লাজুক সাপের এক ছোবলে মৃত্যুর কোলে শত মানুষ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ মে ২০১৮, ১০:৫০, আপডেট: ২৬ মে ২০১৮, ১৫:৫০
ভারতে সম্প্রতি সাপের কামড়ে এক নারী ও তার তিন বছর বয়সী কন্যাসন্তান মারা গেছেন। সাপের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বুঝতে না পেরে তিনি তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে শুরু করেন। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে মারা যান দু'জনই।
এ খবরটি এমন একটি দিনে পাওয়া যায় যেদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাপের দংশনের ঘটনাকে "বিশ্ব স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার" হিসেবে বিবেচনা করার ঘোষণা করে।
প্রতিবছর ৮১ হাজার থেকে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান, যার প্রায় অর্ধেক মৃত্যুর ঘটনাই ঘটে ভারতে।
কতটা গুরুতর এই সমস্যা?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়, যদিও সেসব ঘটনার অর্ধেকের কিছু বেশি ক্ষেত্রে আক্রমণ হওয়া ব্যক্তির শরীরে বিষ প্রবেশ করে।
সাপের আক্রমণের শিকার হওয়ার পর সারাবিশ্বে লক্ষাধিক মানুষ অন্ধত্ব বা চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এসব ঘটনাকে গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার সবচেয়ে উপেক্ষিত ব্যাধি বলে আখ্যা দিয়েছে।
সাব-সাহারান আফ্রিকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটে।
দরিদ্র গ্রামবাসীরা সাধারণত সাপের কামড়ের ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন। অনেক সময় প্রতিষেধক ও আধুনিক চিকিৎসার সুব্যবস্থা না থাকায় সনাতন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার কারণে দরিদ্র গ্রামবাসীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকে।
সাপের আক্রমণের হার প্রবল এমন অনেক দেশেরই নিজেদের প্রতিষেধক তৈরির ব্যবস্থা নেই। বিষক্রিয়ার প্রভাব দূর করতে বা কমাতে সাধারণত দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী সাপের আক্রমণ সংক্রান্ত বিষয়ে সব দেশে একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি হয়?
বিষাক্ত সাপকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
স্থায়ী দাঁতসহ সাপের বিষে সাধারণত নিউরোটক্সিক বিষ থাকে যা স্নায়ুতে আঘাত করে ও শ্বাস-প্রশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
অন্যান্য প্রজাতির সাপের দাঁত লুকানো থাকে যা সাধারণত শিকার করার সময় বা শত্রুকে আক্রমণ করার সময় ব্যবহৃত হয়। এই ধরণের সাপের আক্রমণে চামড়ার টিস্যু ক্ষিতগ্রস্ত হয় ও শরীরে অভ্যন্তরীন রক্তপাত হয় থাকে।
কোন সাপের বিষ সবচেয়ে বিষাক্ত?
কোন সাপের বিষ সবচেয়ে বিষাক্ত ও কোন ধরণের সাপ মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর তা নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
মাটিতে বসবাস করা যে কোনো সাপের মধ্যে সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ তাইপানের বসবাস অস্ট্রেলিয়ায়।
বলা হয়, এই সাপের এক ছোবলে যে পরিমাণ বিষ উদগীরণ হয় তা দিয়ে এক শ' জন মানুষ মারা যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত এই প্রজাতির সাপের দংশনে কোনো মানুষ মারা গেছে এমন খবর পাওয়া যায়নি।
এই প্রজাতির সাপ সাধারণত লাজুক প্রকৃতির হয়ে থাকে এবং দুর্গম জায়গায় বাস করে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় এর প্রতিষেধকও সহজলভ্য।
সামুদ্রিক সাপও অত্যন্ত বিষাক্ত হয়। তবে মানুষের সংস্পর্শে কম আসার কারণে এই সাপের কামড়ের ঘটনা বিরল।
অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত কিন্তু অত্যন্ত বিদজনক ব্ল্যাক মাম্বা ও উপকূলীয় তাইপান (অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়) মানুষের জন্য বেশি ঝুঁকির কারণ।
এ দুই ধরনের সাপই একই প্রজাতির এবং তাদের বিষ খুবই দ্রুত কাজ করে। সঠিক চিকিৎসা করা না হলে এই ধরণের সাপের কামড়ের শিকার ব্যক্তি আধা ঘণ্টার কম সময়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
কোন সাপের কামড়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়?
সাপের আক্রমণের সংখ্যা ও মৃত্যুহারের হিসেবে, অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ভাইপার (বোরা সাপ) সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। পশ্চিম আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধরণের সাপ পাওয়া যায়। এরা সাধারণত অন্ধকারে আক্রমণ করে।
সাপের কামড়ে বিশ্বে প্রতিবছর মৃত্যুর ঘটনার অর্ধেকই ভারতে হয় বলে মনে করা হয়। ভারতে যে চার ধরণের সাপের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় তাদের মধ্যে এই ভাইপার বা বোরা সাপ অন্যতম।
শীর্ষ চার প্রজাতির বাকিগুলো হলো :
ইন্ডিয়ান ক্রেইৎ বা কালাচ সাপ : যদিও দিনের বেলা এরা সাধারণত আক্রমণ না করলেও রাতে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। দৈর্ঘ্যে এরা ১.৭৫ মিটার (৫ ফুট ৯ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
রাসেল'স ভাইপার : ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক এলাকায় এই আক্রমণাত্মক সাপ দেখতে পাওয়া যায়। ইঁদুর প্রজাতির প্রাণী এদের প্রধান খাদ্য, তাই শহর ও গ্রামের লোকালয়ের কাছে এদের পাওয়া যায়।
ভারতীয় কোবরা বা গোখরা সাপ : ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই সাপ পাওয়া যায়। এরা সাধারণত রাতে আক্রমণ করে থাকে। এই ধরণের সাপের কামড়ে দেহে অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ হয়।
সাপ কামড়ালে কি করা উচিৎ?
সাপের দংশনের শিকার হলে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের পরামর্শ অনুযায়ী যা করণীয় তা হোলো:
- শান্ত থাকুন এবং অতিদ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
- শরীরের যে স্থানে সাপ কামড়েছে সেটি যতটা কম সম্ভব নড়াচড়া করুন। ঘড়ি বা অলঙ্কার পড়ে থাকলে তা খুলে ফেলুন। কাপড়ের বাঁধ ঢিলে করুন, তবে খুলবেন না।
নিম্নবর্তী কোনো পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করবেন না:
- কামড়ের স্থান থেকে চুষে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা।
- কামড়ের স্থান আরো কেটে বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ করে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা।
- বরফ, তাপ বা কোনো ধরনের রাসায়নিক কামড়ের স্থানে প্রয়োগ করা
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ফেলে যাওয়া
-কামড়ের স্থানের গিঁটের কাছে শক্ত করে বাঁধা। এর ফলে বিষ ছড়ানো বন্ধ হবে না এবং আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গুও হতে পারেন।
বিষধর সাপ ধরা থেকেও বিরত থাকা উচিত। এমনকি মৃত সাপও সাবধানতার সাথে ধরা উচিৎ, কারণ সদ্যমৃত সাপের স্নায়ু মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও সতেজ থাকতে পারে এবং তখন তা দংশন পারে। - বিবিসি
সাপ সম্পর্কে এই ধারণাগুলো ভুল
সাপ নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই কারোই। বেশকিছু ভুল ধারণাও আছে আমাদের। সাপের ক্ষমতা সম্পর্কেও রয়েছে সেই ভ্রান্ত ধারণাই। আর তাই অনেক সময়ই ভয়ের থেকেই মৃত্যু হয় মানুষের।
অনেকেরই ধারণা, হাসনাহানা বা সুগন্ধি ফুলের গন্ধে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে সাপ। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। সাপের ঘ্রাণ শক্তি অত্যন্ত দুর্বল। তাই তারা কোনো ফুলের গন্ধই পায় না।
বীনের তালে সাপের নাচ দেখে অনেকেই মনে করেন, সাপ দেখতে পায়। কিন্তু, মজার ঘটনা সাপের দৃষ্টি শক্তিও অত্যন্ত দুর্বল। সাপের কান নেই। শোনার জন্য সাপ জিভ বের করে। এই কারণেই সাপকে ঘনঘন জিভ বের করতে দেখা যায়। এছাড়াও সাপের পেটের তলায় আঁশে একধরণের স্নায়ুতন্ত্র থাকে। এই আঁশের সাহায্যেই মাটি থেকে উচ্চমাত্রার কম্পনযুক্ত শব্দ সংগ্রহ করে সাপ মস্তিষ্কে চালান করে দেয়। এইভাবেই সাপ কোনো বস্তুর অবস্থান কত দূরে তা বুঝতে পারে।
বিশ্বে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ আছে। আন্টার্কটিকা বাদে বিশ্বের সর্বত্রই সাপের দেখা মেলে।
সাপের খাদ্য তালিকায় থাকে ইঁদুর, পাখি, ব্যাঙ, বড় সাপ ছোট হরিণ, শূকর, বাঁদর। নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্যই সাপ আক্রমণ করে। তবে, আদতে এরা শান্ত ও নিরীহ প্রাণী।
৭০ শতাংশ প্রজাতির সাপই ডিম পাড়ে। সবথেকে বড় সাপ গ্রিন অ্যানাকোন্ডা, যা গড়ে ১৭ ফুট লম্বা হয়। সবথেকে ছোট সাপ বার্বাডোস থ্রেড স্নেক, মাত্র চার ইঞ্চি লম্বা হয় এ সাপটি। তবে, সবথেকে বড় বিষয় বিশ্বের বেশিরভাগ সাপই হয় নির্বিষ।
সাপ কেন মানুষের ঘরে বাসা বাঁধে?
বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাণীবিজ্ঞানী এবং 'ওয়াইল্ড টিম' নামে একটি সংস্থার প্রধান আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, মানুষের ঘরে সাপের আনাগোনা কোনো বিরল ব্যাপার নয়।
"গ্রামের দিকে মানুষের সাধারণত মাটির ঘরে থাকে। মাটির ঘরে সাপের আনাগোনা মোটেই বিরল নয়। আর রান্না ঘরে তো নয়ই। কারণ রান্নাঘরে খাবার খেতে ইঁদুর যায়। পোকামাকড় যায়। অতএব রান্নাঘরে সাপ আনাগোনা করবেই"।
"আমরা একটি গবেষণায় দেখেছি যে, অনেক গ্রামে মানুষের ঘরের ভেতর গোলাঘর থাকে। এবং গোলাঘরে যে ধান থাকে, তার জন্যই ইঁদুর কিন্তু সেখানেও যেতে পারে। ইঁদুর যেখানে যাবে, সাপও সেখানে যাবে।"
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কোনো কোনো সাপ এক শ' পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। এর মধ্যে যদি পঞ্চাশটা ডিমও ফোটে, পঞ্চাশটা সাপের বাচ্চা থাকতে পারে।
তিনি বলেন, সাপের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুনোর পর সেগুলো একসময় আবার জঙ্গলেই চলে যায়।
বছরের ঠিক এসময়টাই কেন সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়?
সাভারের বেদেপল্লীর সাপুড়ে রমজান আলী বলছেন, বর্ষার শুরুতে সাপের উপদ্রব বাড়ার কারণ আছে।
"এই যে বর্ষা মওসুম এখন, আষাঢ় মাস। বর্ষার পানিতে চারদিক ভরে যায়। ফলে ধানখেতে বা জঙ্গলে যে সাপ থাকে, বিষধর সাপ, সেগুলো তখন মানুষের বাড়িতে চলে আসে। আর বর্ষা আসার মুহূর্তে সাপ ডিম পাড়ে। তখন ডিম পাড়ার জন্যও তারা উচু জায়গা খোঁজে।"
রাজশাহীর দুটি ঘটনাতেই যে সাপগুলোকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, তাতে দুঃখ পেয়েছেন রমজান আলী।
"সাপ যখন মেলে ফেলে তখন আমাদের কাছে খুব কষ্ট লাগে। আমরা তো এই সাপ দিয়েই আয়-রোজগার করি। আমরা কষ্ট পাই। কষ্ট লাগে।'
রমজান আলী বলেন, বাংলাদেশে সাপের সংখ্যা এখন অনেক কমে গেছে। - বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা