২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘আতুরে নিয়মো নাস্তি’

-

একটা বিষয় লক্ষ করেছি, বর্তমান বিশ্বে এবং বিশেষত মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে যদি কেউ ইসলাম বা কুরআন হাদিসের বাণীর আলোকে কোনো বিষয় বিচার করতে যান, তখনই কেউ কেউ এটাকে ‘মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি’ বলে হালকা করে দিতে চান। অন্য কোনো ধর্মীয় নীতি বা আদর্শের প্রবক্তাকে তারা এ দৃষ্টিতে দেখেন না। যে কারণে ইসলাম আজ বিশ্বে তাদের কাছে একটি অগুরুত্বপূর্ণ ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের মতো আমরা ইসলামকে একটি পরিপূর্ণ দ্বীন বা জীবনবিধান হিসেবে বিশ্বাস করি। আর এরই সূত্র ধরে ইসলামের নীতির আলোকে বিবেচনা করতে বলি যে, দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া বার্ধক্য এবং বিভিন্ন প্রকার শারীরিক রোগশোক নিয়ে বছরোর্ধ্বকাল ধরে কারাবন্দী আছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের, বিশেষত তার আত্মীয়স্বজন যারা মাঝে মধ্যে তাকে কারাগারে দেখতে যান, তাদের মতে সাবেক পিজি হাসপাতাল ও বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি ভালো নেই। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে বা বিদেশে চিকিৎসা লাভের জন্য তাকে জামিন বা মুক্তি দেয়া অত্যাবশ্যক। হাসপাতালের সরকারি ডাক্তারদের মতে, তিনি ভালোই আছেন।

খালেদা জিয়ার মুক্তি বা জামিনের ব্যাপারে সরকার পক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, ‘এটা আদালতের ব্যাপার। এ ব্যাপারে সরকারের কিছুই করণীয় নেই।’ বুঝলাম সরকার বা আদালতের দেশের প্রচলিত আইনের বাইরে কিছু করার নেই। তবু কিছু কথা থেকে যায়। যে আইনের দোহাই তারা দিচ্ছেন তা মনুষ্যসৃষ্ট আইন। আল্লাহ তায়ালা বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁর নিজস্ব আইনও শিথিল করার বিধান রেখেছেন। পবিত্র আল কুরআনে উল্লেখ আছে- ‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত এবং যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, তবে কেউ নিরুপায় হয়ে পড়লে, যদি সে স্বাদ গ্রহণেচ্ছু না হয় এবং সীমালঙ্ঘনকারীও না হয় (সে যদি খায়) তবে আল্লাহ তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা-১৬ : আয়াত-১১৫)। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তা মাফ করে দেবেন। খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য কারামুক্তি অত্যাবশ্যকীয়। কারা কর্তৃপক্ষ বা সরকার যা-ই বলুন না কেন, তার জীবন রক্ষার্থে উন্নতমানের চিকিৎসা একান্ত জরুরি। তিনি হয়তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মতো ৪ মার্চ ২০১৯ সালে যেমন ছিলেন তেমন লাইফ সাপোর্টে যাননি, তবে তিনি যেন সে অবস্থায় না যান সেজন্য এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ওবায়দুল কাদের আবার বিএসএমএমইউতে ভর্তি হয়েছেন। তার দলীয় সহকর্মীরা বলছেন, প্রয়োজনে তাকে চিকিৎসার জন্য আবার সিঙ্গাপুর নেয়া হবে। জীবন বাঁচানোর প্রশ্নে সবার সমান অধিকারই কাম্য। আল্লাহ না করুন জেলে যদি খালেদা জিয়া মারা যান, এটিকে দেশের লোক তাকে হত্যার শামিল বলে গণ্য করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক বলেন- ‘কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করল; যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে, তবে সে যেন গোটা মানব জাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো।’ (সূরা ৫ : আয়াত-৩২)। গোটা মানব জাতিকে বাঁচিয়ে দেয়াই মানুষের কাজ।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, ‘বিএনপি তাদের নেতাকে কারামুক্ত করতে আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে; বিএনপির আন্দোলন করার সক্ষমতা নেই।’ এসব কোনো দায়িত্বশীল নেতার উক্তি হতে পারে না। ক্ষমতা থেকে গেলে এদের কেউ মনে রাখেন না। আন্দোলন মানেই ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি। বিএনপিও বলছে, আইনের মাধ্যমে নয়, আন্দোলনের মাধ্যমেই তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফিতনা-ফাসাদ হলো হত্যার চেয়েও গুরুতর।’ (সূরা ২ : আয়াত-১৯১)। একজন মুসলমান হিসেবে অপর এক মুসলমানকে এরূপ করতে আহ্বান করা নাজায়েজ। আওয়ামী লীগের নেতারা আরো বলেন, খালেদা জিয়া ২১ আগস্ট ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার জন্য দায়ী। সত্য বটে তার আমলে এমন একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তবে এ ঘটনাস্থল থেকে তিনি অনেক দূরে এবং তিনিই এ ঘটনা ঘটানোর জন্য হুকুম দিয়েছেন এমন চাক্ষুষ প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। এ ছাড়াও ‘কিসাসের’ নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি তাদের জন্য বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে জখম হলো কিসাস। তারপর কেউ তা ক্ষমা করলে তাতে তারই পাপ মোচন হবে।’ (সূরা ৫ : আয়াত - ৪৫)।

এ বিশ্বজগতে এমন কে আছেন যে কম-বেশি পাপ করেননি? জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথায়, ‘আদম হইতে শুরু করে এই নজরুল তক সবে/ কম-বেশি করে পাপের ছুরিতে পুণ্য করেছে জবেহ।’ এসব সত্যবাদী মানুষেরই কথা। আমাদের সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গহণ করতে হবে। সে কথা স্মরণ করেও তো খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কিছুটা হলেও পাপের ভার লাঘব হবে। শেষ বিচারের দিন আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার সম্বল লাভ করা যাবে। এ বিষয়টি তাদের মাথায় রাখা উচিত।

তা ছাড়া ‘আতুরে নিয়মো নাস্তি’। সেটার প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিয়ম বা আইন যা-ই বলি না কেন তা শিথিল করেছেন (সূরা ১৬ : আয়াত-১১৫)। এর থেকে প্রমাণ হয় মানুষের জীবন রক্ষা প্রাথমিক দায়িত্ব। এটি খোদায়ী গুণ এবং মানুষের প্রতি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। আল কুরআনে উল্লেখ আছে, ‘তুমি (আল্লাহ) যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও; যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত করো এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত করো। সমস্ত কল্যাণ তোমারই হাতে।’(সূরা ৩ : আয়াত-২৬)। মানব কল্যাণের জন্যই আল্লাহ তায়ালার আইন। প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিকদের মতে, মহাবীর আলেকজান্ডার খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে পাঞ্জাবের হিডাসপেসের যুদ্ধে রাজা পুরুকে পরাজিত করে বন্দী করেন। কথিত আছে, পুরুর পরাজয় এবং বন্দিত্বের পর মহাবীর আলেকজান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি তার কাছে কেমন আচরণ আশা করেন। যদিও পরাজিত এবং বন্দী, তবুও পুরু গর্বভরে উত্তর দেন তিনি রাজার মতো আচরণ চান। মহাবীর আলেকজান্ডার তার শত্রুর উত্তরে এতটাই অভিভূত হন যে, তার রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দেন। এটাই রাজ ধর্ম। খালেদা জিয়াও এককালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আপসহীন নেত্রী বলে তিনি সুপরিচিত। আজো কারাগারে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়া আপসহীন। তার এই সাহসিকতা ও আপসহীনতার জন্যও তিনি পুরস্কৃত হতে পারেন। আলেকজান্ডার যেমন পুরুকে পুরস্কৃত করেছিলেন। একজন বীরের মর্যাদা একজন বীরই বোঝেন এবং তা দিতে পারেন।

এ ছাড়াও কেবল খ্রিষ্টপূর্ব পুরুর কালেই নয়, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসেও মহান ব্যক্তিদের বদান্যতার উদাহরণ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের সোনালি দিনগুলো যে শ্বেতাঙ্গরা ২৭ বছর তাকে জেলে রেখে বিষিয়ে তুলেছিল, তার মুক্তির পর তিনি তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। এর পরিবর্তে তিনি তাদের সাথে মিলেমিশে দেশ শাসন করে জগতের ঘরে ঘরে নন্দিত হয়েছেন। তার নাম পৃথিবীর সব শিক্ষিত লোকমাত্রই জানেন এবং শত্রুর প্রতি বদান্যতা প্রদর্শনকারী হিসেবে স্মরণ করেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী ও এসব উদাহরণ স্মরণ করতে বলব। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা যদি বিএনপি শাসনামলে কারাগারে এরূপ হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির শিকার হতেন, তবে আমি আমার এ নিবন্ধে খালেদা জিয়ার মুক্তির পক্ষে যা বলেছি তা-ই বলতাম।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তকরণ’ (সূরা ৬৭ : আয়াত-২৩)। আল্লাহ তায়ালার এসব কল্যাণকর দান খোদায়ী দান হিসেবে চর্চা করা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষ ও শাসকের কর্তব্য বলে বিবেচ্য। এই বিশ্বাসে আমাদের অন্তকরণের প্রসারতা ঘটিয়ে মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের পরিবর্তে দয়া ও ক্ষমাসুলভ কল্যাণকর আচরণ কাম্য। বিশেষত দলমতের পার্থক্য ভুলে আর্তের সেবাই মানুষের অন্যতম প্রধান কাজ। সেই কাহিনী তো আমরা সবাই জানি, যে বৃদ্ধ মহিলা রাসূলে করিম সা:-এর পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন, সে মহিলা যখন অসুস্থ হলেন রাসূলে করিম সা: নিজে সেবা করে তাকে সুস্থ করেছেন। এসব উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেয়া আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি বিশ্বাসী বান্দা ও নবীজী সা:-এর প্রতিটি উম্মতের কর্তব্য। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া যায়, দেশের মনুষ্যসৃষ্ট আইনের নিরিখে নয়।

মনে রাখা জরুরি- ‘আল্লাহ সারা জাহানের প্রতিপালক; তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু; বিচার দিনের মালিক।’ (সূরা ১ : আয়াত ১-৩)। এ ভেবে আমাদের আশ্বস্ত ও সাবধান হওয়া জরুরি।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক


আরো সংবাদ



premium cement