২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জনরায় যেন ভূলুণ্ঠিত না হয়

-

২০১৯ সাল শুরু হয়েছিল একাদশ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী উত্তেজনা দিয়ে। ওই নির্বাচনের ফল হয় ‘বিস্ময়কর’! আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা পেয়েছে ‘অস্বাভাবিক’ জয়। তেমনি বিএনপি ও তার মিত্রদের ঘটেছে ‘অস্বাভাবিক’ পরাজয়। বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার তিন দফায় ক্ষমতায় আছে। ২০২০ সালে এসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি এর ভোটগ্রহণ। নির্বাচন দিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হোক। প্রার্থীরা তাদের পরিকল্পনা, যোগ্যতা আর কর্মতৎপরতা দিয়ে জনগণের মন জয় করুন। শুধু কথায় নয়, কাজের সমন্বয় ঘটুক। ব্যালটযুদ্ধে গণতন্ত্রের দুয়ার উন্মোচিত হোক। মুজিববর্ষে রাষ্ট্রের মুখে কলঙ্ক লেপন হয়- এমন কিছু যেন না ঘটে।

দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির কল্যাণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন একান্ত অপরিহার্য। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হলে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটাররা পাঁচ বছরের জন্য মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত করবেন। এবারের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই প্রার্থী দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আশা করা হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে নির্বাচন। দেশবাসী এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় আর শামিল হতে চাই না।

জনগণ তাদের প্রতিনিধি বেছে নেয়ার সুযোগ পাবেন এবং সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, এটিই শান্তিপ্রিয় মানুষের আশা। স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষ আশা করেছিলেন, বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী হবে। তবে মানুষের সেই স্বপ্ন হোঁচট খেয়েছে বারবার।

আওয়ামী লীগ নেতারা যদি মনে করেন, বিএনপির রাজনীতি দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোক পছন্দ করেন না, তাহলে তাদের আর নির্বাচনী প্রচারণার কোনো দরকার আছে কি? এমনিতেই ভোটের বাক্স উপচে পড়বে! তা হলে অহেতুক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার দিন থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের এত দৌড়ঝাঁপ করতে হবে কেন? প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে, জনরায়ে আস্থা রাখতে ব্যর্থ হলে সবচেয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে দেশের গণতন্ত্র। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারছি না, আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হচ্ছে।

নাগরিক সংগঠন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারের আশু অপসারণ এবং নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই’ উল্লেখ করে বিষয়টিতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। কারণ হিসেবে টিআইবি বলেছে, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে, তা অভূতপূর্ব ও গোটা জাতির জন্য বিব্রতকর।

ঢাকার সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। ইভিএমে ভোট জালিয়াতি ও ভোট চুরির সুযোগ থাকবে না- এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। ইসি এবং শাসক দল ইভিএমের পক্ষে ওকালতি করলেও বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিপক্ষে। মানুষের তৈরি প্রযুক্তি যেভাবে চাইবে সেভাবে অপারেট করা সম্ভব। আন্তর্জাতিকভাবেও ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ দেশে ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয় না। কারণ, সেক্ষেত্রে ম্যানিপুলেশন বা কারসাজি করার সুযোগ থাকে। সারা বিশ্ব যখন ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে; তখন সিইসি কার স্বার্থে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়।

অতীতের নির্বাচনগুলোতে সরকারি দলের মহড়ার কারণে বিরোধী দলের ও এজেন্টরা কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। এ অবস্থা এবারো থাকলে ইভিএমের বিরোধিতা আরো বাড়বে। ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহী মাসলম্যানরা বিরোধী প্রার্থীর ভোটারদের হয়তো ইভিএমের বাটনে হাত দিতে দেবেন না, বলবেন আপনার কষ্ট করার দরকার নেই, আমরাই বাটন চেপে ভোট দিয়ে দিচ্ছি। নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যবহার হবে না, এমন গ্যারান্টি কি নির্বাচন কমিশন দিতে পারবে?

এ ছাড়া সর্বসাধারণের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচন নিয়ে নেতাদের কথাবার্তা। তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণে দায়িত্বশীলতার অভাব থাকা দুঃখজনক। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে। এই ৯০ শতাংশ মানুষ এখন বিএনপিকে চায় না।’ আমরা মনে করি, বিএনপির বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশ মানুষ, না আওয়ামী লীগের পক্ষে ৯০ শতাংশ; সেটি পরীক্ষার জন্য নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া প্রয়োজন। এর আগে বিএনপির নেতারা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে মন্তব্য করেছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, এটি প্রমাণ করতেই তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাচ্ছেন। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপির নেতাদের বক্তব্য হাস্যকর। তারা গণতন্ত্রের ভাষা বোঝেন না, তারা আইন-আদালত কিছুই মানেন না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং হত্যা, খুন এবং লুটপাটের রাজনীতি চর্চা করা।’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন নয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হলে সরকারের পতন হবে না। বিএনপির প্রার্থী জিতলে তারাও সরকার গঠন করতে পারবেন না। সব নির্বাচনই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য দেখতে চান সাধারণ মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দু-একটা নির্বাচন ছাড়া দীর্ঘ দিন পর্যন্ত আর তা হয়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রচর্চা না থাকলে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা আশা করা যায় না। আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলে মতপ্রকাশের বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়নি। দলগুলোর কেন্দ্রীয়সহ সব কমিটিতে অনির্বাচিত নেতৃত্ব, যেখানে গণতন্ত্রের গন্ধও পাওয়া যায় না। তবুও আশা করে মানুষ। অন্ধকার সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে দেখতে চায় আলোর রশ্মি। জরাজীর্ণ অতীত আর সমস্যাসঙ্কুল বর্তমান ভুলে আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহানগরবাসী তাদেরই নির্বাচিত করবেন, যারা তাদের কাছে অধিকতর যোগ্য ও সমাদৃত বলে গণ্য হবেন। আমরা আশা করি, মহানগরবাসীর গণরায় সুষ্ঠুভাবে প্রতিফলিত হবে। জনগণের দেয়া রায় যেন ভূলুণ্ঠিত না হয়।

abunoman1972@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement