২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গ্রামীণ সাংবাদিকতার সেকাল ও একাল

-

আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি ‘দৈনিক দেশ’-এ। এই পত্রিকাকে ঘিরে অনেক মধুময় স্মৃতি আজো মনের গভীরে জেগে আছে। দৈনিক দেশকে সাংবাদিকদের একটি ইনস্টিটিউশন বলা যায়। এ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন অনেক গুণী সাংবাদিক, যারা এখন মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় ২৭ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক দেশ ছিল জাতীয়তাবাদী আদর্শের মুখপত্র।

১৯৭৯ সালের জুলাই মাস। আমি তখন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর মুন্সী ফজলুর রহমান সরকারি ডিগ্রি কলেজে বিএ ক্লাসে অধ্যয়নরত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী আদর্শের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক দেশ’ নামের একটি নতুন পত্রিকা বের করেন। পত্রিকার মূল্য দুই টাকা। অফিস প্রথমে ছিল ২৭, পুরানা পল্টন, এবং পরে ৫, সেগুন বাগিচা, ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। শুরুতে দৈনিক দেশ পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও লেখক সানাউল্লাহ নূরী। দৈনিক দেশ পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পেতে দাউদকান্দি থেকে আমরা পাঁচ-ছয়জন ছাত্র-যুবক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হই। সবাই ডাকযোগে নিয়মিত নিউজ পাঠাচ্ছে। সবার নিউজই ছাপা হচ্ছে। চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। অবশেষে আমাকে দাউদকান্দিতে দৈনিক দেশের নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। টানা ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দৈনিক দেশ-এ সাংবাদিকতা করেছি। তখন নিউজ পাঠাতে ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ছিল না। পত্রিকা অফিসে শুধু টেলিপ্রিন্টার দেখেছি। এতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার নিউজগুলো আসত। আমি খামভর্তি করে নিউজ ও ছবি ডাকযোগে পত্রিকা অফিসে পাঠাতাম। তিন-চার দিন পর পত্রিকা খুললে আমার পাঠানো নিউজ ছাপার অক্ষরে পড়তে পেতাম। আর আমার জন্য পত্রিকার একটি সৌজন্য সংখ্যা ডাকযোগে পাঠানো হতো। নিউজ কম্পোজের জন্য তখনো কম্পিউটার আসেনি। লোহা বা পিতলের তৈরি অক্ষর হাতে মিলিয়ে নিউজ কম্পোজ করা হতো। কী কঠিন ও দুরূহ কাজ। পত্রিকা অফিসে যখনই যেতাম, দাঁড়িয়ে কম্পোজের কঠিন কাজগুলো দেখে বিস্মিত হতাম। সংবাদপত্র শিল্পে কম্পিউটার কম্পোজ চালু হওয়ার পর শত শত কম্পোজিটর বেকার হয়ে পড়েন। এই বেকার সংবাদকর্মীদের কর্মসংস্থানের জন্য সংবাদপত্র মালিক কিংবা সরকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ৯০’র দশকের শুরুতেই বেশির ভাগ সংবাদপত্রে পুরোদমে কম্পিউটারে নিউজ কম্পোজ শুরু হয়ে যায়। তবে ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো দীর্ঘ দিন হাতের কম্পোজেই চালানো হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে পত্রিকা অফিসে তাৎক্ষণিক জরুরি নিউজ পাঠানোর কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, খুন-রাহাজানির মতো জরুরি খবরগুলো সাধারণত টেলিফোনে পাঠাতাম। ফোনের জন্য দাউদকান্দি সদর, গৌরীপুর টেলিফোন একচেঞ্জে গিয়ে কত ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। ফোনে চিৎকার করে পত্রিকা অফিসে নিউজ পাঠিয়েছি সংক্ষেপে। ‘হ্যালো ঢাকা - হ্যালো ঢাকা’ বলে চিৎকার করতে করতে কণ্ঠনালী ব্যথা হয়ে যেত। কখনো কখনো ঢাকায় ফোন লাইন পাইনি। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ছিল না। বড় কোনো অঘটন ঘটলে কষ্ট করে হলেও নিউজ-ছবি নিয়ে দুইটি ফেরি পার হয়ে ঢাকায় পত্রিকা অফিসে চলে যেতাম। কখনো রাত গভীর হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে ঢাকায় রাতযাপন করতে হয়েছে।

কী এক অজানা নেশা ছিল গ্রামীণ সাংবাদিকতা। বেতনভাতা নেই। শুধু প্রকাশিত ছবি, টেলিফোন বিল ও ডাকমাশুল দেয়া হতো। সেই দুঃসহ চিত্র শুধু দাউদকান্দির নয়, সারা দেশের একই চিত্র। তখনকার সময়ের সাংবাদিকতা আর এখন, আকাশ-পাতাল ফারাক। ওই সময় ঘটনাস্থলে যাওয়া ছাড়া নিউজ সংগ্রহ করা যাবে, এমনটা ভাবাই যায়নি। দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা ছিল নিউজ সংগ্রহের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। নিউজের জন্য ঘটনাস্থলে যেতে-আসতে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হতো। শারীরিক কষ্ট তো আছেই। আর এখন উন্নত নানা প্রযুক্তি প্রসারিত। ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত থেকেও বন্ধু সাংবাদিকের কাছ থেকে মুহূর্তেই মেইলে ও মেসেঞ্জারে নিউজ পাওয়া যাচ্ছে। মিনিটেই হাতের মুঠোয় চলে আসে সংবাদের আপডেট। আমাদের সময়টিতে বলতে গেলে নিউজের আকাল ছিল। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা-সহিংসতা ছিল না বললেই চলে। রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সহনশীলতা, বন্ধুত্ব, মমত্ববোধ, মূল্যবোধ জাগ্রত ছিল। বিরাজমান ছিল চমৎকার পরিবেশ। অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল খুবই কম। তাই নিউজ সৃষ্টি হতো কম। আর এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষ হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করছে। হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় না, লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে নদীতে ডুবিয়ে দেয়। মানুষের হিংস্রতা পশুত্বকে হার মানিয়েছে। মানবতাবোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, মায়া-মমতা, ভালোবাসা আশঙ্কাজনক হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে মানুষ কোথাও নিরাপদ নয়। সড়ক দুর্ঘটনা, গুম, খুন, মারামারি, ধর্ষণ, রাহাজানি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজির কারণে সমাজে অস্থিরতা ও অশান্তি বেড়েছে। বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। নতুন যোগ হয়েছে ক্যাসিনোবাজি, পেঁয়াজবাজি। এখন নিউজ খুঁজতে হয় না। নিউজই এখন সাংবাদিকদের খুঁজে বেড়ায়। দিন দিন আমরা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি। কী হবে আমাদের সন্তানদের? আমাদের ওই সময়টাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো নিউজ সংগ্রহ করা মানে, রীতিমতো গবেষণা করা বা যুদ্ধ জয় করার মতো অবস্থা ছিল।

১৯৮৬ সালের শুরুর দিকের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে পথচারী এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিরপরাধ মেধাবী ছাত্র আরিফ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দি উপজেলার কাউয়াদী (ভাউরিয়া) গ্রামে। তার বাবা আবদুল লতিফ মিয়াজী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। মা দাউদকান্দির হাসানপুর শহীদ নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা মাহমুদা আক্তার এবং অগ্রজ প্রকৌশলী (আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) মাহমুদুর রহমান। ঘটনার পর দিন দৈনিক দেশ থেকে উপদেষ্টা সম্পাদক তাহের উদ্দিন ঠাকুর আমাকে জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে নিহত আরিফের লাশ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নেয়া হচ্ছে। আরিফের কবরের ছবি, তার বাবা-মায়ের সাক্ষাৎকারসহ বিস্তারিত লিখে একটি স্টোরি নিয়ে অফিসে যেতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গৌরীপুর স্টেশন থেকে আরিফদের গ্রামের বাড়ি কমপক্ষে ১৬ কিলোমিটার হবে। এর মধ্যে ৯ কিলোমিটার রাস্তা ইটের সলিং করা। এই পথে রিকশায় লক্কড়-ঝক্কড় করে নৈয়াইর পৌঁছি বেলা ১টায়। সেখান থেকে আরিফের গ্রামের বাড়ি সাত কিলোমিটার। ধানের জমির আইল দিয়ে হেঁটে দুই ঘণ্টা লাগলো সেই বাড়িতে পৌঁছতে। প্রথমেই আরিফের কবরের ছবি তুলে নিলাম। তার মা অধ্যাপক মাহমুদা আক্তার প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হলেন না। তবে বাবা চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ মিয়াজীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। একইভাবে হেঁটে ও রিকশায় গৌরীপুর স্টেশনে এসে ঢাকার বাসে উঠলাম। রাত ৮টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রিকশা থেকে নেমেছি। সারা দিনেও পেটে কিছু পড়েনি। খাওয়ার সুযোগও পাইনি। রাত ৯টা নাগাদ সেগুন বাগিচায় দৈনিক দেশ অফিসে পৌঁছি। তাহের উদ্দিন ঠাকুরের রুমে ঢুকতেই বুঝলাম উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানালেন এবং খেয়েছি কি না জানতে চাইলেন। আমার দেয়া ছবির ফিল্মটি ফটোসাংবাদিক আমিনুল ইসলাম শাহীনের হাতে দিয়ে তাহের ঠাকুর বলেন, দ্রুত আরিফের বাবা ও তার কবরের ছবি প্রিন্ট দেয়ার জন্য। এই ফাঁকে তাড়াহুড়া করে নিউজ স্টোরি লিখে ঠাকুর সাহেবের কাছে জমা দিলাম। পরদিন আমার স্টোরি দৈনিক দেশ-এ লিড হয়েছিল। এত কষ্টের পর আমার লেখা নিউজ লিড হয়েছে দেখে খুব আনন্দ লাগছিল। এরই মধ্যে তাহের উদ্দিন ঠাকুর বলেন, ‘আক্তার, সারা দিনের খরচের একটি বিল তৈরি করে আমার কাছে দাও।’ আমি পাঁচ শ’ টাকার বিল তৈরি করার প্রস্তুতি নিতেই তিনি দুই হাজার টাকা লেখার নির্দেশ দেন। এতেই বোঝা যায় ওই দিন তিনি আমার প্রতি কত বেশি খুশি হয়েছিলেন। এরপর তিনি আরো বেশ কয়েকবার আমাকে অতীব জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ কাজের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন, যথাযথভাবে পালন করেছি। দৈনিক দেশ বের হওয়ার আগে আমি কিছু দিন দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকায় কাজ করেছি।

খান জাহান আলী সড়ক, খুলনা থেকে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হতো। আমার জন্য ডাকযোগে দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকা পাঠিয়ে দেয়া হতো। তখন পত্রিকা ছিল হাতেগোনা। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে দাউদকান্দিতে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে আমিসহ আরো যারা ছিলেন, মোহাম্মদ শাহজাহান (দৈনিক ইত্তেফাক), আবদুল মান্নান (দৈনিক আজাদ), মো: হাবিবুর রহমান (দৈনিক বাংলার মুখ/পরে ইত্তেফাক), অধ্যাপক আবদুর রব (দৈনিক সংগ্রাম), আবদুল ওয়াদুদ (সংবাদ), মফিজুর রহমান লিলু (দৈনিক কিষাণ) ও এম এইচ মোহন (বাংলার বাণী)। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক দেশ’ ব্যবস্থাপনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব নেন বিএনপি নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী এ কে এম মাঈদুল ইসলাম। তখন দৈনিক দেশ-এর সম্পাদক নিযুক্ত হন মাঈদুল ইসলামের ভগ্নিপতি মো: আনোয়ারুল ইসলাম।

দৈনিক দেশ বন্ধ হওয়ার পর বিএনপির মুখপত্র হিসেবে আসে দৈনিক দিনকাল। আমি কুমিল্লা (উত্তর) প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিই দৈনিক দিনকালে। তখন বন্ধ দৈনিক দেশের প্রায় সব সাংবাদিক-কর্মচারী দিনকালে যোগ দেন। দিনকালের পাশাপাশি ২০০১ থেকে ২০০৭ সময়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) কুমিল্লা (উত্তর) প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বাসসে সাংবাদিকতাকালে পিআইবিতে পাঁচটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলাম। প্রশিক্ষণকালে একাধিক সিনিয়র সাংবাদিক, আইনজীবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক বক্তৃতা করেন। ১৯৯৬ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সাথে বঙ্গভবনে আমরা দাউদকান্দি সাংবাদিকরা সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলাম।

তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। ২০০৬ সাল থেকে দেশবরেণ্য রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সাংবাদিক হিসেবে সুইজারল্যান্ড, সৌদি আরব, দুবাই, থাইল্যান্ড, হংকং ও ভারত সফর করেছি। জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে (১৮-২০ মে, ২০০৪) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সাথে যোগ দিয়েছি। এগুলো একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অর্জন।

E-mail: shahaktaruzzaman@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement