২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রমজান বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালে শুধু দীর্ঘশ্বাস

বৃদ্ধাশ্রমে রমজান
প্রতিকী ছবি - সংগৃহীত

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আয়োজনে ব্যস্ত প্রকৃতি; ম্লান আলোয় নিঃশব্দ-নিস্তব্ধ চার পাশ। অদূরে কোনো মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসছে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মোহনীয় সুরেলা ধ্বনি। ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলেও এখানকার সবার মাঝেই বিরাজ করছে অন্য রকম নীরবতা। জীবন যেন স্থবির এখানে। বেশ কয়েকজন অসহায় বাবা-মায়ের শেষ আশ্রয়স্থল বৃদ্ধাশ্রমে প্রথম রোজার ইফতার আয়োজনে নেই বাড়তি কোনো উৎসাহ। শুধু রমজান মাস নয়, সারা বছরই বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালে ঘুরে ফেরে দীর্ঘশ্বাস। তখনো ইফতারের কিছুটা সময় বাকি। সব মুসলিম পরিবারে সে সময় হয়তো ইফতারের আয়োজন চলছে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা গেল ওই বৃদ্ধাশ্রমে। নেই কোনো কোলাহল, কারো মাঝে নেই ইফতার নিয়ে বাড়তি কোনো আয়োজন।

রাজধানী ঢাকার পাশের একটি বৃদ্ধাশ্রম। প্রথম রোজার ইফতার। জীবনের শেষ সময়ে এসে পারিবারিক সমস্যাজনিত কারণে আশ্রয় নেয়া এসব বৃদ্ধ বাবা-মা সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারের সময় একত্রে বসে পড়েন ইফতারি খেতে। বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু, আলুর চাপ, খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের ইফতারির আয়োজন করা হয়। কিন্তু স্বজনেরা থাকেন না পাশে। কেউ বলে না; ‘মা আরেকটু শরবত নাও; আরেকটু মুড়ি নাও’।

হঠাৎ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনোয়ারা বেগম নামে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা বললেন, একদিন আমার সব ছিল। স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ছিল ভরা সংসার। এখন আমার কিছুই নেই। আমি নিঃস্ব, একা। ইফতারের কথা বলতেই থমকে যান এই বৃদ্ধা। বলেন, আগে রোজা মানেই ছিল এক অন্যরকম আনন্দ। শবে বরাতের পর থেকেই শুরু হয়ে যেত রোজার আমেজ। স্বামী-সন্তান নিয়ে একসাথে আনন্দ করতে করতে ইফতার করার মজাই ছিল আলাদা। সবার চাহিদা মতো ইফতারি বানাতাম। একসাথে বসে খেতাম। স্বামী-সন্তানদের মুখের হাসি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যেত। এখন রোজা কী আর ঈদ কী কিছুই বুঝি না। সব দিনই এক রকম লাগে। স্বামী নেই। দুই সন্তান প্রবাসে বসবাস করে। আমি বৃদ্ধাশ্রমে থাকি। আমার কেউ নেই।

কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের এক কোনায় বিশাল আকাশপানে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। হাতে ধরে রেখেছেন মোবাইল ফোন। পরিচয় প্রকাশ ও ছবি না তোলার শর্তে ওই বৃদ্ধ জানান, একমাত্র সন্তান যদি তাকে ফোন করে। ফোন করে যদি না পায়। এ জন্যই তার এ অপেক্ষা। একমাত্র সন্তান প্রবাসী। স্ত্রী মারা গেছে এক যুগ আগে। এর বছর দুয়েক পরই সন্তান পাড়ি জমান বিদেশে। তখন থেকেই এই বৃদ্ধাশ্রমই তার ঠিকানা। আজ এক গ্লাস শরবত আর কলা খেয়েই ইফতার করেন তিনি।

ইফতার শেষে মাগরিবের নামাজ আদায় করে দীর্ঘ সময় দু’হাত তুলে মোনাজাত করলেন একজন বৃদ্ধা। তার কাছে যেতেই দেখা যায়, একান্ত চিত্তে কিছু প্রার্থনা করছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। পরে কথা বলে জানা যায়, আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন সন্তানদের জন্য। ইফতারের পর দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ যেন তাদের ভালো রাখেন। এই বৃদ্ধার এক ছেলে দুই মেয়ে। প্রত্যেকেই তাদের সংসার, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে বাবার খোঁজখবর নেন তারা। এত কিছুর পরও বৃদ্ধ অবিরত তার সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়াই করেন।

এখানে বসবাসরতরা নিজ নিজ কক্ষে বসেই করেন ইফতার। একাকী তাদের এই জীবনের সঙ্গী হয় না কেউ। যারা নিবাসের মেসের খাবার খেতে আগ্রহী, তারা আগের দিন অর্ডার দিয়ে রাখেন ইফতারির। চাহিদা মতো ইফতারির সময় তাদের কক্ষে পৌঁছে দেয়া হয় খাবার। পিঁয়াজু, ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, খেজুর থাকে এ তালিকায়। আর যারা মেসে খেতে আগ্রহী নন, তারা নিজেরাই প্রস্তুত করেন খাবার। সে ক্ষেত্রে অনেকে ভাত-মাছ বা কলা-চিঁড়াকেই বেছে নেন ইফতার হিসেবে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রবীণ নিবাসে দেয়া হয় বাহারি ইফতার। কিন্তু সেসবেও আগ্রহ নেই সেখানে বসবাসরতদের। কোনো কিছুতেই সুখ নেই তাদের। মনের মাঝে শুধু শূন্যতা। রোজার সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখের পানি ফেলেছেন অনেকে। সবার গল্পই প্রায় একই রকম।

একদিন তাদের সব ছিল। স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ছিল জমজমাট সংসার। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে পার করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। রোজার দিনের আনন্দমুখর পরিবেশ, স্বামী-সন্তান নিয়ে একসাথে সেহরি, ইফতারের কথা বলতে বলতে হয়েছেন আবেগাপ্লুত। অনেকে ইফতারি হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেন। জীবনের শেষ সময় কলিজার টুকরা সন্তান কিংবা আপনজন ছাড়া ইফতার করতে হবে, এটা তাদের কল্পনার বাইরে।

অনেকে বলেন, এটা তাদের কপালের লিখন। এরপর আস্তে আস্তে নেমে আসে রাতের আঁধার; মনের গভীরে অনুভূত হয় এক বিশাল শূন্যতা। সব থেকেও যেন কিছুই নেই তাদের। আবার ভোর হয়; দিনের আলোয় চমকানো পৃথিবী অপেক্ষায় থাকে আরো একটি রাত্রির। বৃদ্ধাশ্রমের দেয়ালের চারপাশে প্রিয় মানুষের তরে ঘুরে ফেরে কিছু দীর্ঘশ্বাস।

 

প্রবাসীদের রমজান

আবু তাহের মিয়াজী

মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পুণ্যময় মাস হলো রমজান। যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য প্রতীক্ষা করে সবাই। তার জন্য পূর্বপ্রস্তুতিও নেয়। সব যুগে, সব দেশে, সব ধর্মের মানুষই এরূপ করে থাকেন। প্রবাসী মুসলমানেরাও ইবাদত-বন্দিগি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পুণ্যময় মাস হলো পবিত্র রমজান। পবিত্র রমজান মাস মুমিনের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের কারণ হয়ে আগমন করে। সুতরাং দেশের মতো প্রবাসীরাও রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার চেষ্টা করে থাকেন। শারীরিক, মানসিক, বৈষয়িক ও অভ্যাসগত- সব ক্ষেত্রেই পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়। রমজান পর্যন্ত আয়ু প্রলম্বিত করার জন্য প্রভুর দরবারে বেশি বেশি দোয়াও করতে থাকে।

প্রবাসীদের রমজান : যেহেতু হাদিসে পাওয়া যায়, হজরত রাসূলুল্লাহ সা: রজব মাস থেকেই রমজানের প্রতীক্ষায় থাকতেন। এ উপলক্ষে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণে মনোযোগী হতেন। রজবের চাঁদ দেখা দিলে আরো বেশি নফল রোজা রাখতেন। বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করতেন। কুরআনে কারিমের তিলাওয়াত বাড়িয়ে দিতেন। সঙ্গীদেরও রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন। আকাশে রজবের চাঁদ ওঠার সাথে সাথে নবী করিম সা: রমজান পর্যন্ত আয়ু বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। সাহাবিদেরও দোয়া করতে বলতেন। বেশি বেশি এ দোয়া পাঠ করতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাজান’। অর্থাৎ হে আল্লাহ, তুমি রজব ও শাবান মাসে আমাদের ওপর বরকত নাজিল করো এবং রমজান পর্যন্ত আমাদের হায়াত দীর্ঘায়িত করে দাও। সে হিসেবে প্রবাসীরাও বেশি বেশি কুরআন-হাদিস, ইসলামিক বই অধ্যয়নের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। পরিকল্পনা করেন, রমজান মাসে কুরআন মজিদ সহিহশুদ্ধ করে পড়ার! তবে অধ্যয়ন ও তিলাওয়াত দুটোই এক সাথে করার চেষ্টা করেন অনেকে। বেশির ভাগ প্রবাসী আবার সমাজের গরিব, অসহায়দের জন্য ইফতারসামগ্রী বিতরণ, ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন।

রমজান উপলক্ষে দেশে যেমন সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে কর্মসময় কম থাকে, প্রবাসেও তা-ই। আবার যারা দোকানপাট, মার্কেটে দায়িত্ব পালন করেন তাদের বছরের অন্য মাসের থেকে রমজানে দায়িত্ব বেড়ে যায়। তবে খুব একটা সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় ছোট দোকানগুলোতে। তাদের শিফট থাকে না, প্রায় ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। তবু যারা ইবাদত করার, এই ব্যতিব্যস্ত জীবনেও প্রভুকে স্মরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তবে কষ্ট হয় তাদের, যারা দালান নির্মাণের কাজ করেন তাদের। তাদের সেহরি খেয়েই কাজ শুরু করতে হয়। আবার অনেক কোম্পানি আছে এশার নামাজের পর কাজ শুরু করে সেহরির আগে ছুটি দিয়ে দেয়, তারা দিনে সুন্দরমতো রোজা রাখতে পারেন।

বাংলাদেশে যখন রমজানে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়; তখন অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশে ব্যবসায়ীরা সারা বছর ব্যবসা করেন আর রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষের সেবা করেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চলে সহজলভ্য করার প্রতিযোগিতা। প্রতিটি শপিং মলে চলে ডিসকাউন্ট। দেশের তুলনায় মুদিসামগ্রী সহজলভ্য এবং দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকায় সন্তুষ্ট থাকেন প্রবাসীরা। দেশের মতো প্রবাসেও ছোলা, বুট, আর তেলে ভাজা বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার ছাড়া রমজান মাস যেন কল্পনাই করা যায় না। তাই রমজান উপলক্ষে ব্যস্ততা বেড়ে যায় প্রবাসীদের।


আরো সংবাদ



premium cement