যকারিতা হারাবে স্মার্ট ফোন
‘স্মার্ট ফোনের স্মার্ট শব্দটি এসেছে টু জি সংযোগ থেকে থ্রি জি'তে উত্তরণকে বিবেচনা করে; অর্থাৎ ইন্টারনেটের গতি টু জি'তে নামিয়ে আনলে স্মার্ট ফোনকে আর স্মার্ট বলা যাবে না’, বলেন মি. হোসেন।
তিনি বলেন, ইন্টারনেটের গতি টু জি'তে নামানো হলে ই-মেইল আদান-প্রদান বা কিছু কিছু ওয়েবসাইটে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। হয়ে যাবে খুব ধীর গতির।
‘টু জি নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে কাগজে কলমে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও কার্যকারিতার কথা বিবেচনা করলে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার মতই অবস্থার তৈরি হবে,’ বলেন তিনি।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইন্টারনেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা; মূলত বিদেশে বসবাসরত ব্যক্তিরা ইন্টারনেটে কম খরচে বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যার মুখে পরবেন।
ক্ষতিগ্রস্ত হবে ই-কমার্স, এফ-কমার্স খাত
ইন্টারনেট সেবা টু জি'তে নেমে আসলে ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়বেন অনেক মানুষ। ইন্টারনেট না থাকায় কম খরচে যোগাযোগ অসম্ভব হয়ে পড়বে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসার কাজে ঝামেলা পোহাতে হবে ব্যবসায়ীদের।
এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ফেসবুকও পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না বলে এফ-কমার্স খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান মি. হোসেন।
তাঁর মতে, এর ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এফ-কমার্স বা ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলো।
‘ইন্টারনেটের গতি কয়েকদিনের জন্য কমালে সেসব দিনে যে ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে, সেবিষয়ে সন্দেহ নেই।’
এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন বিদেশী আউটসোর্সিং সংস্থার সাথে ফ্রিল্যান্স ভিত্তিতে যারা কাজ করেন তারাও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে মনে করেন মি. হোসেন।
প্রভাব পড়বে দৈনন্দিন জীবনে
ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দিলে অনেক জরুরি সেবা দেয়া-নেয়াও বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন মি. হোসেন।
‘আমরা এখন যাতায়াতের ক্ষেত্রে টিকিট কাটা, সরকারি বিভিন্ন সেবা দেয়া-নেয়া বা ব্যাংকের লেনদেনের ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকি। ইন্টারনেট সেবার মান ব্যাহত হলে এই ধরনের কার্যক্রমও ব্যাহত হবে।’
মি. হোসেন বলেন,‘যখন দেশের সব ধরনের সেবা ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালনা করার লক্ষ্য নিচ্ছি আমরা, সেসময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া সেই লক্ষ্য অর্জনের পরিপন্থী একটি সিদ্ধান্ত।’
ব্যাহত হবে গণমাধ্যমের কার্যক্রম
নির্বাচনের সময় ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দিলে গণমাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পরবে বলে মনে করেন মি. হোসেন।
ইন্টারনেটের গতি কম থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মূল কার্যালয়ে অডিও, ভিডিও বা ছবি পাঠানোর ক্ষেত্রে জটিলতার সম্মুখীন হবেন গণমাধ্যম কর্মীরা।
সেক্ষেত্রে সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজ দারুণভাবে ব্যাহত হবে। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে খবর সংগ্রহ ও খবর প্রচার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
‘বাংলাদেশে কোনো খবর ছড়িয়ে পরার প্রধান মাধ্যম ফেসবুক। টেলিভিশন ক্যামেরা বা পেশাদার সাংবাদিকরা অনেকসময় বিভিন্ন ঘটনাস্থলে যেতে না পারলেও ফেসবুক লাইভ ফিচারের মাধ্যমে একজন মানুষ তার আশেপাশে কী ঘটছে তা তুলে আনতে পারেন সামাজিক মাধ্যমে।’
ইন্টারনেটের গতি কমে গেলে এই ফিচার ব্যবহার করা সম্ভব হবে না; যার ফলে খবর সংগ্রহ ও খবর প্রচারের কাজ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন মি. হোসেন।
নিরুৎসাহিত হতে পারেন বিনিয়োগকারীরা
মাঝেমধ্যেই ইন্টারনেট বন্ধ করা বা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়ায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি এর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও রয়েছে বলে মনে করেন মি. হোসেন।
‘সাম্প্রতিক সময়ে কোনো উন্নত দেশেই সঙ্কটের মুহূর্তে বা নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া বা গতি কমানোর নজির নেই; কিন্তু বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেইএ ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়,’ বলেন মি. হোসেন।
সামান্য কারণে ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত করে দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশের বাজারে বিনিয়োগে ইচ্ছুকদের নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
‘দেশী বা বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যখন দেখবে যে সামান্য কারণেই এখানে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয় বা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়া হয়, তখন তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।’
মি. হোসেন বলেন,‘বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে যদি এরকম একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয় যে বাংলাদেশে কিছুদিন পরপরই সামান্য কারণে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা এখানে ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন; যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে।’
মইনুল হোসেনের মতে,‘যতদিন পর্যন্ত আমরা সমস্যা সমাধানের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করতে চাওয়ার প্রবণতা দূর করতে না পারবো, ততদিন আমাদের পক্ষে ডিজিটাল সেক্টরে পূর্ণ সক্ষমতা পাওয়া সম্ভব হবে না।’