২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সমাজের সর্বগ্রাসী পচন রুখতে হবে

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন - ছবি : সংগ্রহ

সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, শ্রদ্ধাভক্তি-ভালোবাসা, ভালো-মন্দ বিবেচনাবোধ, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য-জ্ঞান, দেশপ্রেম, সুশাসন ও সামাজিক বন্ধন বর্তমান বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে গেছে। সমাজের এসব অতিপ্রয়োজনীয় উপাদানের পরিবর্তে শক্তভাবে স্থান করে নিয়েছে ব্যক্তিস্বার্থ, গায়ের জোরে আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতা দখল, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, খুন, গুম, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকাসক্তি ও অপশাসন। ফলে সমাজের সব ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী পচন ধরেছে। সরকার থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তার বিধ্বংসী পরিণতি সবার কাছে দৃশ্যমান হয়ে গেছে।

এ অবস্থার জন্য সমাজ বিজ্ঞানের বিবেচনায় বর্তমান সমাজে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও পেশাগত অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং সার্বিকভাবে সামাজিক বন্ধনে শৈথিল্যকে মূলত দায়ী করা হবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মীয় আচার-আচরণের প্রতি অবজ্ঞা, ধর্মীয় শিক্ষাকে অমান্য করা এবং ভালো-মন্দ ও ধর্মীয় বিধিনিষেধকে সগর্বে উপেক্ষা করার ফলে সমাজের এই পচন হয়েছে বলে ধারণা করা হবে। কারণ যাই হোক না কেন, সমাজের সর্বক্ষেত্রে মূল্যবোধের অভাবে দেশ ও জাতি যে অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, তা আজ সবার কাছেই দৃশ্যমান।

আমাদের সংবিধানে মানুষের ওপর মানুষের শোষণমুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ এবং একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছে (সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১০ ও ১১)। এই প্রত্যাশা ও চেতনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষ জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে, লাখো লাখো মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছে এবং হাজার হাজার মা-বোন নির্যাতিত হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও কর্মকাণ্ডে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই। সরকারের মূল তিনটি অঙ্গ- নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী সরকারের দলীয়করণ, নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ চাপের কারণে অকার্যকর এবং ধ্বংসের খাদের কিনারায় উপনীত হয়েছে।

সরকারের অপর একটি অঙ্গ-সংবিধানের সপ্তম ভাগে বর্ণিত ‘নির্বাচন’। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, কারচুপি, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক ও পদলেহী আচরণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য করা হয়েছে। শুধু কর্তৃত্ববাদী সরকারকে টিকিয়ে রাখা এবং এক ব্যক্তির শাসনকে পাকাপোক্ত করার স্বার্থেই সংবিধানের বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের কাজকর্ম চলছে। ফলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয় অর্থনীতির ভিত ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। দেশের মালিক জনগণ। আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত এই জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈষম্যমুক্ত সমান অধিকার এবং ভোটের অধিকারসহ সব অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। ফলে সমাজের সব অঙ্গে আজ পচন লেগেছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই বিধ্বংসী পচন থেকে সমাজকে রক্ষা করা আজ সময়ের দাবি এবং সবার পবিত্র দায়িত্ব।
সব দেশেই রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় সে দেশের রাজনীতি মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে যে রাজনীতি চলছে, তা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে আবর্তিত।

রাজনীতিতে বর্তমানে নীতি, আদর্শ ও গঠনতন্ত্র অনুপস্থিত। ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা ও খায়েশই রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের কাছে আজ দেশের স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থ নিদারুণভাবে পরাজিত। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থচরিতার্থ করতে গিয়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ২৯ ডিসেম্বর রাতেই শেষ করা হয়েছে। প্রশাসন ও সরকারি দলের কর্মীরা একযোগে ভোট ডাকাতি করে জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাই বর্তমান সংসদ ও সরকার জনগণের নয়। এটা মূলত একটি রাজনৈতিক দল এবং সরকারি সুবিধাভোগী একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সরকার। জনগণের প্রতি এই সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই বলেই সমাজের সব ক্ষেত্রে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সমাজের সব ক্ষেত্রে নীতিহীনতা, নৈরাজ্য, হতাশা, দুর্নীতি এবং পেশি ও অর্থশক্তির দানবীয় দাপট সীমা লঙ্ঘন করে চলেছে। সমাজের সার্বজনীন মূল্যবোধকে প্রতিনিয়ত আঘাত হানা হচ্ছে।

রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি। কর্তৃত্ববাদী সরকারের আর্থিক সেক্টরে সীমাহীন স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, নৈরাজ্য ও লুটপাটের ফলে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। দেশের ৯টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। ঋণখেলাপিদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার ফলে খেলাপির সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২২ জানুয়ারি সংসদে অর্থমন্ত্রী আট হাজার ২৩৮ প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করেছেন ঋণখেলাপি হিসেবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন। ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের নাম অর্থমন্ত্রী কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রকৃতপক্ষে গত ১১ বছরে ব্যাংক ঋণ সুবিধাপ্রাপ্ত সরকারি দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও ব্যবসায়ী। ব্যাংকগুলোর টাকা একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে যাওয়ায় বিগত কোরবানি ঈদের সময় চামড়া শিল্প মালিকদের ঋণ দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে চামড়া শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে নিপতিত।

অন্য দিকে, সরকার দেশ চালাতে আর্থিকভাবে অসমর্থ হওয়ায় আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সব জমানো টাকা সরকারি কোষাগারে নিতে হয়েছে এবং বাজেটে এক বছরের জন্য নির্ধারিত ব্যাংক ঋণ মাত্র পাঁচ মাসেই তুলে নিয়েছে। দেশের অর্থনীতির খারাপ অবস্থার অন্য কয়েকটি দৃশ্যমান সূচক হলো- ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতন, নেতিবাচক আমদানি-রফতানি, বৈদেশিক বিনিয়োগে নিম্নগতি, শেয়ারবাজারে দরপতন এবং রাজস্ব আদায়ে বিপুল ঘাটতি। এ ছাড়া, একটি গোষ্ঠীর অবৈধ অর্থ অর্জনের প্রবল মোহের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নজিরবিহীন রিজার্ভ চুরি, ঋণের নামে ব্যাংক থেকে অর্থ-ডাকাতি, লুণ্ঠিত অর্থ-বিদেশে পাচার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ক্যাসিনোবাজি ও শেয়ারবাজার লোপাট করার মতো অনৈতিক ঘটনা এ দেশে ঘটেছে। এ সব কারণেও জাতীয় অর্থনীতিতে যত রক্তক্ষরণ হয়েছে, তা পূরণ করা অসম্ভব।

বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৭ নং অনুচ্ছেদে ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ বলে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধী মতাদর্শের অনুসারী নেতাকর্মীরা আদালতে আইনের সমান আশ্রয় লাভ করতে পারছেন না। ‘এক-এগারোর’ সময় জরুরি আইনের সরকার দেশে বিরাজনীতিকরণের প্রজেক্টের অধীনে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের দুই নেত্রীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে উল্লিখিত সময়ের সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করেছেন। সেই প্রক্রিয়ায় বিএনপি নেতারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদন করলেও তাদের একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। অন্য দিকে, একই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রায় ছয় হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ওই সময়ের মামলা এখনো চলমান এবং অনেকের সাজাও হয়েছে। জরুরি আইনের সরকারের সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা ছিল। সেসব মামলা প্রত্যাহার অথবা আদালতের মাধ্যমে খারিজ করা হয়েছে। অথচ বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটি বানোয়াট মামলায়, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আজো কারাভোগ করছেন। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে সে সময়ে দায়ের করা নাইকো দুর্নীতি, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া মামলা ও অন্যান্য মামলা এখনো চলমান আছে। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতির নামে দু’টি মামলা করা হয়েছিল। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ‘নাইকো’ মামলা চলছে, অথচ একই ধরনের অভিযোগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছে। জনগণের মতে, এভাবেই একই দেশে আইন দুই ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট, নীতি ও নৈতিকতা নয়, ক্ষমতা ও শক্তিই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার একটি রায়ে সরকারের কাজের সমালোচনা করায় তাকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয়েছে। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার প্রাপ্য, জামিনের আবেদন উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ থেকে নাকচ হয়ে গেছে। অপরদিকে, নিম্ন আদালতগুলোকে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ করে সরকারের কার্যত আজ্ঞাবহ করা হয়েছে। ফলে একটি গোষ্ঠী সুবিচার পাচ্ছে আর ভিন্ন মতাবলম্বীরা সরকারের আকাক্সক্ষামাফিক মামলার রায় পাচ্ছে। এমতাবস্থায় মানুষের আশা-ভরসার সর্বশেষ স্থান আদালতের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার উপক্রম। মোট কথা, দেশ ও জাতি এক গভীর সঙ্কটের আশঙ্কায় অন্ধকার টানেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশের জনগণের জন্য এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে হলে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করলেই যথেষ্ট। গত দশ বছর আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পরিবর্তে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধি করার এক আত্মঘাতী খেলা মঞ্চস্থ করা হয়েছে। নীতি ও নৈতিকতার কতটুকু অবক্ষয় হলে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে খাতা বিতরণের সময়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষককে পাসের হার ও গ্রেড সম্পর্কিত মৌখিক নির্দেশ দিতে পারেন!

বোর্ডগুলোর মধ্যে চলেছে গ্রেড ও পাসের হার বৃদ্ধির অনৈতিক ও অশুভ প্রতিযোগিতা। কলেজগুলোও এই অপসংস্কৃতির শিকার। ফলে গত ১০ বছরে ক্রমে অবনতি ঘটেছে শিক্ষার মানের। শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকই নয়, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার মানের চরম অবনতি ঘটেছে। ফলে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে পরিচিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটিও স্থান পায়নি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স আইনের প্রতি কোনো তোয়াক্কা না করে বর্তমান সরকার নিজেদের অনুগত ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। দলীয় আনুগত্যের কাছে মেধা ও যোগ্যতা হয়েছে পরাজিত।

ফলে ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে অপরাজনীতির জন্ম হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে প্রত্যাশা পূরণে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। শিক্ষার মানের চেয়ে তাদের কাছে শিক্ষাবাণিজ্য প্রাধান্য লাভ করেছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত কিছু মারাত্মক ঘটনা জনগণকে দারুণ উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। গত ১১ জানুয়ারি, রাষ্ট্রপতি রাজধানীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘উপাচার্যরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান নির্বাহী। দায়িত্ব পালনকালে নিজেদের সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতা আপনাদের প্রমাণ করতে হবে। আপনারা যদি অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী হবে?’ রাষ্ট্রপতি কি কোনো তথ্য ও উপাত্ত ছাড়াই উপাচার্যদের লক্ষ্য করে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনের উচ্চস্তরে প্রশ্রয় না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ‘টর্চার কক্ষ’ সৃষ্টি হয় কিভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররা নিজেদের হলে কর্তৃত্ববাদী বলয় সৃষ্টি করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই ছাত্ররা ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রদের হত্যা, লাঠিপেটাসহ নানাভাবে নির্যাতন, মাদকবাণিজ্য ও চাঁদাবাজির মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে পত্রপত্রিকায় বারবার শিরোনাম লাভ করেছে। সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতির বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে।

এ ছাড়া গত ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৫ জন ছাত্র এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্ঘটিত এসব হত্যাকাণ্ডের যদি সঠিক তদন্তপূর্বক বিচার করা হতো, তা হলে হয়তো আবরারকে এমন মর্মান্তিকভাবে প্রাণ দিতে হতো না। আবরার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ২৫ জন তরুণ বর্তমানে কারাগারে। তাদের সবাইকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বুয়েটের ন্যক্কারজনক এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের গেস্ট রুমে বিগত ২১ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের পেটোয়াবাহিনী চারজন শিক্ষার্থীকে বুয়েটের কায়দায় লাঠিপেটাসহ বিভিন্নভাবে চরম নির্যাতন করেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় চার শিক্ষার্থীকে রাতের মধ্যেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মন্দের ভালো যে, নির্যাতিত ছাত্ররা সংখ্যায় চারজন ছিলেন। পেটোয়াবাহিনীর মারকে চার ভাগে শেয়ার করার জন্য হয়তো তাদের আবরারের মতো ভাগ্যবরণ করতে হয়নি।

এ ঘটনায় চিহ্নিত ছাত্রদের বুয়েটের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সবার প্রত্যাশা। আবরারসহ যারা অন্যায়ভাবে হত্যার শিকার হয়েছে, তারা তো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো; কিন্তু বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনৈতিক ও দানবীয় আচরণের জন্য যারা ছাত্রত্ব হারাচ্ছে এবং কারাভোগসহ বিভিন্ন শাস্তি পাচ্ছে, তাদেরও জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ডের সভায় ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করা এবং অস্ত্র ও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মোট ৬৭ জন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারাজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। অধ্যক্ষকে পুকুরে নিক্ষেপের ঘটনায় গত ৩ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগের চারজন নেতাকর্মীর ছাত্রত্ব বাতিল করা ছাড়াও ১২ জনকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা ছাত্রাবাস-১ এ র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে গত ১৪ জানুয়ারি ছাত্র শৃঙ্খলা বোর্ডের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ জন ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনৈতিক ও শৃঙ্খলা বিরোধী কাজের অপরাধে অনেকেই ছাত্রত্ব হারাচ্ছে এবং অনেক ছাত্র হচ্ছে নির্যাতিত। এসব ছেলের মা-বাবারা এই সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছেন, প্রত্যাশা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি অনিয়মকে প্রশ্রয় না দিতেন, বা চিহ্নিত একটি ছাত্রগোষ্ঠীকে মদদ না জোগাতেন, তা হলে তারা এত ভয়ঙ্কর, বেপরোয়া ও উচ্ছৃখল হয়ে উঠতে পারত না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপরিউক্ত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটি জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে শিক্ষক-ছাত্ররা এক সাথে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছেন বহুদিন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাবি ছাত্রলীগের নেতাদের বড় অঙ্কের ‘ঈদের বখশিস’ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার কাছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ৮৬ কোটি টাকা ‘চাঁদা’ চেয়েছেন অভিযোগে ওই ছাত্রনেতারা তাদের পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও অনুরূপ গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যদি এ ধরনের অবক্ষয়ের কালিমা থাকে, তা হলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নীতি ও নৈতিকতার শিক্ষা কোথা থেকে পাবে?

এ ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ব্যক্তিস্বার্থ ও অর্থ অর্জনের অনৈতিক প্রতিযোগিতায় সমাজে অস্থিরতা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গণতন্ত্রহীন এই সমাজে অধিকার বঞ্চিত জনগণ কঠিন সময় অতিক্রম করছে। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খুন, গুম, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের ছায়ায় প্রশাসনিক ও পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যে জনগণ অতিষ্ঠ। সরকারসমর্থিত সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অবিশ্বাস্যভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। যুবসমাজ মাদকের ছোবলে বিপর্যস্ত। মাদক ব্যবসায়ীরা সরকারি ছত্রছায়ায় শুধু অবৈধভাবে অর্থ অর্জনের লোভে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ ধরনের অসহনীয় পরিস্থিতিতে জনজীবন আজ দুর্বিষহ। দেশবাসী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান চায়। দেশে চায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন। যে কর্তৃত্ববাদী সরকারের ব্যর্থতা, ক্ষমতার মোহ ও নীতি-নৈতিকতা বির্বজিত কর্মকাণ্ডে দেশ ও জাতির এই দুর্বিষহ অবস্থা, তাদের থেকে আর ভালো কিছু আশা করা যায় না। জনগণ একটি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে জনগণের সরকারব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। দেশ ও জাতিকে সর্বক্ষেত্রে এই ভয়ঙ্কর অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে জনগণের অধিকারসহ সমাজে নীতি ও নৈতিকতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় তারা।

লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ভূ-তত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement