২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কসমো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন

-

‘লইয়ার্স মেডিটেশন সোসাইটি’ আয়োজিত কোয়ান্টাম লামা, বান্দরবান ভ্রমণ। তিন রাত-দুই দিনের ভ্রমণে টুরিস্ট ছিলেন দুই শতাধিক। ৮ ডিসেম্বর রাতে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ পরিচালিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুরুতেই ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সালের ওপর কসমোদের ধারাবাহিক সাফল্যের আলোকচিত্র। বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে মাত্র সাতটি শিশুকে নিয়ে ২০০১ সালে দুর্গম পাহাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে বাঁশের বেড়া আর টিনের চালের ঘরে যাত্রা শুরু ‘কোয়ান্টাম কসমো’ স্কুলের। আজ সেখানে পড়ালেখা করছে প্রায় ২৫০০ ছাত্রছাত্রী। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন প্রমাণ করেছে, ‘যে শিশুরা এক সময় পথে পথে ঘুরে বেড়াত, যাদের মা নেই, বাবা নেই কিংবা থাকলেও ভার্চুয়াল ভাইরাসের আঘাতে বিচ্ছিন্ন তাদের পরিবার; সেসব অসহায় বঞ্চিত শিশুকে নিয়ে তাদের কাজ। মানুষ যদি পরিবেশ পায়, একটু সহযোগিতা পায়; তাহলে সে অসাধ্যও সাধন করতে পারে।’

এখানকার ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে প্রতিটি তরুণ-তরুণী আত্মবিশ্বাসী। ‘আমি পারি, আমি করব, আমার জীবন আমি গড়ব’- এ আত্মবিশ্বাস মিশে রয়েছে ওদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই আত্মবিশ্বাসের জোরে কসমোদের জীবনের আদর্শ ও দীক্ষাগুরু শহীদ আল বোখারী মহাজাতকের শিক্ষার মশাল জ্বলছে ১০ একর ভূমি থেকে ৩৫০ একর ভূমি জুড়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় হয়ে এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের।

র‌্যাংকিং তালিকায় ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০০ থেকে ৮০০-এর ভেতরে। বছর দুয়েক পরই ঢাবির অবস্থান হঠাৎ নেমে যায়। ২০১৮ সালে অবস্থান গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজারেরও পরে। দেশে নতুন করে আরো দু’টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে; কিশোরগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এ দু’টি নিয়ে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টি। রাজশাহীতে ‘শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি’ ও ‘বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০১টি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, শিক্ষার মান সে হারে বাড়ছে না।

কসমোদের পাহাড়ি শিক্ষাব্যবস্থায় যেখানে ক্রমোন্নতি, সমভূমির শিক্ষাব্যবস্থায় সেখানে ক্রমাবনতি। কসমো কলেজের প্রিন্সিপাল সালেহ আহমেদসহ তাদের প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রচারপত্র থেকে তথ্য নিয়ে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় গত ৫ ডিসেম্বর ‘সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন’, ১৯ ডিসেম্বর ‘অপ্রতিরোধ্য কসমো স্কুলের শিক্ষার্থী’ এবং ২৮ ডিসেম্বর ‘এত এনার্জি ও মেধা! ওরা খায় কী?’ শিরোনামে তিনটি আর্টিকেল লিখেছি।
কথায় বলে, ‘ইঞ্জিনিয়ার ভালো হলেই ইমারত ভালো হয় না, নির্মাণসামগ্রীও ভালো হতে হয়।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘নির্মাণসামগ্রী’ হলো শিক্ষার্থীরা। ঐশ্বর্য, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির দ্বারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হলেও শিক্ষার্থীর শিক্ষাসহ নৈতিক মান বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বাংলাদেশে।

সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন দীপ্তিমান হচ্ছে কসমো স্কুলের শিক্ষার্থীরা। সারা দেশে ৩০টি ক্যাম্পের মাধ্যমে ছিন্নমূল শিশুদের খুঁজে বের করে বিনামূল্যে ভরণপোষণসহ লেখাপড়া করানো হয়। লামায় ছেলেদের জন্য ছয়টি এবং মেয়েদের জন্য দু’টি স্কুল রয়েছে। সেখানে প্রচলিত শিক্ষাদানের পাশাপাশিÑ মেডিটেশন, সঙ্গীত, নৃত্য, খেলাধুলা ও জিমনেসিয়াম প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

৫৪ জন এতিম শিশু নিয়ে ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু শিশুকাননের। বাঙালি, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, চাকমা, মুরং, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০০ শিশুর কারো মা নেই, কারো বাবা নেই; কারো মা-বাবা কেউ নেই- এ রকম এতিম শিশু নিয়ে ‘শিশুকানন’। পিতা-মাতা ও অভিভাবকহীন যেসব শিশু লেখাপড়ার স্বপ্ন দেখা দূরের কথা খেয়ে-পরে বাঁচার স্বপ্নই দেখত না; তাদের মায়ের আদর, বাপের স্নেহ, বোনের সোহাগ ও ভাইয়ের মমতা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। যেখানে তিন শতাধিক মেয়েশিশু রয়েছে।
প্রতিটি শিশুর কাছে স্কুল ক্যাম্পাসই তাদের বাড়িঘর। পরিবারে সোহাগ ও শাসন দিয়ে, মায়া-মমতার বন্ধনে সন্তানকে গড়ে তোলা হয়। সেভাবে প্রতিটি শিশুকে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি শিশু শৈশব থেকেই ‘সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন’ মন্ত্রটি রক্ত-মাংসের সাথে এমনভাবে মিশিয়ে রাখে যে, বাকি জীবন আর এদিক-ওদিক হওয়ার নয়।

সবুজ প্রকৃতির মাঝে বসবাস, সুষম খাদ্যসহ নিবিড় পরিচর্চার কারণে কসমোদের অসুখ-বিসুখ হয় না বললেই চলে। রয়েছে ‘শাফিয়ান’ নামক চিকিৎসালয়। সেখানে নিয়মিত চেকআপ করা হয়। প্রতিটি আবাসনে রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মী। তারা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিয়ে থাকেন।

মেধার দিক থেকেও এই শিক্ষার্থীরা এগিয়ে। পাবলিক পরীক্ষায় শতভাগ সাফল্য নিয়ে ২০১২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ জন ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় সাতজন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়জন। ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় ১০ জন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ জন। মেডিক্যাল এবং কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়েও ১০ জনের মতো ভর্তির সুযোগ লাভ করেছে। ২০১৭ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ পাসসহ পিইসিতে ৯৫ জনের মধ্যে ৮১ জন জিপিএ ৫ এবং ১৪ জন জিপিএ ৪ গ্রেড পায়।

সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে ক্রীড়া ক্ষেত্রে। বিশেষ করে জিমন্যাস্টিকসে সাফল্য কল্পনাতীত। ২০১৩ সালে ৩২তম জাতীয় জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় পাঁচটি স্বর্ণ, ছয়টি রৌপ্য ও তিনটি ব্রোঞ্জসহ মোট ১৪টি পদক। ২০১৪ সালে ৩৩তম জাতীয় জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় তিনটি স্বর্ণ, তিনটি রৌপ্য ও চারটি ব্রোঞ্জসহ মোট ১০টি পদক। ২০১৫ সালে ৩৫তম জাতীয় জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় সাতটি স্বর্ণ, ছয়টি রৌপ্য ও সাতটি ব্রোঞ্জসহ মোট ২০টি পদক অর্জন। ২০১৬ সালে সিনিয়র জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় ৯টি স্বর্ণ, ১০টি রৌপ্য ও ১০টি ব্রোঞ্জসহ মোট ৩০টির মধ্যে ২৯টি পদক। অনূর্ধ্ব-৮ বছর বালিকা দুু’টি ইভেন্টের ছয়টি পদকের পাঁচটিই অর্জন করেছে। ২০১৭ সালে বালক-বালিকা উভয় বিভাগে ১৬টি ইভেন্টে ৫৩টি পদকের মধ্যে ৩২টি এবং ২০১৮ সিঙ্গাপুর ওপেন জিমন্যাস্টিকে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন।

এশিয়ান গেমসের খো খো, টেবিলটেনিস এবং জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশেও রয়েছে সাফল্য। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। প্রধানমন্ত্রী কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে একই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় কসমোরা। ২০১৫ সালে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আনসার বাহিনীর পাশাপাশি প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠানে অংশ নেয় কসমো বাদকদল। ২০১৬ সালে ৪৭ জন সমন্বয়ে গঠিত ব্যান্ড দলে ছিল অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করেন। প্রথম স্থান লাভ করেছে তারা। এসব ছাড়াও ডিসপ্লে, আরচারি, কাবাডি ও হ্যান্ডবলে আছে কসমোদের সাফল্য।

স্কুলের তত্ত্বাবধায়ক সালেহ আহমেদের ভাষায়, ‘এই স্কুলের পাঠদান থেকে শুরু করে সব কিছুই পরিকল্পিতভাবে হয়ে থাকে। ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে কার্যক্রম। মেডিটেশন, স্কুল, খেলাধুলা সব কিছুই রুটিনমাফিক। এখানকার শিক্ষার্থীদের দিনে তিন বেলা খাবার ও চারবার নাশতা দেয়া হয়। প্রতিদিনের নাশতায় থাকে একটি সিদ্ধ ডিম, ছোলা, নিমপাতা, কালোজিরা ভর্তা, সয়াদুধ ও বাদাম। আর তিনবেলা খাবারেও সাপ্তাহিক রুটিনমাফিক মাছ-গোশত-সবজি থাকে। ছোটদের মেডিটেশন করানো হয় স্কুলে যাওয়ার আগে ও দুপুরের পর। বড়দের মেডিটেশন সন্ধ্যায়। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা, ব্যায়াম, খেলাধুলা নিয়েই গড়ে উঠছে। তারা সব কিছুতে রাখছে সাফল্যের স্বাক্ষর। এই স্কুলে তাদের জীবন গড়ার সব শিক্ষাই দেয়া হয়। এর মাধ্যমে আগামী দিনে তারা দেশে-বিদেশে সব জায়গায় মানবতার কল্যাণে কাজ করবে বলে আশা করি।’

২০১৯ সালে লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ তাদের জরিপ অনুযায়ী, এশিয়ার ৪১৭টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান আদান-প্রদান এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি- এ চারটি মৌলিক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত জরিপে নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে। যেসব সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের শিক্ষার মান নি¤œগামী, সেসব সীমাবদ্ধতা কসমোদের পদ্ধতি অনুসরণ করে দূর করা যত সহজ, প্রচলিত পদ্ধতিতে তত সহজ নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মহাবিদ্যালয় পর্যন্ত কসমোদের মনোজাগতিক বিপ্লবকে কোনো বাধাই আটকাতে পারছে না। তাই আটকে থাকতে পারে না কসমো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement
জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য বাংলাদেশের প্রাথমিক দল ঘোষণা বৃষ্টির জন্য রাজশাহীতে ইসতিসকার নামাজ আদায় গাজীপুরে মহাসড়কের পাশ থেকে মৃত হাতি উদ্ধার প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা : প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলির নিন্দা জামায়াতের রাজধানীতে তৃষ্ণার্তদের মাঝে শিবিরের বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ রাজশাহীতে সাড়ে ৬ কোটি টাকার হেরোইনসহ যুবক গ্রেফতার এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা গাজার বালিতে আটকে পড়েছে ইসরাইলি বাহিনী : হামাস মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন : যা বলছে আওয়ামী লীগ মান্দায় বিদ্যুতের আগুনে পুড়ল ৮ বসতবাড়ি

সকল