২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচন ঘিরে ফেসবুক ওয়েবসাইট নিয়ে নতুন পরিকল্পনা!

নির্বাচন ঘিরে ফেসবুক ওয়েবসাইটে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে - ছবি : সংগৃহীত

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলো কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে যাচ্ছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে মনিটরিং সেল গঠন করা হচ্ছে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিদেশ থেকে এ জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। সরকারের দৃষ্টিতে আপত্তিকর, ক্ষতিকর, বেআইনি লেখা বা পোস্ট ফিল্টারও বন্ধ করতে ডিভাইস বসানো হচ্ছে। স্পেনে তৈরি এসব ডিভাইস সরবরাহ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওয়েবসাইটগুলোর ওপর নজরদারি করার এই প্রকল্পে সরকারের খরচ হবে ১৪৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। টেকভ্যালি সল্যুশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে এই কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের বিষয়ে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একটি টিম ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। সরকারের সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স প্রজেক্টরের আওতায় এসব যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে যাতে কাজ শুরু করা যায় সে জন্য ডিভাইস ভিত্তিক নজরদারির এই যন্ত্রপাতি আমদানি ও প্রশিক্ষণের কাজ চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এই প্রযুক্তি কিওয়ার্ড পদ্ধতিতে ফিল্টারিং ও ব্লক করার কাজ করবে। এ প্রক্রিয়ায় ফেসবুক বা টুইটারের মতো মাধ্যমে লেখা বা চিহ্নিত কনটেন্টগুলোর হুমকি বিবেচনায় নিয়ে তা অপসারণ বা ব্লক করা হবে। 

প্রযুক্তিগত এই নজরদারির পাশাপাশি তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি মনিটিরিং সেলও এ ব্যাপারে কাজ করবে। জাতীয় সংসদে গত ২০ সেপ্টেম্বর তথ্যপ্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, গুগলসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। তিনি বলেছিলেন, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তথ্য মন্ত্রণালয় গঠিত এই গুজব মনিটরিং সেল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দেবে কোন তথ্যটি গুজব, জোনটি ভুয়া। আর সেই ‘পরামর্শ’ অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমগুলোকে প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। 

এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ফেসবুকের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকায় ফেসবুকের সঙ্গে এক বৈঠকে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বাংলাদেশীদের ফেসবুক আইডি খোলার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র এবং মোবাইলফোন নাম্বার বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছেন যাতে সরকারবিরোধী প্রচারণায় জড়িত ব্যক্তিকে সহজে চিহ্নিহ্নহ্নত করা যায়। 

সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের কর্মকাণ্ডের চিত্র যেভাবে উঠে আসছে তাতে আগামী নির্বাচনে এসব মাধ্যম শাসক দলের জন্য বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে তেমন কোনো সাংগঠনিক নেতৃত্ব ছাড়াই সারা দেশের শিক্ষার্থীরা সঙ্ঘবদ্ধ ও সুপরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমে পড়ে।

এসব আন্দোলনের পেছনে শিক্ষার্থীরা যেভাবে যুক্তি উপস্থাপন ও দ্রুত প্রচারণার কৌশল গ্রহণ করে তা মোকাবেলার মতো অবস্থা সরকারের ছিল না। এই আন্দোলনের কৌশল ও প্রভাব ভোটের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে মনে করে সরকারের নীতিনির্ধারকরা উদ্বিগ্ন। শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক এ দু’টি আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারি দলের নেতাকর্মী ও ছাত্র সংগঠনকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফেসবুককে সরকারের নীতিনির্ধারকরা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক মাধ্যম হিসেবে দেখছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ফেসবুক পেজ বন্ধ করা হয়েছে।

দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি বিশেষ করে স্মার্টফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে সংযুক্ত। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাব বলছে, দেশে ৯ কোটি পাঁচ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এর মধ্যে আট কোটি ৪৭ লাখজন মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দেশে মোবাইলফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটি পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন ১০ কোটি ৪১ লাখ মানুষ। এই হিসাবে অনুমান করা যায় দেশের প্রতিটি ভোটারের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে। ফলে বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে প্রচারণার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে ইন্টারনেট সংযুক্ত মোবাইল ফোন।

পৃথিবীর যেসব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ঢাকা হচ্ছে দ্বিতীয়। গত বছর (২০১৭) আন্তর্জাতিক দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথভাবে চালানো এক বৈশ্বিক জরিপে এ চিত্র পাওয়া গেছে। জরিপটি চালিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল’ আর কানাডাভিত্তিক ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান হুটস্যুইট। অনলাইনে প্রকাশিত ওই বছরের এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী আছে ব্যাংকক শহরেÑ তিন কোটি। এরপরই রয়েছে ঢাকা। এখানে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কী ধরনের সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে, সেদিকেও নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট গুজব ছড়িয়ে থাকে। অনলাইন মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব মহলের আপত্তি সত্ত্বেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছে। এই আইনের আওতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ পুরো ডিজিটাল মাধ্যম সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে , ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণœ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতার করতে পারবে।

আইনে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কেউ কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ, সংরক্ষণ বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন তার ভঙ্গ করলে এই আইনে তার সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে।

তা ছাড়া কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয় তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এ জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শন, তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ বা অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এ রকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনলাইন মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের প্রচারণা বন্ধ করতে নজরদারির পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে এই আইনের প্রয়োগ হবে। প্রয়োজনে অনলাইন ভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ন্ত্রণে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন ও সংযোজন করা হতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement