২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইসলামী ব্যাংক-ব্যবসায়ের অগ্রগতি

-

ইসলামী ব্যাংক ব্যবসায় এক সময় ছিল কল্পনার বিষয়, যা বর্তমানে বাস্তবতা। বর্তমান বিশ্বে এ ব্যবস্থা নতুন ধারায় সর্বাধুনিক ব্যাংক সেবা নিয়ে উপস্থিত। বিশ শতকের কিছু বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও অর্থনীতিবিদদের দীর্ঘ গবেষণার মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংক বাস্তবতা লাভ করেছে। ষাটের দশকে মিসরে ইসলামী ব্যাংক ব্যবসায়ের যাত্রা শুরু, তা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ক্রমান্বয়ে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। ১৯৬১ সালে মিসরে ইসলামী গবেষণার সর্বোচ্চ কেন্দ্র রূপে ‘কলেজ অব ইসলামিক রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৪ সালের ৭ মার্চ এ কলেজের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৪০টিরও বেশি মুসলিম দেশের শতাধিক নেতৃস্থানীয় ইসলামী বিশেষজ্ঞ যোগদান করেন। তারা সুদভিত্তিক প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার বিকল্প রূপে ইসলামী ব্যাংক পদ্ধতি গড়ে তোলার উপায় নির্ণয়ে আলোচনা করেন। ১৯৬২ সালে মালয়েশিয়া কিস্তিতে হজের অর্থ জমা নেয়ার উদ্দেশ্যে ‘পিলগ্রিমস সেভিংস করপোরেশন’ নামে সুদমুক্ত একটি সংস্থা কায়েম করা হয়। এর পর ১৯৬৩ সালে ডক্টর আহমদ আল-নাজ্জারের উদ্যোগে মিসরের কায়রো থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে মিটগামার নামের এক গ্রামে আধুনিক বিশ্বের প্রথম সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়।

সত্তরের দশকে মুসলিম দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’ শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে ইসলামী ব্যাংক ব্যবসায়ের সূর্যোদয় ঘটে। ১৯৭৪ সালের ওআইসি সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থেকে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্তে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। ইরান, পাকিস্তান ও সুদানের সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামীকরণসহ সারা বিশ্বে বিশ শতকের শেষ নাগাদ ৩০০’র বেশি ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব লাভ করে। শুধু তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতেই নয়, অনেক স্বল্পোন্নত দেশেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের বাইরেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লুক্সেমবার্গ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্কসহ বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে ইসলামী ব্যাংক তাদের সফল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং বহুমাত্রিক দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসলরূপে ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯ জন বাংলাদেশী ব্যক্তিত্ব চারটি প্রতিষ্ঠান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দু’জন বিদেশী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে এগিয়ে আসেন। বর্তমানে এ ব্যাংকে ১৪ হাজার সৎ, দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ জনশক্তি রয়েছে। রয়েছে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি।

বর্তমানে এ ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দ্য ব্যাংকার প্রণীত বিশ্বের সেরা এক হাজার ব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের স্থান ৯৪৩তম। এই ব্যাংক পেয়েছে বিশ্বসেরা ইসলামী ব্যাংক সিবাফি অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ ও সর্বোচ্চ বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণে এনআরবি কর্তৃক গোল্ড রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৯। প্রায় সোয়া কোটি গ্রাহক নিয়ে শরিয়াহ নির্দেশিত ব্যবস্থায় সম্পদের সুসমবণ্টনের মাধ্যমে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ ব্যাংক কাজ করে চলেছে। এ ব্যাংকের সফল অগ্রযাত্রার পথ ধরে পরবর্তীকালে এ দেশে আরো কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে আটটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। তা ছাড়া ৯টি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ১৯টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা, আটটি কনভেনশনাল ব্যাংকের ২৫টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে। এসব উইন্ডোর মোট আমানতের পরিমাণ দুই লাখ ৫৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা; যা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ২৩.৭৭ শতাংশ। সফলভাবে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ইসলামী ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করে ‘সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ’।

আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণী সৃষ্টি, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংকগুলো জনমানুষের আস্থা অর্জন করে চলেছে। শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণও ইসলামী ব্যাংকগুলোতে তুলনামূলক কম রয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে ১২৬১টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা আছে। ২০১৮ সালে ছিল ১১৭৮টি। দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোতে কাজ করছেন ৩৫ হাজার ৩৪১ জন জনশক্তি (দৈনিক যায়যায়দিন, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯)।

প্রবাসীদের কাছেও ইসলামী ব্যাংকিং অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালে জুন পর্যন্ত ৯ হাজার ৭১২ কোটি প্রবাসীর আয় এসেছে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের মোট আমানতের পরিমাণ দুই লাখ ৫৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। বিনিয়োগ হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। তা ছাড়া মোট ব্যাংকিং খাতের প্রবাসী আয়ের ৭৭.২৬ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে।

দেশের ৯০ ভাগ গ্রাহক মুসলমানসহ অমুসলিম গ্রাহকদের কাছেও ইসলামী ব্যাংকের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা ক্রমেই অধিকতর আস্থা অর্জন করে চলেছে। বহু দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে এ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে এবং দেশে দেশে ব্যাপকতর গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement