১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাবীব জালিব ও ইমরান খান

হাবীব জালিব ও ইমরান খান - ছবি : সংগ্রহ

ইসলামাবাদে এক পাহাড়ে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অবকাশকেন্দ্রের প্রশস্ত মাঠে তাঁবু টাঙ্গিয়ে একটি অস্থায়ী টিভি স্টুডিও স্থাপন করা হয়েছিল। এখান থেকে শওকত খানম মেমোরিয়াল হাসপাতালের জন্য অর্থ সংগ্রহের নিমিত্তে এআরোয়াই চ্যানেল ডিজিটাল একটি লাইভ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। হাসপাতালের পক্ষ থেকে খাজা নাজির আহমদ আমাকে এতে আমন্ত্রণ করেছিলেন।

ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে রাত প্রায় ৯টার সময় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য পৌঁছতেই দেখি, সেখানে আগে থেকেই জাভেদ মিয়াঁদাদ, আলি জাফর, শোয়াইব আখতার, জাহাঙ্গীর খান, অভিনেত্রী রীমাসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থিত। রীমা জানতে চাইলেন, ‘আপনি তো সব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। আজ প্রধানমন্ত্রীর ঘরে কিভাবে এলেন?’ আমার জবাব দেয়ার আগেই শওকত খানম হাসপাতালের সিইও ডা: ফয়সাল সুলতান তাকে আমার ব্যাপারে বললেন, ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তিনি তখন থেকেই আমাদের সাথে অর্থ সংগ্রহ করছেন এবং আজ আমরা তাকে রাজনীতি নিয়ে নয়, বরং একটি কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল।

আয়োজক ফখরে আলমও আমাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন, আপনি শওকত খানম হাসপাতাল ও ইমরান খানের রাজনীতিকে পৃথক মনে করেন, না করেন না? তাকে বললাম, আজ ইমরান খানের বিরোধিতাকারী অনেক রাজনীতিবিদ অতীতে শওকত খানম হাসপাতালে সাহায্য করেছেন। কেননা এ হাসাপাতাল ও রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।’ এরপর আমি তাকে শওকত খানম হাসপাতালের ব্যাপারে হাবীব জালিবের একটি কবিতা শোনালাম।

কল্পনাতীতভাবে এ কবিতা ওখানকার উপস্থিত সব অতিথির জন্য একটি চমক ছিল। অথচ এ কবিতাটিকে হাবীব জালিবের আত্মজীবনী ‘জালিব বীতী’তেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খুব অল্প লোকেই জানে, তিনি ইমরান খানের পিতা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ইমরান খান তার মায়ের নামে ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ শুরু করলে জালিব সাহেব একটি কবিতা লিখে আমাকে দেন। তা দৈনিক জংয়ে প্রকাশ করাই। ওই সময় নিসার উসমানী হাবীব জালিবের আত্মজীবনী সঙ্কলনের দায়িত্ব দেন আমাদের। এ লক্ষ্যে তিনি লাহোরে তার বাড়ির একটি কামরা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি ও মোজাফফর মুহাম্মদ আলী জালিব সাহেবকে রাজি করালাম। উসমানী সাহেবের বাড়িতে তাহের আসগর ‘জালিব বীতী’কে গ্রন্থাকারে রূপ দান করলেন। এ গ্রন্থ ১৯৯৩ সালে প্রকাশ হয়।

জালিব সাহেব বিশেষভাবে শওকত খানম হাসপাতালের ব্যাপারে লেখা তার কবিতা সেখানে অন্তর্ভুক্ত করান। ওই বছর তিনি ইন্তেকাল করলেন। ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ শওকত খানম হাসপাতালের অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় তিনি এ দুনিয়ায় ছিলেন না। তবে তার সদিচ্ছাগুলো কবিতার মাধ্যমে সর্বদা অমর থাকবে। হাসপাতালের ২৫ বছর পূর্তিতে এ কবিতা লাইভ অনুষ্ঠানে পাঠ করে শোনানোর পর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আমাকে বললেন, এ কবিতার কথা তিনি জানতেন না।

শওকত খানম হাসপাতালের জন্য আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ইমরান খান বলেন, এ লক্ষ্য পূরণ করার জন্য ২৫ বছর আগে তার ৭০ কোটি রুপির প্রয়োজন ছিল। তা সংগ্রহ করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। প্রথমে এক কোটি টাকা বেশ কষ্টের সাথে জমা করেন। তবে এর পর পাকিস্তানি জনগণ তার ওপর ভরসা করেন এবং তিনি হাসপাতাল নির্মাণে সফল হন। এ সফলতার কয়েক বছর পর তিনি এক বড় ব্যর্থতার মুখোমুখি হন। এ ব্যর্থতা ১৯৯৭ সালের নির্বাচন। সে নির্বাচনে ইমরান একটি আসনও জিততে পারেননি। হাসপাতালের জন্য অনুদানও কমে যায়। ইমরান খান জানান, তিনি ভেঙে পড়েননি। রাজনীতি ও হাসপাতালকে আলাদা করে ফেলেছিলেন।

অবশেষে প্রথমে খায়বার পাখতুনখাওয়া ও পরে কেন্দ্রে সরকার গঠন করেন। লাহোরের পর তিনি পেশোয়ারেও ক্যান্সার হাসপাতাল বানিয়েছেন। এখন করাচি ও কোয়েটাতেও ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ আলোচনায় ইমরান খান বলেন, বর্তমানে হাবীব জালিব ভারতে বেশ জনপ্রিয়। ভারতে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে আয়োজিত সমাবেশগুলোতে তার একটি কবিতার এ পঙ্ক্তিগুলো বেশ জনপ্রিয়। -জুল্ম কী বাত কো, জাহ্ল কী রাত কো/ ম্যাঁয় নেহীঁ মানতা, ম্যাঁয় নেহীঁ মানতা- জুলুমের কথা, অন্ধকার রাত/ মানি না, মানি না।

এ পঙ্ক্তিগুলো তার বিখ্যাত কবিতা ‘দাসতূর’-এর অংশবিশেষ। এ কবিতার মাধ্যমে হাবীব জালিব আইউব খানের পক্ষ থেকে ১৯৬২ সালে জারিকৃত দাসতূর বা সংবিধান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইমরান খান তার বেশির ভাগ ভাষণে আইউব খানের শাসনামলকে ‘বেশ অনুকরণীয়’ বলে অভিহিত করে থাকেন।

কেননা আইউব খানের পৌত্র উমর আইউব তার সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী। জালিব যখন আইউব খানের সংবিধানকে ‘আলোহীন প্রভাত’ আখ্যায়িত করে বলেন, আমি মানি না, তখন তার বিরুদ্ধে হত্যা প্রচেষ্টা ও মদ্যপানের মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল, যাতে তিনি ফাতেমা জিন্নাহর সমাবেশে গিয়ে এ কবিতা শোনাতে না পারেন। পুলিশ তার কাছে শুধু ‘চাকু রয়েছে’ নয়, বরং একজন ‘আহত’ও জোগাড় করে ফেলে। ওই ব্যক্তির ‘রক্তাক্ত’ জামার পাশাপাশি দুই বোতল মদও উদ্ধারের তালিকায় দেখানো হয়।

এ মামলা শুরু হলে আইউব খান বিপদে পড়ে যান। তার তথ্যসচিব পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নওয়াব কালাবাগকে বলেন, জালিব তো আধা বোতলই কিনতে পারবে না, আপনারা তার কাছ থেকে দুই বোতল উদ্ধারের কথা বলেছেন। এরপরও কবির জামিন হলো না। মামলা হাইকোর্টে গেলে তার উকিল মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি আদালতকে বললেন, জালিব কাউকে চোখ মারতে পর্যন্ত পারেন না, তিনি কি না চাকু মারবেন। এতেই জামিন হয়ে গেল। আজকাল ইমরান খানের সরকারের বিরোধীদের বিরুদ্ধে এমন ধরনের কিছু মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা হচ্ছে, যাতে সরকার বেশ নাজেহাল হচ্ছে।

মোটকথা, ইমরান খানের রাজনীতি ও শওকত খানম হাসপাতাল দুটি ভিন্ন জিনিস। হাবীব জালিবের ওই কবিতা সামনে রয়েছে, যেখানে তিনি এ কল্যাণমূলক কাজের ব্যাপারে তার শুভকামনা প্রকাশ করেছেন। এ কল্যাণমূলক কাজে দলমত নির্বিশেষে সবারই অংশগ্রহণ করা উচিত।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০২ জানুয়ারি, সংখ্যা থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল