২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
তাবলীগ জামাত

সা’দপন্থীদের মসজিদ থেকে বের করে দিলো জোবায়েরপন্থীরা

তাবলীগ জামাতের জোবায়েরপন্থীরা একই সংগঠনের সা’দপন্থীদের মসজিদ থেকে বের করে দিলে তারা মসজিদের পাশেই ত্রিপল টঙ্গিয়ে অবস্থান করেন - নয়া দিগন্ত

মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা তাবলীগ জামাতের মাওলানা সা’দ অনুসারীদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোববার গাজীপুরের শ্রীপুরের একটি মসজিদে এই ঘটনা ঘটে।

এলাকাবাসী জানায়, এবারের বিশ্ব ইজতেমা শেষে মাওলানা জোবায়ের অনুসারী দিনাজপুরের বোঁচাগঞ্জ উপজেলার এক চিল্লার একটি জামাত তাবলীগের দাওয়াত নিয়ে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান থেকে বের হয়। জামাতটি শনিবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলীহাটি ইউনিয়নের সাইটালিয়া পশ্চিম পাড়া কাছম আলী জামে মসজিদে এসে অবস্থান নেয়।

এদিকে মাওলানা সা’দপন্থী তাবলীগের একটি জামাত মসজিদে এসেছে খবর পেয়ে মাওলানা জোবায়ের অনুসারীরা সেখানে গিয়ে তাদের বাঁধা দেয়। একপর্যায়ে রোববার সকালে ওই মসজিদ থেকে সা’দ অনুসারীদের বের করে দেয় মাওলানা জোবায়ের অনুসারীরা। পরে মাওলানা সা’দ অনুসারীরা মসজিদের পার্শ্ববর্তী আবুল কালামের বাড়ির আঙিনায় ত্রিপল টাঙ্গিয়ে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। খবর পেয়ে দুপুরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় পাশের অপর একটি মসজিদে তাদেরকে সরিয়ে নেন।

মসজিদ কমিটির সভাপতি গোলাম রসুল টিটু জানান, এ বিষয়টি তার এখতিয়ারের বাইরে। এ ব্যাপারে মসজিদ পরিচালনা কমিটির ক্যাশিয়ার নাসির উদ্দিন, মসজিদের ঈমাম আল আমিন, তাইজ উদ্দিন, হাফিজসহ মসজিদ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও জানান তিনি।

তবে এ বিষয়ে স্থানীয় আব্দুস সামাদের ছেলে জোবায়েরপন্থী নাসির উদ্দিন জানান, যত ঝামেলাই হোক, কোনো অবস্থাতেই সা’দ অনুসারী লোকজনকে মসজিদে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। তাদের অনুরোধ করা হয়েছে এ মসজিদ ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও অবস্থান নিতে।

তাবলীগ জামাতের আমির রবিউল ইসলাম জানান, আমরা আল্লাহর রাস্তায় মেহনত করতে এসেছি, রোববার আমাদের মসজিদ থেকে বের করে দিলে মসজিদের বাইরে ত্রিফল টাঙ্গিয়ে খোলা আকাশের নীচে অবস্থান আমরা করেছি। তবে আল্লাহর রাস্তায় আমাদের চেয়েও কঠিন অবস্থায় ছিলেন আমাদের রাসুল। মহান আল্লাহর কাছ থেকে সিদ্ধান্ত প্রার্থনা করে আজ সবাই রোজা রেখেছি।

এ ব্যাপারে শ্রীপুর থানার ওসি জাবেদুল ইসলাম জানান, তাবলীগের মতবিরোধ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় তাদের দু’গ্রুপের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। ফলে তাবলীগের বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে এক মতাদর্শের অনুসারীরা নিজেদের মসজিদে তাবলীগের অন্য মতাদর্শীদের বাধা দিচ্ছে।

আরো পড়ুন: তাবলীগ জামাতে দু গ্রুপে দ্বন্দ্বের কারণ কী ?
বিবিসি, (০১ ডিসেম্বর ২০১৮)

বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের ভেতরে দু'টি গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছে বেশ কিছুদিন ধরে - যা সহিংস রূপ নিয়েছে শনিবারের সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে । এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আছেন তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা ভারতীয় মোহাম্মদ সাদ কান্দালভি।

এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই ঢাকার টঙ্গীতে এবার বিশ্ব ইজতেমার একটি তারিখ ঘোষিত হলেও পরে তা হয় নি।

তাবলীগ জামাতের একটি গ্রুপ ১১ই জানুয়ারি থেকে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত মাসে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপকে নিয়ে বৈঠক করেন - যেখানে ওই তারিখে ইজতেমা না করার সিদ্ধান্ত হয়।

কিন্তু সাদ কান্দালভি কি করেছেন বা বলেছেন - যা নিয়ে এই বিভক্তি?

বেশ কিছু কাল ধরেই কান্দালভি তাবলীগ জামাতে এমন কিছু সংস্কারের কথা বলছেন - যা এই আন্দোলনে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।

সাদ কান্দালভি বলেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়’ - যার মধ্যে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকান্ড পড়ে বলে মনে করা হয়।

সাদ কান্দালভি আরো বলেন, ‘মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত - যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।’

কিন্তু তার বিরোধীরা বলছেন, সাদ কান্দালভি যা বলছেন - তা তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের নির্দেশিত পন্থার বিরোধী। তাদের বক্তব্য, কান্দালভির কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া'ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।

সাদ কান্দালভির বিরোধী একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতার মতে, সাদ কান্দালভি এখনো এ মতবাদ ছাড়েন নি। ‘তাই এটা যেন বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে এবং মুসলিমরা যেন পথভ্রষ্ট না হয়, সে জন্য তারা কাজ করে চলেছেন।’

তিনি দাবি করেন, এর মধ্যে এক কণাও রাজনীতি নেই।

ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন এই তাবলীগ জামাতের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে - যখন তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়।

এর পর এ বছর জুলাই মাসে ঢাকায় কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমদ শফী'র উপস্থিতিতে তাবলীগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলন হয় । এতে সাদ কান্দালভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

ঢাকার মোহাম্মদপুরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় - দিল্লিতে তাবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাদ কান্দালভির বক্তব্য ও মতবাদকে অনুসরণ করা হবে না, এবং আগামী বিশ্ব ইজতেমার সময় তাকে বাংলাদেশে আসতেও দেয়া হবে না।

কিন্তু মি. কান্দালভির সমর্থকরা বলছেন,তাদের নেতার বক্তব্য বা সংস্কারের প্রস্তাব মানতে না পেরেই বাংলাদেশে সংগঠনটির কর্মকান্ডকে 'রাজনৈতিক চেহারা' দেয়া হয়েছে।

তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির এসব চিন্তাভাবনা নিয়ে তাবলীগ জামাতের দু'টি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের প্রভাব গত ইজতেমাতেও পড়েছিল।

সে সময় এ নিয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে - যখন কান্দালভি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেও ইজতেমা প্রাঙ্গণে যেতে পারেন নি।

কান্দালভি তার বিরোধী পক্ষের প্রতিবাদের মুখে ঢাকায় তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় কাকরাইল মসজিদ অবস্থান নেন, এবং পরে সেখান থেকেই দিল্লী ফেরত যান। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী এখনো তবলীগ জামাতের প্রধান দফতর কাকরাইল মসজিদেই অবস্থান করছেন, কিন্তু কার্যক্রম চালাচ্ছেন আলাদা আলাদা ভাবে।

কান্দালভির সমর্থক গোষ্ঠীর একজনের মতে, তাবলীগ জামাতের ৯০ শতাংশই ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’ বা সা’দ কান্দালভি-র অনুসারী হিসেবেই আছেন। কিন্তু তার কিছু কথাকে একটি গোষ্ঠী সহজভাবে নিতে পারছেন না।

তার বিরোধীদের পেছনে কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের লোকেরা সক্রিয় বলে বলা হলেও - হেফাজতের নেতারা এ অভিযোগ সরাসরি স্বীকার করেন না।

হেফাজতে ইসলামের একজন উর্ধতন নেতা মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বিবিসিকে বলেছেন, এখানে হেফাজত বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কোন সম্পৃক্ততা নেই।

এ বিরোধ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের তাবলীগ জামাতের অনুসারীদের মধ্যে। ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের বিভক্তি দেখা দিয়েছে অনেকদিন আগেই।

বিরোধ মেটানোর চেষ্টা থাকলেও তাতে এখনো ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।


আরো সংবাদ



premium cement