২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘সোনার বাংলা’ ও শৌর্যে বীর্যে বাঙালি

-

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত বাংলাভাষী ভৌগোলিক অঞ্চল দু’টি প্রাচীন আমলে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত একাধিক রাজ্যে ছিল বিভক্ত। দেশটির বেশির ভাগ অঞ্চল নব্য ভূমি। পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদীগুলোর বাহিত, হিমালয়ের পলি দিয়ে গঠিত এই অঞ্চল হিমালয়ের পাদদেশে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ বাংলা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ ভূভাগই গড়ে উঠেছে গঙ্গা, ভাগীরথী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের বয়ে আনা বেলেমাটিতে, যা পৃথিবীর প্রাচীন ভূভাগগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত হাল আমনের। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোকে একত্র করে শাহ-ই বাঙ্গালা উপাধি ধারণ করে উত্তরবঙ্গের লক্ষণাবতীকে রাজধানী করে স্বাধীন বাংলা স্থাপন করেছিলেন।

এটা ছিল পূর্ববর্তী হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজাদের ভূমিকার ব্যতিক্রম। তারা নিজেদের গৌড়েশ্বর বা গৌড়রাজ বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ইলিয়াস শাহ-ই প্রথম পুুরো বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলকে বাঙ্গালাহ নাম দিয়ে ছিলেন। এভাবে তিনি এ দেশে প্রথম সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে বাংলায় স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করেন। তাই তাকে বাংলার স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়।

বঙ্গ অববাহিকায় মানুষের আগমন শুরু হয় প্লেইস্টিসিন যুগে। তুষার যুগে শীতল স্থান থেকে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে মানুষের আগমন ঘটেছিল। চলমান মানুষের বসতি এখানে বসে প্রাক ঐতিহাসিক যুগে। এই উপমহাদেশে প্রথম আসে খর্বকায় নিগ্রোপ্রতিম লোকেরা। তারা আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপ হয়ে পারস্যের উপকূল বেয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করে। এরপর আদি অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী এ দেশে আসে বলে মনে করা হয়। এরপর আসে আর্যভাষী নর্ডিক মোঙ্গলরা। তারাই প্রাক ঐতিহাসিক যুগের সর্বশেষ জনধারা।

ঐতিহাসিক কালেও বিভিন্ন জনধারার মানুষের আগমন এ দেশে কখনো বন্ধ হয়নি। এ জনস্রোতের তালিকায় দেখা যায় আসিরীয়, পারসিক, মেসিডোনিয়ান, গ্রিক, ফিনিশীয়, শক ও কুশানদের। পরবর্তীকালে আসে আরব, তুর্কি, ইরানি, আফগান, মোগলরা এবং অনেক পরে আসে ইউরোপীয়রা। ইউরোপীয়রা ছাড়া অন্যান্য জনগোষ্ঠী এ দেশে তাদের স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছে। প্রাক ঐতিহাসিক জনস্রোতের সংমিশ্রণেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল উপমহাদেশের মানুষের রক্তধারা- চেহারার আদল, মনের গড়ন আর ভাষা, এসব নানা জনধারার সংমিশ্রণে গঠিত হয় বাংলার মানুষ। তাই বাঙালিরা শঙ্কর জাতি।

হেথায় আর্য হেথা অনার্য- হেথায় দ্রাবিড় চীন।/শকহুন দল মোগল পাঠান/ এক দেহে হল লীন। রবীন্দ্রনাথ নদীবাহিত পলিমাটি দিয়ে গঠিত হওয়ায় এখানে মাটি উর্বর। স্বল্প পরিশ্রমে অধিক উৎপাদন হওয়ায় এ দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোক বসতি স্থাপন করেছে। তাই দেখা যায় একজন অবাঙালি সেনাপতির ভাষায়, ‘পশ্চিম ভারত থেকে কেউ বাংলায় গেলে তাকে বাংলার মাটি মোহগ্রস্ত করত। আমরা শুনেছি, পশ্চিম ভারতের একবার একদল লোক অবশ্যই পুরুষ, বাংলায় গিয়ে আর ফিরে আসেনি। কেউ জানে না, কী ঘটেছিল তাদের, শুধু বলা হয়েছে যে, তারা বাংলার মায়াজালে আটকা পড়েছে। কারা আটকিয়ে ছিল তাদের? সম্ভবত বাঙালি রমণীদের সম্মোহনী চোখ কিংবা বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদ আহরণের সহজলভ্যতা। কিন্তু অধিকাংশ মনে করত এটা ছিল বাঙালি জাদুর কাজ।’

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আর্য ভূখণ্ডের সীমানার বাইরে দস্যু অধ্যুষিত ‘পুণ্ড্র’র উল্লেখ দেখা যায়। ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গবাসীদের ‘পাপাচারী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গের নাম প্রথমে উল্লেখ করা হয়। ধর্মশাস্ত্রের রচয়িতাদের গুরুরূপে বিবেচিত বৌধায়ন বলেন, পুণ্ড্র ও বঙ্গ এত অপবিত্র যে, সে অঞ্চলে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করলেও ফিরে এসে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এ দেশীয় তরুণীদের সাথে মেলামেশার জন্য আর্য তরুণদের শাস্তি ছিল তপ্ত লোহা শলাকার ব্রাত্য চিহ্ন ধারণ। আর্যদের পুণ্ড্র বঙ্গবাসীদের প্রতি এহেন ঘৃণা প্রকাশের কারণ, তাদের বাংলায় অনুপ্রবেশে হাজার বছর লেগেছিল। অধ্যাপক এম এস আলী বলেন, the Eastward progress of the Aryans was also difficult, it appears from the early hymns of Rigveda of the 15th-12th century B.C. that the Aryans had to fight hard against the dark skinned Dayasus for every inch of ground.
.
এ দেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকদের শতবর্ষ লেগেছিল প্রতিরোধ দমন করতে। তাই তারাও বাঙালিদের হেয় করতে নানাভাবে ছিল সচেষ্ট। এ ছাড়া তদানীন্তন পাকিস্তানিরাও বাংলার মানুষদের শোষণ ও বঞ্চনা করেছে। তাদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডকে হালকা করতে এ হীন আচরণের আশ্রয় নেয়া হয়। তাই তারা বাঙালি মুসলমানদের প্রতি ইতিহাস সমর্থিত নয় এমন কিছু অপবাদ আরোপ করতে সদা ব্যস্ত ছিল। তা ছিল এরকম। ১. বাঙালিরা নিম্নশ্রেণীর হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত; তাই ইসলাম তাদের মনে সঠিকভাবে প্রোথিত নয়। ২. এরা ভূখা বাঙালি, সবসময় অভাবগ্রস্ত। ৩. বাঙালি যোদ্ধা জাতি নয় এবং ভীরু। ৪. বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু প্রভাবিত।

তাই দেখা যায় সেনা শাসক আইযুব খান তার বই Friends not Masters এভাবে লিখেন- It would be no exaggeration to say that upto the creation of Pakistan (the Bengalis) had not known any real freedom. They have been in turn ruled by the caste Hindus, Mughals, Pathans or British. In addition, they have been and still are under considerable Hindu cultural and linguistic influence. As such, they have all the inhibition of downtroen races.

তার এই বক্তব্য অসত্য এবং ঐতিহাসিক তথ্যবিরোধী। বাংলার অধিবাসীরা বিশেষ করে মুসলমান জনগোষ্ঠী ছিল বর্ণহিন্দু, বৌদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান অভিবাসী ও নিম্নশ্রেণীর ধর্মান্তরিত মুসলমানদের দ্বারা পুষ্ট। তারা যদি বিশেষত হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, তাহলে তারা কিভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ১৯৪৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে একচেটিয়া ভোট দেয়? অথচ তখন বাংলার হিন্দুরা ছিল বেশ প্রভাবশালী। আর পাঞ্জাবি ও পাঠানরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। আসলে এসব ছিল বিদ্বেষপ্রসূত ও পরিকল্পিত অপবাদ। মুসলমানরা সাড়ে পাঁচশত বছর বাংলায় শাসন পরিচালনা করেছে। বহুল পরিচিত আলতাফ গওহর তার সাক্ষাৎকারে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনকে বলেছেন, আইয়ুব খান বাঙালিদের দাবির ‘মেরিট’ বুঝেননি। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন বাঙালিদের সামরিক বাহিনীতে নেয়া হচ্ছে না? উত্তরে তিনি বললেন, ব্রিটিশরা নীতি করেছে।

আমি বললাম, তাহলে গোর্খাদের তারা সেনাবাহিনীতে কেন নিয়েছিল? আর জেনারেল রাও ফরমান আলীদের ‘বাঙালি বাবু, বাঙালি জাদু ও ভূখা বাঙালি’ ধারণা ঐতিহাসিকভাবে অসত্য ও অর্থ সত্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। সাংবাৎসরিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলার মানুষ পর্যুদস্ত হলেও তারা সর্বদা সাহসের সাথে এর মোকাবেলা করেছে এবং এখনো করছে। যে দু’টি দুর্ভিক্ষের কারণে ‘ভূখা বাঙালি’ বলা হয়, যাতে হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেল, সেই দুর্ভিক্ষ দু’টি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের অপশাসন ও দুঃশাসনের সৃষ্টি। ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল নবাব ও ব্রিটিশ কোম্পানির দ্বৈত শাসনের কারণে সৃষ্ট। আর ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর জাপানিদের ভয়ে ব্রিটিশদের বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের দরুন। সবসময় এ বাংলা ধনধান্যপুষ্পে ভরা ছিল এবং এখনো আছে। আর পাকিস্তান আমলের খাদ্যাভাব ছিল শাসকদের সৃষ্টি। তারা সাত কোটি মানুষকে খাদ্য দিতে অপারগ ছিল। আর এখন ১৭ কোটি মানুষের সুজলা-সুফলা সোনার বাংলা পেটভরে খেতে দিচ্ছে এবং তা বিদেশেও রফতানি করছে। স্মরণাতীত কাল থেকে এ দেশের সহজলভ্য ঐশ্বর্যের দরুন বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এ দেশে বসতি স্থাপন করেছে।

এখানকার জমিনে অসামান্য উর্বরতা, শস্যের প্রাচুর্য ও অধিবাসীদের সমৃদ্ধির বর্ণনার ইতিহাস বিদেশী পর্যটকদের লেখনীতে উল্লিখিত হয়েছে। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা কয়েক মাস অবস্থান করে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন। তার অভিজ্ঞতায় তিনি বাংলাকে বসবাসের জন্য উত্তম জায়গা এবং ‘সব রকমের ভালো জিনিসের নরক’-দোজখে পুর নেয়ামত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, নদীপথের দু’ধারে ডানে ও বামে ছিল বহু পানিচালিত চাকা, উদ্যানরাজি ও অসংখ্য গ্রাম, নীল নদের গতিপথে মিসরের মতো।... আমরা দীর্ঘ পনেরো দিন ধরে, গ্রাম ও উদ্যানরাজির মধ্য দিয়ে নদীপথে ছিলাম। মনে হয়েছিল যেন একটা বাজারের ভেতর দিয়ে গমন করছি (বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ডক্টর এম এ রহিম পৃষ্ঠা ১৩/১৯)।

প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকে বাঙালি জাতি শৌর্যবীর্য সাহসিকতার জন্য প্রসিদ্ধ। মিলিন্দ-পঞ্চহ গ্রন্থে সমুদ্রযাত্রীর তালিকায় বঙ্গ দেশের উল্লেখ করা হয়েছে। মহাকবি কালিদাসের উল্লেখ থেকেও জানা যায়, তার সময়ে বঙ্গের নৌবাহিনী বিখ্যাত ছিল। নৌ যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালিদের জয় করতে কালিদাসের নায়ক রঘুকে বেগ পেতে হয়েছিল। মহাভারতে পুণ্ড্রর অধিপতি বাসুদেবের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের দ্বন্দ্ব ও এর স্বাক্ষর বহন করে। তিনি ৮০০০ রথ, কয়েক হাজার গজারোহী, অগণিত পদাতিক সৈন্য নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এ ছাড়া চীনা ভাষায় রক্ষিত প্রাচীন কাহিনী থেকে অনুমান করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বাঙালি জাতি বর্তমান ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া বা আননামে রাজত্ব স্থাপন করেছিল। শ্রীলঙ্কার পুরা কাহিনীতে বঙ্গের সন্তান বিজয় সিংহের লংকা অভিযানের কাহিনী বর্ণিত আছে।

আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ/লংকা করিয়া জয়/সিংহল নামে রেখে গেছে/নিজ শৌর্যের পরিচয়।

আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন, তার মোকাবেলায় আর্যরা হার মানে। কিন্তু বাঙালি গঙ্গারিডই ও প্রসিয় রাজগণ এক বিশাল সৈন্যবাহিনী ও চার হাজার সৈন্যের হস্তী বাহিনী নিয়ে তার প্রতিরোধের অপেক্ষায় থাকেন। কথিত আছে, তার সৈন্যরা এই খবর শুনে আর এগোতে চায়নি। তাই আলেকজান্ডার বাংলা আক্রমণ না করে পিছিয়ে যান। এ ছাড়া আর্যরা ভারতে অন্য সব অঞ্চল দখল করে নিতে পারলেও তারা বাংলায় অনুপ্রবেশ করতে হাজার বছর লেগে গিয়েছিল। তাই আর্যরা বাংলার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। তারা এর প্রতি ছিল বিদ্বেষপরায়ণও। এ জন্য পরবর্তীকালের জন্য আর্যরা ব্যবহার করেছিল বাংলা ও বাঙালিদের প্রতি অশালীন আচরণ ও ভাষা।

মধ্যযুগে এ অঞ্চলে মানুষ দিল্লির শাসকদের প্রতিহত করে স্বাধীন ছিল আড়াই শ’ বছর। বাবর মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হলেও এ দেশ জয়েব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় বাঙালিদের শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করেছেন এবং বাঙালিদের গোলন্দাজ বাহিনীর নৈপুণ্যের সশ্রদ্ধ স্বীকার প্রদান করেন। এজন্য ঐতিহাসিকগণ বাংলাকে বিদ্রোহীদের আস্তানা আখ্যা দেন। আধুনিক যুগেও বাঙালির শৌর্যবীর্য ও দক্ষতা বিশ্ব খ্যাত। যেমন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন অংশ নিয়েছিল। বীরত্বের সাথে ভারত বিরাট ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে লাহোর ফ্রন্টে যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, তা প্রতিহত করে তারা লাহোর রক্ষা করেছিলেন। তাই তারা তখন দু’টি সিতারা-ই-জুরাত, ৬টি তমগায়ে বাছালাত পদকে ভূষিত হয়। তা ছিল সে যুদ্ধে কোনো একক ব্যাটেলিয়নের প্রাপ্ত পদকের তুলনায় শীর্ষে।

এছাড়া শার্দুল দামাল বাঙালি ছেলে গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফখরুল আজম (অবসরপ্রাপ্ত এর) বিজয়গাথা স্মরণীয়। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে যখন সমস্ত আরব জগৎ পর্যুদস্ত, সেন্টো চুক্তি অনুযায়ী তৎকালীন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আজম তখন জর্দানে বদলি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জর্দানেও ইসরাইলি বিমানবাহিনী হামলা চালায়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আজম তখন একটি হান্টার বিমান নিয়ে ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলোকে প্রতিরোধ এবং দু’টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেন। অন্যদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। তার বীরত্বের জন্য জর্দানের বাদশাহ হোসেন তাকে সে দেশের সর্বোচ্চ বীরত্ব পদকে ভূষিত করেন।

এর আগে ১৯৬৫ সালে ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধে বাঙালি বৈমানিকরা ভারতীয় বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে মোট সাতটি সিতারা-ই-জুরাত পদক লাভ করে। তা ছিল পাকিস্তানি জাতি-গোষ্ঠীর বৈমানিকদের মধ্যে সর্বোচ্চ। জনাব আজমও সেই যুদ্ধে সিতারা-ই-জুরাতপ্রাপ্ত। জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা গত ত্রিশ বছর ধরে কর্মরত। তারা দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণভাবে সফল। এ জন্য তারা জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে আফ্রিকার সিয়েরা লিওনের সরকার বাংলাকে তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কন্টিনজেন্টের বাংলাদেশী অধিনায়ককে তাদের দেশের জনগণ রাষ্ট্রপতি বানাতে দাবি জানিয়ে মিছিল বের করেছে। এমনিভাবে সব দেশে যেখানে বাংলাদেশের কন্টিনজেন্টকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের দক্ষতা ও সাহসিকতা প্রশংসিত হয়। এ জন্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতিসঙ্ঘের মূল্যায়নে প্রথম সারির দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা।

এ ছাড়াও ১৯৯০ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত দখল করে নেন, তখন আমেরিকার নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ইরাকি সেনা বাহিনীকে পরাজিত করে। পিছু হটার সময় ইরাকি বাহিনীর বিপুল পরিমাণ মাইন ও গোলাবারুদ কুয়েতের রাজধানী শহরের চার দিকে ফেলে যায়। এটা কুয়েতবাসীর জন্য মৃত্যুফাঁদ হিসেবে দেখা দেয়। কুয়েতের ডিফেন্স মিনিস্টার ওই সব মারাত্মক সরঞ্জাম স্বল্প সময়ে অপসারণের জন্য উপস্থিত বিভিন্ন দেশের অধিনায়কদের প্রস্তাব দেন। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পাকিস্তানসহ প্রায় ১২টি দেশের অধিনায়ককে এই বিপজ্জনক কাজ করে দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। তারা ৩-৪ মাসে ওই সব জঞ্জাল পরিষ্কার করতে পাররেন জানান। কিন্তু উপস্থিত বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের অধিনায়ক মাত্র ৩০ দিনে ওই সব মারাত্মক গোলাবারুদ, মাইন ইত্যাদি অপসারণে তাদের সক্ষমতা জানালেন। বাংলাদেশ বাহিনীর স্বল্প সময়ে এই কাজ সমাপ্তির প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তাদেরকেই এই দুরূহ কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

আমাদের বীর সৈনিকরা ২৮ দিনে এ বিরাট বিপজ্জনক কাজ শেষ করে কুয়েত কর্তৃপক্ষকে জানায়। সবাই বাঙালি সৈনিকদের স্বল্প সময়ে এই দুরূহ কাজ সমাপ্ত করার জন্য তাদের অভিনন্দন জানায়। এটা অন্য সবার জন্য ছিল অবিশ্বাস্য। প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি ছেলেরা তাদের শৌর্যবীর্যের জন্য খ্যাতিমান। কিন্তু বিদ্বেষপরায়ণ স্বার্থান্বেষী মানুষ অন্যায়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দিতে সচেষ্ট।

লেখক : অব: স্কোয়াড্রন লিডার


আরো সংবাদ



premium cement