২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

লঘু পাপে গুরুদণ্ড : কাঠগড়ায় ইসি

লঘু পাপে গুরুদণ্ড : কাঠগড়ায় ইসি - ছবি : সংগৃহীত

একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান কয়েকজন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এ ছাড়াও ৭৮৬ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিলের মাধ্যমে নতুন রেকর্ডও গড়েন তারা। যদিও তফসিল ঘোষণার পরেই ছোটখাট ভুলের জন্য মনোনয়নপত্র বাতিল না করতে রিটার্নিং অফিসারদের উদ্দেশে পরিপত্র জারি করে ইসি। ইসির এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের এমন কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ক্রেডিট কার্ডের বিল, ইউটিলিটি বিল বকেয়া থাকায় প্রার্থীদের লঘু পাপে গুরুদণ্ড দেয়ায় এখন কাঠগড়ায় ইসি। 

ইসি সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা না নেয়ার অভিযোগে ছয় রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারা হলেন- ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, রংপুর, সাতক্ষীরা ও টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি)। তারা সবাই এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা। পৃথক সাতজনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি তাদের প্রতিবেদন দিতে বলেছে। 

জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মোহাম্মদ কাজী জাহাঙ্গীর। তার অভিযোগ, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৮ নভেম্বর বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গেলেও তার মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বরাবর আবেদন জানান তিনি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে ইসি। রংপুর-৫ আসনের প্রার্থী গোলাম রাব্বানীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করায় সিইসি বরাবর আবেদন করেন তিনি। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আবেদনটি সংযুক্ত করে রংপুর জেলার রিটার্নিং অফিসারকে কারণ ব্যাখ্যা করে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে।

এদিকে সাতক্ষীরা-৩ আসনে প্রার্থী আবু ইউসুফ মো: আবদুল্লাহ ১ ডিসেম্বর নির্বাচনে কমিশনে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করার বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। টাঙ্গাইল-৩ আসনের প্রার্থী মো: রেজাউল করিম ২৮ নভেম্বর মনোনয়নপত্র গ্রহণ করার বিষয়ে ইসিতে অভিযোগ করেন। ঢাকা-৯ আসনে প্রার্থী মির্জা আব্বাস ও ঢাকা-১৬ আসনের প্রার্থী মো: সাদাকাত খান ফাক্কু মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করা বিষয়ে অভিযোগ করেন। নরসিংদী তিন আসনের প্রার্থী মো: আব্দুল লতিফও মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করার বিষয়ে অভিযোগ দাখিল করেন ২৯ নভেম্বর। এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারদের নির্দেশ দেয়া হয়।


এদিকে যাচাই-বাছাইকালে ৭৮৬ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং অফিসাররা। এর মধ্যে বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি। ঐক্যফ্রন্টের ৮০ জনের মতো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। মনোনয়ন বাতিল হওয়াদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীও রয়েছেন। 

এর মধ্যে ঋণ ও বিল খেলাপি, দলীয় মনোনয়নে ত্রুটি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ না করা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন তালিকা সঠিকভাবে না দেয়া। ঢাকা, বগুড়া ও মানিকগঞ্জের তিনটি আসনে বিএনপি মনোনীত সব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় এ তিন আসনে দলটির কোনো প্রার্থীই এখন নেই। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে তিনটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন আদালতে দণ্ডের কারণে তা বাতিল ঘোষণা করা হয়। 

জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বিএনপির আমান উল্লাহ আমান, মীর মোহাম্মদ নাছির, এম মোর্শেদ খান, আফরোজা আব্বাসের মনোনয়ন বাতিল করেছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা। এ ছাড়া দলটির মূল প্রার্থীদের মধ্যে অর্ধশতাধিক নেতার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে বলে দলটির নেতারা দাবি করেছেন।

অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সামান্য ভুলের জন্য মনোনয়নপত্র বাতিল না করতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরিপত্রে বলা হয়, যদি বাছাইয়ের সময় এমন কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নজরে আসে যা তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধন সম্ভব, তা হলে মনোনয়নপত্র দাখিলকারীর দ্বারা তা সংশোধন করিয়ে নিতে হবে। ছোট-খাটো ত্রুটির জন্য কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল করা যাবে না। 

প্রার্থিতা ফিরে পেতে আপিল আবেদনের দ্বিতীয় দিনে ২৩৪ জন নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আটটি বিভাগের জন্য আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন চত্বরে আলাদা আলাদা বুথে আপিল গ্রহণ করেন ইসি কর্মকর্তারা।

এদিন আপিল আবেদনকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন বিএনপির ভাইস চেয়্যারম্যান ও ড্যাব মহাসচিব ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, নায়ক সোহেল রানা।

এর আগে সোমবার প্রথম দিন ৮৪টি আবেদন পড়েছিল। আজ বুধবার শেষ দিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। এরপর ৬, ৭ ও ৮ ডিসেম্বর শুনানি করে আপিল নিষ্পত্তি করবে কমিশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের ম্যানুয়ালেই বলা আছে, ছোট-খাটো ভুলত্রুটির জন্য মনোনয়ন বাতিল না করা; কিন্তু দেখা গেছে, সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার ক্রেডিট কার্ডের বিল বাকি থাকার জন্যও একজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে, সুস্থ বিবেচনায় এটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আবার দলের মহাসচিবের স্বাক্ষর নিয়ে সন্দেহের কথা তুলে ঢালাওভাবে কয়েকজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে, এটিও প্রশ্নের সৃষ্টি করে। তিনি আরো বলেন, শুধু সরকারবিরোধী জোটের মনোনয়ন বাতিলের ক্ষেত্রেই ছোটখাটো বিষয়গুলো আমলে নেয়া হয়েছে; কিন্তু সরকারি দলের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন নিজেদের আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুযোগ নিজেরাই তৈরি করে দিলো।

ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঋণখেলাপি হিসেবে বহুল পরিচিত রাঘববোয়ালের মনোনয়ন বৈধ হয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি শুধু ছোট ঋণখেলাপিদের ওপরই খড়গ চালানো হয়েছে, আর বড় খেলাপিদের ছাড় দেয়া হয়েছে? নির্বাচন কমিশনের এখন উচিত এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক নিরসন করা।  


আরো সংবাদ



premium cement