২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের চিকিৎসা এবং কারাবন্দী খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট

-

শেখ মুজিবুরের জন্ম এবং ছেলেবেলার রোগ
১৭ মার্চ ১৯২০, বুধবার সবে ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার মধুমতী নদীর পাড়ে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ বংশের পরিত্যক্ত ‘বিষাক্ত সর্পকুল আশ্রিত দালানের’ পাশের টিনের বাড়ি থেকে এক বয়স্ক গ্রাম্য ধাই হঠাৎ ছুটে এসে বললেন, ‘লুৎফর, তোর একটা খোকা হয়েছে, আজান দে’। শেখ লুৎফর রহমানের চাচাতো ভাই খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদের কিশোর ছেলে শেখ মোশাররফ হোসেন (ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র) আজান দিয়ে সবাইকে জানাল খুশির খবর। তার ভাবী সায়েরা খাতুন দুই কন্যার পর প্রথম পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন। নবজাতকের নাম স্থির হলো ফরিদপুরের গৌরব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখোপধ্যায়ের মাস্টার্সে অঙ্কের রেকর্ড ভঙ্গকারী অবিশ্বাস্য মেধার অধিকারী মুসলমান ছাত্র আবুল ফজল মুজিবুর রহমানের নামানুসারে শেখ মুজিবুর রহমান।

এ এফ মুজিবুর রহমানের অঙ্কের রেকর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও বহাল আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্মিত ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জির সাহায্য ও সহযোগিতায় এ এফ মুজিবুর রহমান ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ড যান এবং আইসিএস (Indian Civil Service) পরীক্ষায় সফল হয়ে পরের বছর ভারতে ফিরে আসেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় কিশোর বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তীর বয়স সম্পর্কে ব্রিটিশ সিভিল সার্জনের বক্তব্য অগ্রাহ্য করে বিপ্লবীর পিতার দাখিলকৃত জন্মকুষ্ঠি গ্রহণ করে বিচারক এ এফ মুজিবুর রহমান ICS অঙ্কের হিসাবের ‘রুলস অব প্রভাবিলিটির’ ভিত্তিতে অম্বিকাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক নির্ণীত করে তার মৃত্যুদণ্ড রহিত করেন। বিচারক এ এফ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী ভিন্নমতের রায় লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে বহাল থাকে। তবে ব্রিটিশ সরকারের মতের বিপরীতে রায় দেয়ার দুঃসাহস দেখানোর কারণে এ এফ মুজিবুর রহমান কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।

১৪ বছর বয়সে সুস্থ সবল কিশোর মুজিবুরের পা হঠাৎ ফুলে যেতে থাকে, প্রায়ই বমি বমি ভাব ও শরীরে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি হয়, হাতে পায়ে বোধশক্তি হ্রাস পায় এবং হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাওয়ায় প্রাণচঞ্চল ফুটবল মাঠের চমক মুজিব ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে খেলাধুলা ও পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। শয্যাশায়ী মুজিবুরের অনেক পরীক্ষা করে কলকাতার ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্য এবং ডা: এ কে রায় চৌধুরী মুজিবুরের রোগ নির্ণয় করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদ্বয় স্থির করলেন, আতপ চালের পায়েশের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণের নিমিত্তে এবং খাদ্যে ভিটামিন বি-১ (থিয়ামিন)-এর অভাবজনিত কারণে বেরি বেরি (Beri Beri) রোগ হয়েছে। ভিটামিন ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা শুরু হলো এবং খাদ্য স্থির হলো নিয়মিত শুধু ঢেঁকিভাঙা চালের ভাত, ছোট মাছ এবং প্রচুর মটরশুঁটি ও শাকসবজি। বেরি বেরি রোগ থেকে কিশোর মুজিব সুস্থ হলো কিন্তু চোখের দৃষ্টি বিভ্রাট হলো, গ্লুকোমা নির্ণীত হলো, অপারেশন করলেন কলকাতার প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা: টি আহমেদ। ১৬ বছর বয়স থেকে কিশোর মুজিবুরের চশমা পরা। তিন বছর খেলাধুলা ও পড়াশোনা বন্ধ থাকল। কয়েক বছর ভালো কাটলেও, ম্যাট্রিক পরীক্ষার ঠিক ‘একদিন আগে ভয়ানক জ্বর হলো ১০৪০ ডিগ্রি, মামপস্ (Mumps) হয়ে গলা ফুলে গেল’ অসহনীয় মাথা ব্যথা ও চক্ষু জ্বালা, পরীক্ষা খারাপ হলো।

কলকাতায় ইসলামীয়া কলেজে অধ্যয়নকালে, ১৯৪৫ সালে দিল্লিতে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে’ যোগ দিতে গিয়ে তরুণ শেখ মুজিব ‘বুকে, পেটে ও সমস্ত শরীরে অসহ্য বেদনায় আক্রান্ত হন, তিন দিন পায়খানা হয়নি’। হেকিম আজমল খান বিদ্যালয়ের একজন হেকিমের ‘জোলাপে’ দ্রুত সুস্থ হয়ে কলকাতায় বেকার হোস্টেলে ফিরে আসেন।

ব্রিটিশ ভারতে শেখ মুজিবুরের প্রথম কারাবরণ
১৯৩৮ সালে ছাত্রাবস্থায় স্থানীয় হিন্দুদের চক্রান্তে পাড়ার হিন্দু ছেলেদের সাথে মারপিটের অভিযোগে তরুণ মুজিব গ্রেফতার হন। কোনো হিন্দু উকিল মোক্তার তার পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে রাজি না হওয়ায় এবং হিন্দু এসডিও জামিন না দেয়ায় মুজিব সাত দিন হাজতবাস করে, ১৫০০ টাকা জরিমানা পরিশোধ করে মুক্তি লাভ করেন(২)।

পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবুরের কারাবরণ ও রোগ চিকিৎসা
ভারত বিভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র হোস্টেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শেখ মুজিব জড়িত হয়ে পড়েন। কলকাতার লালবাজার থানা থেকে আগত ঢাকার লালবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ হুমায়ুন মুর্শেদ চৌধুরীর(৩) সাথে ১৯৪৮ সালের শুরুতে পলাশী ব্যারাকের মাঠে মিটিং করার বিষয় জ্ঞাত করার জন্য শেখ মুজিব সাক্ষাৎ করেন। প্রথম দেখায় তরুণ রুগ্ন আকর্ষণীয় শেখ মুজিব সম্পর্কে ওসির পর্যবেক্ষণ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রথম সাক্ষাতে দারোগা শেখ মুজিবকে সাবধান করে বলেন, ‘তুমি মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতিতে জড়িও না, পড়াশোনা শেষ করো, তুমি পূর্ব পাকিস্তানকে অনেক কিছু দেবে, তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, পুলিশ এড়িয়ে চলো।’ তেজোদীপ্ত শেখ মুজিব ওসির পরামর্শ আমলে নেননি। তবে ওসির পর্যবেক্ষণ পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল, শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ হিসেবে।

রাজনৈতিক কারণে শেখ মুজিব প্রথম জেলে যান ১৪ মার্চ ১৯৪৮ সালে এবং মুক্তি লাভ করেন চার দিন পর ১৬ মার্চ সন্ধ্যায়। পুনরায় শেখ মুজিব গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এবং মুক্তি পান জুলাই মাসে। ১৪ অক্টোবর ১৯৪৯ ভুখা মিছিল থেকে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মুক্তি পান ফরিদপুর কারাগার থেকে। কথিত দুর্নীতির অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন ১১ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে এবং মুক্তি পান ৭ ডিসেম্বর ১৯৬০ সালে ঢাকা হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে। জননিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এবং মুক্তিলাভ করেন ১৮ জুন তারিখে।

১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে শেখ মুজিব এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং হাইকোর্টের নির্দেশে পরে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে তিনি আটবার গ্রেফতার হন, ম্যাজিস্ট্র্রেট জামিন দিতে অস্বীকার করেন কিন্তু একই দিনে বিকেলে জেলা জজ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালেও ‘শেখ মুজিব বারে বারে গ্রেফতার হয়েছেন’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ক্রমাগত মিটিং মিছিল এবং জনগণের চাপে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সামরিক সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সৃষ্ট আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। মুক্তির পরপরই শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ১৯৭১ সালে সাড়ে ৯ মাস পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে বন্দী থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিলাভ করেন ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২।

১৯৪৯ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে শেখ মুজিব প্রায় আট বছর জেলে কারাবন্দী ছিলেন এবং কারাজীবনের বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন অসুস্থতার বিবরণ আছে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাজীবনের রোজনামচায়(৪)।

১৯৫০ সালে গোপালগঞ্জ, জেলে থাকাকালে ‘দুর্বল হার্ট, চক্ষু যন্ত্রণা ও বাম পায়ে রিউমেটিক ব্যথা’ হয়, ‘ভীষণ জ্বর ও মাথাব্যথা এবং বুকে ব্যথা’, ধরা পড়ে খুলনা জেলে, ‘চোখের অসুখও বাড়ে’। ভালো চিকিৎসার দাবিতে ফরিদপুর জেলে শেখ মুজিব অনশন করেন, জেল চিকিৎসকরা জোর করে টিউব ঢুকিয়ে তরল খাবার প্রবেশ করালে নাকে ক্ষত সৃষ্টি হয়- ‘হার্টের অবস্থা খারাপ হয়, পালপিটিশন বাড়ে এবং নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়।’

১৯৬৬ সালে জেলে থাকাকালে শেখ মুজিব ভোগেন ‘অনিন্দ্রা ও ক্ষুধামন্দায়’। ২৯ জুন ১৯৬৬ সকালে হঠাৎ ‘পায়খানার দ্বার দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরে এবং পাইলস ও গ্যাস্ট্রিকের পুনরাবির্ভাব হয়’, ‘সাথে মাথা ভার, ব্যাপক বদহজম ও খাওয়ায় অনিচ্ছা’। একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং নির্জন কারাবাসেও (Solitary Confinement) শেখ মুজিবের মনে দৃঢ়তা অটল ছিল- ‘আমাকে বাঁচতে হবে, অনেক কাজ বাকি আছে।’

জুলাই মাসে পাইলস কমে কিন্তু পেট মাঝে মাঝে খারাপ হয়, আমাশয় বাড়ে, অনিদ্রা সমস্যা বাড়ায়। যোগ হয় পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত ভয়ানক ব্যথা। পরের বছর প্রায়ই অসহ্য মাথাব্যথা ও চোখের ব্যথায় ভোগেন, সারিডন টেবলেট খেয়ে কিছুটা ভালো থাকেন কিন্তু ‘ওজন কমে এবং পায়খানার দ্বার দিয়ে রক্ত পড়ে, দুর্বলতা বাড়ে।’

স্বাধীনতার পর তিনি ‘সারিডন’ খাওয়া বন্ধ করেছিলেন, যখন আমি তাকে বলেছিলাম যে সারিডনে ক্ষতিকর ফিনাসিটিন আছে, তাই ব্রিটেনে এটা নিষিদ্ধ। সারিডনের অপর দুটো উপাদান ছিল এসিটালসেলিসাইলিক এসিড (এসপিরিন) এবং সামান্য কেফিন। পরবর্তীকালে তিনি ব্যথা নিরাময়ের জন্য রেকিট কোলমান কোম্পানির এসপ্রো খেতেন। এসপ্রোর মূল উপাদান এসপিরিন।

ফরিদপুর, খুলনা ও ঢাকার জেলে থাকাকালে সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ হোসেন তার চিকিৎসা করেছেন। জেলার সিভিল সার্জনরা জেল হাসপাতালের এক্স অফিসিও সুপারিনটেনডেন্ট। তারা সপ্তাহে দু’বার জেল হাসপাতাল পরিদর্শন করতেন। ডা: মোহাম্মদ হোসেনের পুরো নাম মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী। ব্রাহ্মণ্যত্ব পরিহার করে মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলীর পিতামহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভারত বিভাগের আগে ডা: মোহাম্মদ হোসেন রাচী মানসিক হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। তৎকালীন এক ঘটনা তাকে অবিস্মরণীয় করেছে। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে গভর্নর নিকটবর্তী রাচী মানসিক হাসপাতালে আসেন তার অফিসকে খবর দেয়ার জন্য। তিনি নিজেকে গভর্নর পরিচয় দিলে হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে ধরে আটকে রেখে বলে, ‘নতুন কথা নয়, এখানকার সবাই নিজেদের গভর্নর মনে করেন, ছোট লাট দাবি করেন। থাকুন এখানে, আপনাকেই তো খুঁজছিলাম, মহামান্য আসুন, রাচী গভর্নর হাউজে থাকুন।’

ডা: মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জুরিসপ্রুডেন্সের খ্যাতিমান অধ্যাপক হয়েছিলেন। তিনি সিভিল সার্জন থাকাকালে শেখ মুজিবের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রেফার করেছিলেন। সেখানে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন এস এ লস্কর এবং মেডিসিন অধ্যাপক এ কে সামসুদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবের প্রায় এক মাস চিকিৎসা করেছিলেন, চক্ষু ও হৃদরোগের।

কারাগারের বাইরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের চিকিৎসা
১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইডের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার ঢাকার নাজিরা বাজারের একটি ছোট বাড়িতে কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন। পরে ৬০-এর দশকে সিদ্ধেশ্বরীতে পুকুরের পাড়ে ফরিদপুরের পুলিশ ইন্সপেক্টর আখতারুজ্জামানের নিজস্ব টিনের বাড়ির এক অংশে সামান্য ভাড়ায় থাকত মুজিব পরিবার। নাজিরা বাজার ও সিদ্ধেশ্বরীতে বসবাসকালে তার এবং তার পরিবারের চিকিৎসা করতেন ডা: এম এন নন্দী, গোল্ড মেডেলিস্ট। মুক্তিযুদ্ধকালে তার পরিবার থেকেছেন ধানমন্ডিতে এ কে এম আহসান, সিএসপির ধানমন্ডির ১৮ নং রোডস্থ একতলা বাড়িতে। তখন চিকিৎসা দিতেন পিজি হাসপাতালের প্রধান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক ওয়াদুদ ও সুফিয়া খাতুন। জাতির দুর্ভাগ্য, এই তিন বাসস্থানের কোথাও বঙ্গবন্ধুর একটি ছোট নাম ফলকও নেই।

এপ্রিল ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মাঝে মধ্যে বদহজম, পেটের নিম্নাংশে চিনচিনে ব্যথা ও পিত্তথলির সমস্যায় আক্রান্ত হন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হাসপাতালের (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি) পরিচালক ডা: নুরুল ইসলাম ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ স্থির করেন যে, বঙ্গবন্ধুর পিত্তপ্রদাহ ও পিত্তপাথর হয়েছে, অপারেশন প্রয়োজন। পিত্তপাথর ও প্রদাহের চিকিৎসা বাংলাদেশে না করে চিকিৎসার জন্য তাকে বিলেতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেন।

১৯৭২ সালের ৩০ জুলাই লন্ডনের হারলে স্ট্রিটের প্রাইভেট হাসপাতাল দি লন্ডন ক্লিনিকে শৈল্য বিশেষজ্ঞ স্যার এডওয়ার্ড মুইর, FRCS ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা ডা: নজরুল ইসলাম FRCS পেট কেটে বঙ্গবন্ধুর রোগ নির্ণয় করেন- ‘Cholecystitis, Inflammed Common Bile Duct but no obstruction’ পিত্তনালীতে কোনো পিত্তপাথর পাওয়া যায়নি। এপেনডিক্স প্রদাহ ছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর প্রদাহযুক্ত পিত্তথলি ও এপেনডিক্স অপসারণ করেন। লন্ডন ক্লিনিকে কয়েক দিন অবস্থানের পর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধু সুইজারল্যান্ডে যান এবং জেনেভা শহরে জেনেভা হ্রদের পাড়ে জেনেভা হোটেলে প্রায় দুই সপ্তাহ বিশ্রাম নেন। সেখানে তার সাথে আমার একাধিকবার সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয়েছিল, যা ভবিষ্যতে প্রকাশের চেষ্টা করব। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সুস্থ ছিলেন।

কারাগারে সৃষ্ট রোগ এবং জেলের ডাক্তারদের সম্পর্কে শেখ মুজিবুরের পর্যবেক্ষণ
নির্জনতা ও একাকিত্বের কারণে জেলে সৃষ্ট ভয়ানক রোগ মানসিক অবসাদ, চিত্রভ্রংশ (Dementia), ভ্রান্তি (Delusion), মায়া অলিক অস্তিত্বে বিশ্বাস (Hallucination), স্কিজোফ্রেনিয়া সদৃশ স্কিজয়েড (Schizoid), এমনকি স্কিজোফ্রেনিয়া।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বন্দীদের ‘একা রাখত শাস্তি দেয়ার জন্য। কারাগারে একাকী থাকা যে কত কষ্টকর তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। জেল কোডে আছে কোনো কয়েদিকে তিন মাসের বেশি একাকী (Solitary Confinement) রাখা চলবে না।’ একাকী রাখার কারণে শেখ মুজিব অনশন করেছিলেন। একাকিত্বের কারণে মানসিক অবসাদ, চিত্রভ্রংশ ও মায়ায় ভোগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ‘পাগল হয়ে গেলেন, তিনি নিজেকে সমস্ত দুনিয়ার খলিফা ঘোষণা করেন।’

কারাগারের রোজনামচায় শেখ মুজিব লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘অনেক ডাক্তার দেখেছি যারা কয়েদিদের কয়েদিই ভাবে, মানুষ ভাবে না, রোগ হলে ওষুধ দিতে চায় না। পকেটে করে ওষুধ বাইরে নিয়ে বিক্রি করে। ঘুষ খায়, চিকিৎসা করার নামে। টাকা পেলে হাজতিদের যার অসুখ নেই তাদের মাসের পর মাস হাসপাতালে সিট দিয়ে রেখে দিয়েছে, আর যে সত্যি রোগী তার স্থান নেই। ম্যাজিস্ট্রেট যখন দেখতে যান কয়েদিদের অবস্থা, তখন হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি দেখায় এতে জামিন পাওয়া সহজ হয়।’ শেখ মুজিব আরো লিখেছেন, ‘এমন ডাক্তার জেলে দেখেছি সুন্দর চেহারা, মুখে দাড়ি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে, দেখলে মনে হয় একজন ফেরেশতা। হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে কয়েদি রোগীদের ডায়েট থেকে ডিম, গোশত, রুটি পেট ভরে খান আর ওষুধও মাঝে মাঝে বাহিরে নিয়ে বিক্রি করেন।’

কারা হাসপাতালের সংস্কার প্রয়োজন
‘কয়েদিরাও মানুষ’। জেল হাসপাতালে কয়েদিদের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধার অভাব বঙ্গবন্ধুকে বিচলিত করেছিল।
সরকারের প্রায় সব বিভাগে দুর্নীতি নৈত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর কারাগারের হাসপাতাল সম্পর্কে ৬০ বছর আগের পর্যবেক্ষণের কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে, অসুস্থ কয়েদিরা ঘুষ দিতে না পারলে হাসপাতালের কোনো সুবিধা পায় না। হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা পেতে হলে, চিকিৎসককে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার এবং সুপারভাইজারকে মাসে দুই হাজার টাকা দিতে হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ঘুষের দর অনেক বাড়ে। কয়েদিদের সাথে ১০ মিনিট দেখা করার জন্য লাগে ১০০ টাকা(৫)।

বাংলাদেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগারের মোট ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার ৬৬৪ জন কিন্তু বর্তমানে বন্দী আছে প্রায় ৮৭ হাজার। ঢাকা ও কাশিমপুরে পাঁচটি এবং ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, রংপুর ও যশোরে আছে আটটি কেন্দ্রীয় কারাগার। জেল কোডের ৯ নং ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে একজন চিফ মেডিক্যাল অফিসার, একজন মেডিক্যাল অফিসার ও একজন লেডি মেডিক্যাল অফিসার এবং ৫৫টি জেলা কারাগার হাসপাতালে একজন চিফ মেডিক্যাল অফিসার ও একজন মেডিক্যাল অফিসার থাকার কথা। দুর্ভাগ্যবশত ১৪৯ জন চিকিৎসকের স্থলে আছে মাত্র ১০ জন চিকিৎসক। কারা কর্তৃপক্ষ সরাসরি চিকিৎসক নিয়োগ দিতে পারেন না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রেষণে কারাগারে চিকিৎসক পাঠিয়ে থাকেন।

প্রত্যেক কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে সার্বক্ষণিক ন্যূনতম ছয়জন বিশেষজ্ঞ, ছয়জন জেনারেল ডিউটি চিকিৎসক, একজন ডেন্টিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট ও দু’জন ফিজিওথেরাপিস্ট এবং কয়েকজন নার্স টেকনিশিয়ান থাকা অত্যাবশ্যক। প্রত্যেক জেলা কারাগার হাসপাতালে কমপক্ষে দু’জন বিশেষজ্ঞ, চারজন মেডিক্যাল অফিসার, একজন ডেন্টিস্ট, একজন ফার্মাসিস্ট, দু’জন ফিজিওথেরাপিস্ট এবং কয়েকজন নার্স ও ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান থাকা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে জেলের সব চিকিৎসক এবং অন্যান্য পেশার কর্মীদের নিয়োগসহ সব কারাগার হাসপাতাল পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব সামরিক মেডিক্যাল কোরকে (AMC) দিলে কারাগারে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি হবে, সম্ভবত দুর্নীতিও কমবে। সম্ভবত সব পুলিশ হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বও আর্মি মেডিক্যাল কোরে ন্যস্ত করা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত, দুর্নীতি কমবে, ব্যবস্থাপনার উন্নতি হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের কারাগারগুলোর প্রধান ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস (IG Prisons) সামরিক বাহিনীর মেডিক্যাল কোর থেকে প্রেষণে এসে থাকেন। [বাকি অংশ আগামীকাল]

তথ্যসূত্র:
১. ১৯৭৪ সালে খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেনের সাথে সাভারে আলাপচারিতা।
২. শেখ মুজিবুর রহমান, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, জুন ২০১২।
৩. হুমায়ুন মুর্শেদ চৌধুরী, ‘আমাদের কাল, আমার কথা’ গণপ্রকাশনী, ঢাকা ২০০৮।
৪. শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা’ বাংলা একাডেমি’, ঢাকা মার্চ ২০১৭।
৫. ‘কুমিল্লা কারাগারে টাকায় সব মেলে’, দৈনিক মানবকণ্ঠ ৭ জানুয়ারি ২০২০/২৩ পৌষ ১৪২৬, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement
শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনে উদ্বেগ টিআইবির যখন দলকে আর সহযোগিতা করতে পারবো না তখন অবসরে যাব : মেসি ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান আর নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ খণ্ডালেন ওবায়দুল কাদের আটকের পর নাশকতা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ইউপি চেয়ারম্যানকে বদর যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন পণবন্দী জাহাজ ও ক্রুদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝালকাঠিতে নিখোঁজের ২ দিন পর নদীতে মিলল ভ্যানচালকের লাশ বাল্টিমোর সেতু ভেঙে নদীতে পড়া ট্রাক থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার যুক্তরাষ্ট্রে ছুরিকাঘাতে নিহত ৪

সকল