২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দিল্লির শীতল আচরণে জাতি লজ্জিত

-

বাড়ছে বন্দুকযুদ্ধ। বিচারে সরকারের আগ্রহ নেই। ৪৯৭ দিনে বন্দুকযুদ্ধে ৪৫৬ জন সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত। ক্রসফায়ার না ডাইরেক্ট গুলি- বুঝে ওঠা মুশকিল। বিচার ছাড়া কোনো মানুষকে খুন করাও বড় অপরাধ। একটি জাতীয় দৈনিকের (১৮-১০-১৯) হেডলাইন ছিল ‘নিষ্ঠুর নৃশংসতায় পাঁচ বছরে খুন ১৭ হাজার, ৯ মাসে ৩২০ শিশু খুন।’ ২২ নভেম্বর ২০১৯ চমকে দেয়ার মতো একটি নিউজ ছিল এরকম- কুমিল্লায় বাড়ছে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা। রহস্য উদঘাটনে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা।

বিগত ১০ বছরে যত মানুষ মারা গেছে, তার আগের ১০ বছরের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, বিগত ১০ বছরের সংখ্যা অতীতের সব মৃত্যুর রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বলছি যুদ্ধ নয় শান্তি, হিংসা নয় অহিংসা। আমরা একের পর এক দালান কোটা, রাস্তা, সেতুর মতো বড় বড় স্থাপনা বানিয়ে বলছি দেশ উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু সমাজটা ভেতরে ভেতরে রসাতলে যাচ্ছে। আমরা কি একটি গায়েবি দেশের মানুষ? কারণ দেশ থেকে গণতন্ত্র গায়েব, বাড়ি থেকে মানুষ গায়েব, ব্যাংক থেকে টাকা গায়েব, লকার থেকে সোনা গায়েব, খনি থেকে কয়লা গায়েব, সড়ক পথ থেকে নিরাপত্তা গায়েব, সুন্দরবন থেকে বন গায়েব- এটা গায়েবি দেশ। অনেক গুণীজনের মুখে এ শব্দমালা শোনা যায়। আজকাল এলাকার মানুষ ডেকে খুন করা হয়। সিলেটের জকিগঞ্জে বিচারের নামে এক যুবককে বাঁশের সাথে হাত-পা বেঁধে নির্যাতনের দৃশ্য মিডিয়ায় দেখা গেছে (২২-১১-২০১৯)। বাড়ির উঠোনে গোল হয়ে বেশ কয়েকজন এ দৃশ্য দেখছেন। টুপি মাথায় আনুমানিক ৩৪-৩৫ বছর বয়সী এক যুবককে কেন লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে, তার উত্তর কর্তৃপক্ষের অজানা। দেশে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটছে, যার সঠিক জবাব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জানেন না।

বিগত ১০ বছরে প্রায় ১০০০ মানুষ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়, যার বেশির ভাগই বাংলাদেশী। ২৩ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় লিড নিউজ করেছে- ভারত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। গত কয়েক দিনে প্রায় ৩০০ বাংলাভাষীকে বিএসএফ যশোরের বেনাপোল দৌলতপুর ও ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠিয়েছে। সীমান্তের ওপারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারত সরকার জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তথা এনআরসি চূড়ান্ত করেছে। ইতোমধ্যে আসাম থেকে ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ হিসেবে বাংলা ভাষাভাষীদের আটক করে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছে। সীমান্তপথে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ জন অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। আরো বেশ কিছু বাংলা ভাষাভাষীকে ওপার সীমান্তে জড়ো করা হয়েছে। মিডিয়া বলছে, এটি আরেক রোহিঙ্গা সদৃশ্য ঘটনা হতে চলেছে। এক দিকে মিয়ানমার, অন্য দিকে ভারত-তাদের জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাংলাদেশকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। এখনই যদি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপন না করে, তা হলে বাংলাদেশকে দুই দেশের জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের চাপ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

’৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল নিজেদের স্বার্থে। যেটা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল- পাকিস্তানকে দুর্বল করা, অন্য দিকে বাংলাদেশকে তাদের বাজারে পরিণত করা এবং ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটানো। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় ভারতীয় নজরদারি বাড়ানোর কথাও বলছে ভারত। একসময় এ দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবীরা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে লাহোরের ছবির বিরুদ্ধে রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিল সেই দৃশ্য আমি নিজেই দেখেছি। অথচ আজ ভারতের চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে তারা বড়ই নীরব। এ কারণে বাংলাদেশে অনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত বেগে বাড়ছে। ভারত তাদের স্বার্থ পুরোমাত্রায় আদায় করে নেবে আর আমাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করবে। এটা কোন ধরনের বন্ধুত্ব, বুঝে আসে না। কূটনৈতিক চালে তারা জিতে যাচ্ছে আর আমরা হেরে যাচ্ছি। এভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না। গত অক্টোবরে ভারত সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিমান যখন নয়াদিল্লিতে অবতরণ করে, তখন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন প্রথমবারের সংসদ সদস্য তথা নারী ও শিশুকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী। হাসিনার সফরসঙ্গী নেতারা ঘরোয়াভাবে জানিয়েছিলেন, এটা যেচে অপমান নেয়া। নিয়ম হলো প্রতিবেশী বলয়ে ভারতের ‘পরম বন্ধু’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বা কোনো সিনিয়র ক্যাবিনেট মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন, এটাই ছিল প্রত্যাশা। ২২ নভেম্বর ২০১৯ শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলকাতা যান। কিন্তু তাকে স্বাগত জানাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মন্ত্রী এমনকি শীর্ষ আমলাকেও পাঠানো হয়নি। এ আচরণ পুরোপুরি কূটনৈতিক প্রথাবিরোধী। কেন এমন উদাসীনতা প্রদর্শন সে বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো কিছু জানাতে রাজি হয়নি সাউথ ব্লক। এ ঘটনার সমালোচনা করেছে ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলোও। পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক প্রসিদ্ধ বাংলা সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার ২৪ নভেম্বর রোববার এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে- পরম পূজনীয় মিত্রের ভারত সফরে দিল্লির এই উদাসীনতা কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি অনুপ্রবেশের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চুপ কেন? এসব ব্যাপারে অবাক করেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। জাতি প্রত্যাশা করে এসব অপমানিত, অশোভনীয় আচরণের ব্যাপারে প্রতিবাদমুখর হওয়া।

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
E-m.harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement