২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঢাকা কেন্দ্রিক উন্নয়নই জলাবদ্ধতার মূল কারণ

ঢাকার চারনদী ও ৪৩ খাল উদ্ধারের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দিতে হবে
সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তায় পানি জমে যায়। ছবি সংগৃহীত -


জলাবদ্ধতা বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, খাল, জলাধার ও নিম্নাঞ্চল দখল-ভরাটের কারণে ঢাকাশহরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন নালাগুলোয় প্রভাবশালীমহলের দখলদারিত্ব চলছে। এসব দখলমুক্ত করা এতই কঠিন হয়ে পড়েছে যে, একটি খাল উদ্ধার করতে গেলে সরকার পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এজন্য এখন ঢাকাকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে হলে ঢাকার চারপাশের নদী ও বিদ্যমান ৪৩ খালসহ একটি প্রকল্প করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম-বাংলাদেশের (সিডিজেএফবি) উদ্যোগে “রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতিবন্ধকতা ও উত্তোরণের উপায়” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। সিডিজেএফবির সভাপতি অমিতোষ পালের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মতিন আব্দুল্লাহর সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মোঃ জামাল মোস্তফা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-সিপের নির্বাহী পরিচালক ফজলুল হক চৌধুরী, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মারফি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল, ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশরী মোঃ শরীফ উদ্দিন, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম, ঢাকা ওয়াসার পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন, ডিএসসিসির কাউন্সিলর সুরাইয়া বেগম, সিনিয়র সাংবাদিক তৌফিক আলী প্রমুখ। লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক।

ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানের জন্য চারপাশের নদী ও খালগুলোকে দখলমুক্ত করে নাব্যতা ও পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। জানি, এটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। একটি খাল উদ্ধার করতে গেলে সরকারও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কেননা, অত্যন্ত প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে খালগুলো। এজন্য ঢাকার চারপাশের নদী ও খালগুলোকে প্রবহমান করতে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মোঃ জামাল মোস্তফা বলেন, ঢাকা শহরের পানি কোথায় সরাবো? বুড়িগঙ্গার তলদেশে ময়লা-আর্বজনা। আমার জীবনে কখনো দেখিনি এই নদী ড্রেজিং করতে। তুরাগ, বালু দখলদারকে কবলে। ৭০-৭৫টি খাল ছিল, অথচ এখন ৪৩টির চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলোও দখলদারদের কবলে। নানামুখি উদ্যোগ নিয়েও সেবাসংস্থাগুলো এসব খাল দখলমুক্ত করতে পারছে না। এ সমস্যার জন্য ঢাকার চারপাশের নদী ও ৪৩ খালকে একটি প্রকল্পের আওতায় এনে ড্রেজিং করে প্রবাহমান করতে হবে। প্রভাবশালী দখলদারদের খাল থেকে হঠাতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-সিপের নির্বাহী পরিচালক ফজলুল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকাকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন কাজ হওয়াতে ঢাকামুখি মানুষের চাপ বাড়ছে। আর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এই শহরে বসবাস করায়, সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মারফি বলেন, ঢাকায় এখন এক কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যা। আর এই জনসংখ্যা প্রতিবছর চার ভাগ হারে বাড়ছে। ঢাকার সমস্যার লাগাম টেনে ধরার এখনই সময়। দেরি করলে এই শহরকে বাসযোগ্য রাখা সম্ভব হবে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, নদী ও খালের দখলদারিত্ব দেখভালের দায়িত্ব যাদের, তারা সঠিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করছে না। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। এ কারণে ঢাকাশহরের আশপাশের সকল নিচুভূমি ও জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। এখন ২৬টি খালও সচল নেই। ঢাকার জলাদ্ধতা নিরসন করতে হলে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীভূত করতে হবে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, গত কয়েকবছর ধরে উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, মেগা প্রকল্পের দিকে সরকারের আগ্রহ বেশি। কোন প্রকল্পে জনগনের দুর্ভোগ ও পরিবেশকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। তাছাড়া যে কোন বাসযোগ্য শহরের জন্য ১২-১৫ ভাগ জলাধার ও ২০-২৫ ভাগ উন্মুক্ত জায়গা থাকা দরকার। কিন্তু এগুলো আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। বিদ্যমান ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সক্ষমতা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮০-৯০ ভাগ করা গেলে শহরের বিদ্যমান জলাবদ্ধতা থাকার কথা না।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, জাইকার সুপারিশ অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫০-১০০ একর জলাধার, খাল ওই সময় অধিগ্রহণ করেছিল। এখন ঢাকা শহরে জমির অধিগ্রহণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারি কোন সংস্থা জমি অধিগ্রহণ করতে চাচ্ছে না। কিন্তু শহরের বাস্তববতায় জলাবদ্ধতাসহ বেশকিছু সমস্যার সমাধানে জমি অধিগ্রহণ খুবই জরুরী। এখন এটা করা না গেলে ভবিষ্যতে অধিগ্রহণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভভ হবে না। আর বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বৃষ্টির পানি নদী পর্যন্ত প্রবাহ তৈরি করতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, ঢাকাশহরের ১২-১৫ ভাগ জলাধারের জায়গায় রয়েছে মাত্র ২ ভাগ। এই অবস্থায় পানি নিষ্কাশন কাজ খুবই দূরহ। তবে বিদ্যমান জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধানে ঢাকা ওয়াসা রুটিন কাজের পাশাপাশি মেগা প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধে প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ঢাকাওয়াসা পানি নিষ্কাশন নর্দমা দিয়ে পয়:নিষ্কাশন কাজ করছে। আর কোন ধরনের পরিশোধন ছাড়াই সেসব পানি খাল ও নদীতে ঢেলে দিচ্ছে। এর ফলে নগরীর আশপাশের জলাভূমি ও চারনদী দূষিত হচ্ছে। এছাড়াও তিনি, খাল উদ্ধার, খাল খনন, প্রশস্তকরণ এবং ঢাকা শহরের ড্রেনেজ বিভাগের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাতে ন্যাস্ত করার পরামর্শ দেন।

অনুষ্ঠান শেষে জলাবদ্ধতা বিষয়ক প্রতিবেদন তৈরির জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন সিপ-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ১১ জন সাংবাদিককে ফেলোশিপ দেয়া হয়। ফেলোদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন ফজলে হোসেন বাদশা এমপি।


আরো সংবাদ



premium cement