২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘আসু’দের কান্না যখন শুনি

‘আসু’দের কান্না যখন শুনি - ছবি : সংগ্রহ

বিশ্বের প্রতিটি শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে সমাজে তার যোগ্য স্থান ও মর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘ ১৯৯২ সালে ৩ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধীজন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি গুরুত্বের সাথে পালিত হয়।

অভিজ্ঞতা বোধ করি মানুষের জীবনের অনেক বড় সম্পদ। এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাই রিটু যখন দোলনায় শুয়ে হাত-পা নেড়ে খেলছিল, তখন আমাদের পোষা বানরটি দোলনায় বসে ওর খেলা উপভোগ করছিল। এ দৃশ্য দেখে আমার কিশোরী মন জানতে চেয়েছিল- ‘ওদেরকে আমরা পশু বলি কেন?’ পরিণত বয়সে অন্য সবার মতো আমি আমার প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর পেয়েছিলাম। আমরা সামাজিক জীব হলেও বনজঙ্গলের পশুদের কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক বিষয়।

এ বছর প্রতিবন্ধীজন দিবসে আসু (পুরো নাম আসাদ), আর্শিয়া ও শানের মতো শত শত অটিস্টিক শিশু-কিশোরের কথা মমত্বসহকারে স্মরণ করছি। আগাধা ক্রিস্টি ও ওয়াল্ট ডিজনির মতো বিখ্যাত মানুষেরাও অটিজমের শিকার হয়েছিলেন। তবে সময়মতো চিকিৎসা, সতর্কতা ও যতেœর কারণে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বলেই আজ অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের কাছে তারা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন।

আমি চিকিৎসক বা চিকিৎসাবিজ্ঞানী নই। এ বিষয়ে কিছু লেখা বা বলাও ধৃষ্টতা মাত্র। তবে অটিস্টিক শিশু-কিশোররা আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে অনেকটা জায়গা দখল করে আছে। অটিজমকে রোগ না বলে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা বা ভিন্নতা বলা যেতে পারে। এসব শিশুর স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক বেড়ে ওঠা বিলম্বিত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, জেনেটিক ও পরিবেশগত কারণে শিশুরা অটিস্টিক হয়। বিশ্বে প্রায় ২২ মিলিয়ন অটিস্টিক শিশু-কিশোর রয়েছে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেশিশুরা পাঁচ গুণ বেশি অটিজমে আক্রান্ত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬৮-তে একটি অটিস্টিক শিশুর জন্ম হয়। বাংলাদেশে শতকরা ০.৮ ভাগ শিশু-কিশোর অটিস্টিক। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ওষুধই সব রোগের প্রতিকার নয়, পাশাপাশি প্রয়োজন মনোচিকিৎসা বা আরো সহজভাবে বলা যায় একটু আদর, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সহানুভূতি বা ভালো আচরণ। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, সব প্রাণীর সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে প্রিয়। কিন্তু আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী বা সমাজের অন্য সদস্যরাও যদি এসব পিছিয়ে পড়া শিশু-কিশোরের প্রতি একটু যত্নবান হন তাহলে সমাজ উপকৃত হবে আর মানবতা জয়গান গাইবে।
কয়েক দশক ধরে অটিজম বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সংস্থা আন্তরিকতার সাথে কাজ করে চলেছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো জোরালো ভূমিকা পালন করছে। বলা যেতে পারে বর্তমানে আমাদের দেশে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, যার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী-তনয়া সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এ জন্য বাংলাদেশে ২০১২ সালকে ‘অটিজম বছর’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আশা করছি, এ ব্যাপারে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে; যার ফলে এসব শিশু-কিশোর একদিন খ্যাতিমান মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। একটু নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বড় প্রয়োজন। গান শেষ হলে বনের পাখিটার কথা যেমন আমরা ভুলে যাই, এসব সরলমতি পিছিয়ে পড়া শিশুর বেলায় যেন সেটা আমরা না করি।

মনে পড়ছে ১১ বছর আগের কথা। আসুর আম্মা ওপর থেকে আমার তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে এসে অনুরোধের সুরে বললেন, ‘আপনি তো ওকে অনেক মহব্বত করেন, একটু যদি এসে ওকে ওষুধ খাওয়ান, খুবই উপকৃত হব। কারণ ও আপনাকে দেখলে খুশি হয় এবং শান্ত থাকে।’ সারা রাত আসুর কান্না যেন সবার জন্য রুটিন ব্যাপার ছিল। ওর কান্না শুনে আমার মনে হতো বোধহয় আমরা শ্রবণশক্তি হারিয়েছি নতুবা অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি আর তা না হলে এক আদম সন্তান কেঁদে রাত কাটায় অথচ আমরা অনেকে ঘুমে বিভোর থাকি। আসু এখন মানসিকভাবে অনেক ভালো আছে, আর কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না।

আমরা বর্তমানে এক অশান্ত পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে বৃষ্টিপাতের চেয়ে রক্তপাত বেশি হয়; অথচ আমরা ভুলে যাই যে, শুধু ওষুধ বা অস্ত্র নয়, ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদার তেরেসার মতো মহামানবীরা তাদের আন্তরিকতা ও স্নেহের পরশ দিয়ে মানুষের সেবা করেছেন এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সমাজকে এগিয়ে নিতে অবদান রেখেছেন। সুস্থ জীবনের সুস্থ সুন্দর পরিবেশ অপরিহার্য; আর সুন্দর মনই পারে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে। আমাদের মনের দূষণ দূর হলেই পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সুস্থভাবে বসবাসের জন্য বিশেষ করে ঢাকা শহর প্রায় অযোগ্য হয়ে উঠেছে। কার্বন নিঃসরণ, নদী দূষণ, পানি ও শব্দ দূষণ এর মূল কারণ। অটিজম বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষণমুক্ত পরিবেশ এসব শিশু-কিশোরের জন্য বড় প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। দূষিত পরিবেশে বদ্ধ খাঁচার মতো ফ্ল্যাটে বসবাস করলে অটিজম ছাড়াও হার্ট এবং ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সাধারণভাবে আমরা জানি, শিশুদের সুস্থ মন ও দেহের জন্য এজাতীয় পরিবেশ ক্ষতিকর। খোলা মাঠে খেলাধুলা, দূষণমুক্ত বাতাস ও সুপেয় পানিই পারে সেই ঝুঁকি কমাতে। এ ছাড়া সামাজিকীকরণ, বন্ধুসুলভ আচরণ এবং নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা পেলে এসব শিশু সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে। বাক্সকেন্দ্রিকতা এবং ছবি-পর্দাসক্তি অটিস্টিক শিশুদের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কম গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আমরা লক্ষ করছি, কর্মজীবী বাবা-মা তাদের সন্তানদের সময় দিতে পারছেন না। ফলে এসব শিশু বাবা-মায়ের সঙ্গ কম পায় বলে মন কান্নায় ভরে ওঠে বা হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং এ অবস্থা তাদের মানসিকভাবে ভিন্নতা এনে দেয়। আর্শিয়ার মা একজন সম্মানজনক চাকরিজীবী ছিলেন, কিন্তু সন্তানের জন্য ছেড়ে দিলেন। ওনাকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন। সম্মানিত পাঠক, অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের মায়েদের চাকরি ছাড়তে বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার আকুতি আর্শিয়ার মতো এরাও যেন মায়ের সঙ্গ বেশি পায়। সময়ের অভাবে সঠিক পরিচর্যা না করলে একটা চারা গাছও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। একটি শিশুও এর ব্যতিক্রম নয়।

আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে পারলে জাতি উপকৃত হবে। অন্য শিশুদের মতো মেধা বিকাশের সুযোগ পেলে ওরাও হতে পারবে কীর্তিমান। সব অটিস্টিক, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের সুন্দর, স্বাভাবিক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমার একান্ত কামনা।

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
টি-২০ খেলতে সিলেটে পৌঁছেছে ভারতীয় নারী ক্রিকেট দল খুলনায় হিটস্ট্রোকে এক ব্যক্তির মৃত্যু ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলল যুক্তরাষ্ট্র? জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য বাংলাদেশের প্রাথমিক দল ঘোষণা বৃষ্টির জন্য রাজশাহীতে ইসতিসকার নামাজ আদায় গাজীপুরে মহাসড়কের পাশ থেকে মৃত হাতি উদ্ধার প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা : প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলির নিন্দা জামায়াতের রাজধানীতে তৃষ্ণার্তদের মাঝে শিবিরের বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ রাজশাহীতে সাড়ে ৬ কোটি টাকার হেরোইনসহ যুবক গ্রেফতার এফডিসিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা

সকল