২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারত পার করছে কঠিন সময়

-

ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট গত ৯ জানুয়ারি বলেছেন, ভারত খুব কঠিন সময় অতিক্রম করছে এবং দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা উচিত। আদালত এ কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সম্পর্কে দায়েরকৃত আবেদনগুলোর ওপর ততক্ষণ শুনানি করবেন না, যতক্ষণ ভারতে এ ব্যাপারে নির্যাতন না থামবে। সুপ্রিম কোর্টের এ বিশ্লেষণ এ দিক দিয়ে গুরুত্বের দাবিদার যে, তারা ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে এখানে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। প্রকাশ থাকে, এ সময় দেশব্যাপী যে গণ-অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার মৌলিক কারণ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সিএএ এবং অনুমোদিত এনআরসি সমস্যা। এটা ভারতের আসল নাগরিকদের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর শঙ্কার জন্ম দিয়েছে, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। মানুষের মধ্যে এ বোধ স্থান করে নিয়েছে যে, তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আর নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার অনুভূতি তাদের কষ্ট দিচ্ছে। এ কারণেই সারা দেশে সর্বাত্মক প্রতিবাদ হচ্ছে। সরকার বারবার ঘোষণা করছে, সিএএ কারো নাগরিকত্ব হরণ করার জন্য তৈরি করা হয়নি, বরং এ আইন নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তারা সব ধরনের আশ্বাস দেয়ার পরও এ কথায় কাউকে নিশ্চিন্ত করতে পারছে না। কেননা, এ আইনে মুসলমানদের কেন শামিল করা হয়নি? বিভিন্ন পক্ষ থেকে ভারতে এনআরসি বাস্তবায়নের কথা কেন বলা হচ্ছে?

বিস্ময়কর হলো, সরকার এ ব্যাপারে জনগণের আশঙ্কা ও সন্দেহ দূর করার পরিবর্তে তাদের আরো বেশি ভীত-সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এতে জনগণের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক ও কষ্টদায়ক বিষয় হচ্ছে, যে ব্যক্তি জনগণের ক্ষোভের মুখপাত্র হওয়ার চেষ্টা করছেন, তার হাত-পা ও মাথা জর্জরিত করে তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নতুন দিল্লির জওয়াহের লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে (বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ) এবিভিপির মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস ও বর্বরতার যে উলঙ্গ নর্তনকুর্দন প্রদর্শন করেছে, এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আরএসএস এতেই খুশি যে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে হিন্দুদের মাঝে একতা সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা রামমন্দিরের পর তাদের কাছে এমন কোনো ইস্যু ছিল না, যা দিয়ে হিন্দুদের এক করা যেতে পারে। ইন্দোরে আরএসএস প্রধানের সাথে এক মিটিংয়ের পর আরএসএসের প্রার্থীরা জানিয়েছেন, ‘গত এক মাস ধরে চলমান সিএএ-বিরোধী আন্দোলন পর্যালোচনা করার পর এ ফলাফল পাওয়া গেছে যে, এর উপকারিতা অবশেষে হিন্দুদের ঐক্যের রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কেননা অধিকাংশ হিন্দু আরএসএসের চিন্তাধারা লালন করে।’ ভারতের কঠিন সময় পার করার কথা সুপ্রিম কোর্ট যে আবেদনের শুনানি চলাকালে বলেছেন, ওই আবেদন মূলত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে করা হয়েছিল। ওই আবেদনে নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের দাবি করা হয়েছে। বৃহত্তর স্বার্থের নামে এ আবেদন অ্যাডভোকেট বিনেত কুমার ঠাণ্ডার পক্ষ থেকে দায়ের করা হয়েছে। আর এতে এ বিস্ময়কর দাবিও করা হয়েছে যে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে ‘সাংবিধানিক’ আখ্যায়িত করা হোক। চিফ জাস্টিস বোবদে, বিচারপতি গাভাই ও বিচারপতি সূর্যকান্ত আবেদনে উল্লিখিত দাবিগুলোর ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, পার্লামেন্টে অনুমোদিত আইনকে আপনা-আপনিই ‘সাংবিধানিক’ মেনে নেয়া হয়। তাকে ‘সাংবিধানিক’ হিসেবে অভিহিত করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তবে আদালতের কাজ এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে পরখ করা। তারা আবেদনকারীকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘ভারত কঠিন সময় পার করছে। দেশব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা উচিত। এ ধরনের আবেদনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান হবে না।’ প্রকাশ থাকে যে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে ৬০টি আবেদন পেশ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে সর্বোচ্চ আদালত গত ১৮ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিশ জারি করেছিলেন।

জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ওই আবেদনগুলোর ওপর শুনানি হবে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পর সারা দেশে ব্যাপক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা ভারতের সেই সব প্রত্যেক নাগরিক বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন, ভারতের প্রতি যাদের সামান্যতম ভালোবাসাও রয়েছে এবং যারা ভারতে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে জীবনযাপন করতে চান। সুপ্রিম কোর্ট তার বিশ্লেষণে এমন ধরনের মানুষের আবেগের মুখপাত্ররূপে কাজ করেছেন। কিন্তু এ অস্থিরতা ও উদ্বেগকে সরকার ও তার আমলারা জেনে বুঝেই উপেক্ষা করছেন। জনগণের মনে সৃষ্ট প্রশ্নের জবাব দেয়া এবং তাদের আশ্বস্ত করার পরিবর্তে নির্ভীকচিত্তে এটা বলা হচ্ছে যে, ‘আমরা এক কদমও পেছনে হটব না।’ যে সরকারের মৌলিক কাজ হলো জনগণের সমস্যা ও কষ্ট লাঘব করা, যখন তারা নিজেরাই নিত্যনতুন সমস্যা সৃষ্টি করে আর জনগণকে শত্রু ভাবতে থাকে, তখন দেশ রক্ষার্থে আল্লাহই একমাত্র ভরসা। আজ দেশে যা কিছু হচ্ছে এবং চতুর্দিকে বিক্ষোভের যে ঢেউ আছড়ে পড়ছে, তা মূলত সরকারের অনুভূতিহীনতা ও আত্মসম্মানবোধহীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা। সরকার এ আন্দোলনে যুক্ত মানুষদের পিষে ফেলতে চায় এবং তাদের আওয়াজকে দাবিয়ে দিতে চায়। তার অন্যতম প্রমাণ ৫ জানুয়ারি আমরা নতুন দিল্লির জওয়াহের লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পেলাম। ৫ তারিখ সন্ধ্যায় প্রায় ৩০০ মুখোশধারী সন্ত্রাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এতে বহু ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়। এ হামলা এতটাই বর্বরোচিত ছিল যে, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ঐশী ঘোষ মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন। তার মাথায় ষোলোটি সেলাই করতে হয়েছে। কিছু ছাত্রের হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়েছে। এবিভিপির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ এগিয়ে আসেনি। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে দাঁড়িয়ে ভিসির অনুমতির অপেক্ষা করছিল। ছাত্রদের তীব্র প্রতিবাদের পর পুলিশ অবশ্য তাদের তৎপরতা শুরু করে, তবে এ কার্যক্রম হামলাকারীদের পরিবর্তে স্বয়ং ওই ছাত্রদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়, যারা বর্বরোচিত হামলায় আহত হয়েছে। যে ২১ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের আহত সভাপতি ঐশী ঘোষের নামও রয়েছে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দেশের সবচেয়ে চৌকস মনে করা হয় যে দিল্লি পুলিশকে, তারা এ মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করতে চূড়ান্তরূপে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ তাদের ছবি নাম ও পরিচয়সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেএনইউ’র ক্যাম্পাস চতুর্দিক দেয়ালে ঘেরা নিরাপদ এলাকা। যেখানে অসংখ্য গার্ড মোতায়েন রয়েছে, সেখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কিভাবে প্রবেশ করল? জেএনইউ’র ছাত্রদের নিশানা বানানোর একটাই উদ্দেশ্য- তাদের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে, চলমান আন্দোলন থেকে দূরে সরানো। এ কথা সবারই জানা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং এনআরসি’র বিরুদ্ধে জনগণের ভেতর জমাট বাধা অস্থিরতা ও ক্ষোভের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছে জেএনইউ’র ছাত্র-ছাত্রীরা। তারা বৈপ্লবিক কবিতা ও স্লোগানের মাধ্যমে মানুষের মনপ্রাণে স্থান করে নিয়েছে। বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, জেএনইউ’র আহত ছাত্রদের ক্ষতস্থানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়ার পরিবর্তে সরকারের পক্ষ থেকে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে যে, এতে তারা আরো ভয় ও শঙ্কাগ্রস্ত হচ্ছে। জেএনইউ’র ভিসির ভূমিকা নিয়ে স্বয়ং বিজেপির শীর্ষ নেতা মুরলী মনোহর জোশি সমালোচনা করেছেন। জেএনইউ’র আহত ছাত্রদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য ওখানে পৌঁছামাত্র নায়িকা দীপিকা পাডুকোনের ওপর এমন স্পর্শকাতর হামলা করা হয় যে, তা এখানে লেখার মতো নয়। দীপিকা পাডুকোনের মুক্তি প্রতীক্ষিত ছবি ‘ছাপাক’ বয়কটের আন্দোলনও শুরু হয়েছে সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের জেনারেল সেক্রেটারি মিলিন্দ পারান্দে বলেছেন, ‘দীপিকা কি ওই লোকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছেন, যারা জেএনইউতে ভুল কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘দিপীকা বলুন, তিনি জেএনইউর ছাত্রদের কোন পক্ষের সাথে আছেন?’ এ দিকে বিজেপি পার্লামেন্ট সদস্য সাক্ষী মহারাজ দীপিকা পাড়–কোনকে ‘টুকড়ে টুকড়ে’ গ্যাংয়ের সদস্য অভিহিত করেছেন। বিজেপির মুখপাত্র তাজিনদার পাল সিং ও দক্ষিণ দিল্লির পার্লামেন্ট সদস্য রমেশ বিধুরীও সাক্ষী মহারাজের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের যাদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশি করে দায়িত্বশীলতার আশা করা হয়েছে, তারাই পরিস্থিতিকে আরো বিগড়ে দিতে এবং বিক্ষোভকারীদের উত্তেজিত করতে ব্যস্ত রয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ বিষয় নিয়ে চিন্তিত যে, ভারত এ সময় খুবই খারাপ সময় পার করছে। অথচ সরকার পক্ষের লোকেরা এ পরিস্থিতিতেও তাদের সঙ্কীর্ণমনা এজেন্ডার ওপরই চলছেন। এটাই মূলত সে চিন্তাভাবনা, যা দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি। এখন লড়াইটা দেশের দু’টি শ্রেণীর মধ্যে চলছে। এক দিকে রয়েছে সেই শক্তি, যারা দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়, যা কার্যকর করার জন্য নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। আরেক দিকে রয়েছে সেসব লোক, যারা বহু লোকের মধ্যে ঐক্যের রূপকে সুদৃঢ় করে দেশে স্থায়ীভাবে নিরাপত্তা ও শান্তি কায়েম করতে চায়। দেখার পালা, সফলতা কার ভাগ্যে জোটে।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত উর্দুটাইমস থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement