২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

সমাজে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রভাব

-

বাংলাদেশের সমাজ ক্রমেই অস্থির ও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এর পেছনে চলমান রাজনীতি ও রাজনীতিকদের আচরণের ও কথাবার্তার একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। কারণ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আজকের সমাজ রাজনীতি শাসিত। রাজনীতিকরা দেশকে যেমন চালাতে এবং গড়তে চান, দেশের সমাজ ব্যবস্থা তেমনি চলে এবং গড়ে ওঠে। এককালে সমাজ গঠনে রাজনীতি নিরপেক্ষ আদর্শনিষ্ঠ পীর দরবেশ, সমাজপতি ও শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। আজ আর সেটা নেই। প্রায় সব কিছুই রাজনীতিকদের হাতে চলে গেছে। শিক্ষা সংস্কৃতি ধর্ম-কর্ম থেকে শুরু করে বাজার পর্যন্ত সবই রাজনীতিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন। পত্রিকায় কী ছাপা হবে, টেলিভিশনে কী দেখানো হবে, অনলাইনে কী চলবে, বিচারব্যবস্থা কেমন হবে- সবই তারা বাতলে দিচ্ছেন। এমনকি জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক কর্মীদের এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের আচরণ কেমন হবে, তা থেকে শুরু করে পুলিশ কাকে ধরবে আর কাকে ছাড়বে প্রভৃতি প্রায় সবই রাজনীতিকরা ডিক্টেট করে থাকেন। বর্তমানকালে প্রায় সব দেশের সমাজ গঠনে এবং মানুষের সামাজিক আচরণে রাজনীতিকদের আচরণের এবং ভাবাদর্শের ভালোমন্দের প্রভাব অপরিসীম। এক কথায় বলতে গেলে, আজকের দিনে দেশের সমাজ গঠনে রাজনীতিকরাই প্রধান নির্দেশক ও শিক্ষকের ভূমিকায় আছেন। এরই জেরে দেশে রাজনীতিকদের দায়িত্বও বেড়ে গেছে শতগুণ। কিন্তু সে দায়িত্ব তারা সততার সাথে পালন করতে পারছেন না।

এই প্রেক্ষাপটে বলতে হয় রাজনীতিকরা নিজেরা যদি দায়িত্বশীল আচরণ করতে এবং কথাবার্তা বলতে না পারেন, তবে আজকের পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ ও কথাবার্তা আশা করা দুরাশা মাত্র। রাজনীতিকরা যদি নীতিবিবর্জিত হন, তবে দেশের মানুষের কাছে নৈতিকতা আশা করা যায় না। রাজনীতিকরা যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হন তবে দেশের মানুষ সুশিক্ষিত হবে, তা কেমন করে ভাবা যায়? রাজনীতিকরা যদি চৌর্যবৃত্তি করেন, দেশের মানুষও সেটাই করবে। রাজনীতিকরা যদি স্বার্থপরের মতো আচরণ করেন ও কথাবার্তা বলেন, তবে দেশের মানুষ জনহিতে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবে সেটা কী করে হয়? রাজনীতিকরা যদি শান্তিপ্রিয় এবং পরমতসহিষ্ণু না হন, তবুও সমাজে শান্তি ও সহনশীলতা বিরাজ করবে, সেটিও ভাবা যায় না। রাজনীতিকরা যদি পরার্থে কাজ না করেন, জনগণ স্বার্থনিরপেক্ষ আদর্শবান হবে বলে আশা করা বৃথা। রাজনীতিকরা যদি ধর্ম-কর্মে নিষ্ঠাবান না হন, দেশের জনগণ ধর্ম-কর্মনিষ্ঠ হবে বলেও আশা করা যায় না। মোট কথা, রাজনীতিকরা যদি কথায় ও আচরণে সুশীল না হন তবে দেশের মানুষও তা হবে না এবং হচ্ছেও না।

বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত জনবহুল ছোট্ট রাষ্ট্র। এ দেশের মানুষ বিভিন্ন দলমতে বিভক্ত এবং তাদের মধ্যে দলমতের বিভিন্নতা ব্যাপক। এই বিভিন্ন দলমত দেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণে গড়ে উঠেছে বলে দাবি করা দুষ্কর। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, প্রধান দলগুলোর মধ্যে কোনো একটি দল অন্য একটি দল থেকে আদর্শগত দিক থেকে যতটা না আলাদা, তার চেয়ে স্বার্থগত স্লোগানের দিক থেকে বাহ্যত বেশি আলাদা। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো, ক্ষমতায় যাওয়া; সেটা যেভাবেই হোক। এদের প্রায় প্রত্যেকেই পশ্চিমা মুক্তবাজারভিত্তিক আদর্শে সমাজ বিনির্মাণে তৎপর। এটা করতে গিয়ে তারা প্রত্যেকেই ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। দেশের মানুষকে নৈতিকতাহীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলেন। এতে দুর্নীতি ও নৈতিকতাহীনতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এটা রোধ করতে দেশের ধর্মশিক্ষা বা প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং এ সব শিক্ষা যারা দিয়ে থাকেন, তারা অপারগ হয়ে পড়েছেন। অধিকন্তু, এ জাতীয় শিক্ষা যারা দেন তারাও দেশে প্রচলিত বিভিন্ন সাংঘর্ষিক দলমত দ্বারা প্রভাবিত। এ ক্ষেত্রেও স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এ থেকে দেখা দেয় দলীয় পক্ষপাতিত্ব যা এক প্রকারে দুর্নীতিরই নামান্তর। ফলে বাধে দলীয় স্বার্থের সংঘাত এবং এর থেকে জন্ম নেয় পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, যা পরিণামে হানাহানিতে রূপ নেয়। এতে করে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে, তা হয়ে পড়েছে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে বা গঠনে অকার্যকর। সব ব্যাপারই যেহেতু রাজনীতিকেন্দ্রিক, তাই এর দায় রাজনীতিকদের ওপরই বর্তায়। এ দায় তাদেরই নিতে হবে।

এ থেকে উদ্ভূত হচ্ছে প্রতিহিংসার রাজনীতি। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছেন না। হিংসাত্মক প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যেও। তারা এ দেশেরই মানুষ এবং তারা উঠে এসেছেন শ্রেণীবিভক্ত দেশীয় সমাজেরই বিভিন্ন স্তর থেকে। এতে করে তাদের দূষিত আচার আচরণ ও মনোভঙ্গি সমাজের অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়ে সার্বিক সমাজকে কলুষিত করে তুলছে। ফলে সমাজে হিংসা প্রতিহিংসা এবং এর থেকে সৃষ্ট প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবণতা হয়ে পড়ছে সর্বব্যাপী। কেউ কাউকে ক্ষমা এবং সহানুভূতির ও সহনশীলতার দৃষ্টিতে দেখতে শিখছেন না। ক্ষমা ও সহনশীলতাহীন সমাজে অরাজকতার বিস্তার ঘটা স্বাভাবিক; দেশে আজ সেটাই ঘটছে। প্রতিশোধ গ্রহণের ও একে অন্যকে দমিয়ে রাখার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। তাই সমাজে সুস্থিতির আশা দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। দেশে এর বীজ বপন করেছেন পরস্পর হানাহানি ও কোন্দলরত রাজনীতিকরাই। এই অস্থির ও অসহিষ্ণু সমাজের দায় রাজনীতিকদেরই নিতে হবে।

এই পরিস্থিতির জন্য অনেকে দেশে পাশ্চাত্য দেশীয় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে এর পরিপূর্ণ বিকাশই অপরিহার্য মনে করেন। তাদের মতে, এই ধারার গণতন্ত্রের অনেক দোষ থাকলেও এর বিকল্প নেই। এ ধারার গণতন্ত্র ‘সেকুলার’ বলে বহু জাতি-ধর্মের মানুষের নিবাস যে দেশে তারা এটা পছন্দ এবং উপযুক্ত মনে করেন। এ ধারার গণতন্ত্রের যে দোষটি মারাত্মক, তা হলো, এটা একটি জাতিকে সাংঘর্ষিক বহুধা দলমতে বিভক্ত করে ফেলে। ফলে দেশে বিভিন্ন দলে সঙ্ঘাত বিস্তার অনিবার্য হয়ে পড়ে। এটা নানা জাতি ও ধর্মের মধ্যকার কোন্দলেরই নামান্তর। এ গণতন্ত্র আর তখন ‘সেকুলার’ থাকে না। পশ্চিমা গণতন্ত্র নাগরিকদের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদে রাস্তায় এনে মানুষকে পণ্যের পর্যায়ে নামিয়ে সস্তা বানিয়ে ছাড়ে। পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্র সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা দূরীকরণে সহায়ক নয়, তা আজকের পাশ্চাত্য বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালেও বুঝা যায়। উপরন্তু, যে দুর্নীতি সমাজকে কলুষিত করে তোলে, তা দূর করতেও এ ধারার গণতন্ত্র কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। দেখা যায়, এ ধারার গণতন্ত্রের নৈতিকতাহীনতা, ব্যভিচার এবং সামাজিক ও ধনবৈষম্যের মতো দোষগুলো একটি দেশকে গিলে ফেলছে। তবুও কথা সত্য, পাশ্চাত্য দেশগুলো এই ধারার গণতন্ত্রই বিশ্বব্যাপী বিস্তারে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

এই পেক্ষাপটে যেটা জরুরি হলো এমন একটি শাসন ব্যবস্থা যা, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রভিত্তিক রাজনীতিকদের দলীয় আদর্শের বিপরীতে, এমন একটি সর্বজনীন আদর্শের বিস্তার ঘটাবে যা কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি দিয়ে প্রভাবিত হবে না। এমনকি, কোনো রাজনীতিকের ব্যক্তিগত ক্যারিশমাও দেশের আদর্শ বলে বিবেচিত হবে না। সে ধরনের গণতন্ত্রের উদাহরণ আমরা ইসলাম অনুসারী রাষ্ট্রেই দেখতে পাই। এখানে রাষ্ট্রের সংবিধান; মনুষ্য প্রণীত নয়; বরং বিশ্ব জগতের স্রষ্টা প্রণীত আল কুরআন। আল কুরআন মানুষের জীবনবিধান হিসেবে নাজিল হয়েছে; কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, বিশ্বের সব মানুষের জন্য। পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজে এবং আমাদের মতো দেশ ও সমাজে তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশ ও সমাজে যেসব সামাজিক অসঙ্গতি দেখা যায় তা বহু জাতি-ধর্ম অধ্যুষিত ইসলামী রাষ্ট্র মদিনাতে ছিল না বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ এর দলিল। সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু মদিনা রাষ্ট্রের আগে পৃথিবীতে কোনো কল্যাণ রাষ্ট্র ছিল না।

অপর দিকে, সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ রাষ্ট্রের মূল আদর্শ হিসেবে মার্কসীয়-লেনিনীয় আদর্শকে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশে এবং আমাদের দেশেও নানা দল উপদলের উদ্ভব ঘটেছে। এ আদর্শ প্রায় সত্তর বছর চালু থাকার পর সোভিয়েত রাশিয়াকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এর পতন ঘটিয়েছে। এ আদর্শের শেষ চিহ্ন কিউবাও তা থেকে সরে আসছে। চীন মূল ভূখণ্ডে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু রাখলেও এ আদর্শ পরিত্যাগ করে ধীরে ধীরে পুঁজিতান্ত্রিক বাজারব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এখন চীন হংকংয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন ও জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করছে। একদিন দেখা যাবে, চীনও পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সে গণতন্ত্রের স্বভাবজাত ত্র“টিগুলো আজকের পাশ্চাত্যের মতোই চীনকে আক্রমণ করবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাশ্চাত্য ধারার ‘সেকুলার’ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত হিন্দুত্ববাদের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি সুবিচার করতে না পেরে তাদের ওপর বৈষম্য ও অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছে।

এসব উদাহরণ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, কথিত ওসব ‘সেকুলার’ গণতান্ত্রিক ও ‘মার্কসীয়-লেনিনীয়’ ব্যবস্থা দেশ ও সমাজ থেকে দুর্নীতি, বৈষম্য, অবিচার, অনাচার, ব্যভিচার প্রভৃতি দূর করতে ব্যর্থ। তাই আশা করা যায়- সেদিন হয়তো দূরে নয়, যেদিন বিশ্ববাসী স্বীকার করবে ইসলামী ব্যবস্থাই সর্বোত্তম এবং তারা তা গ্রহণ করবে। এটা পিছু ফেরা নয়; বরং সত্যকে গ্রহণ করা। একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে সমাজের অসঙ্গতি ও সমস্যাগুলোর সমাধান আমরা অচিরেই করতে পারি বলে মনে হয়। এর অন্যথা হলে সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী রাজনীতিকরা দেশের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলোকে আরো ঘনীভূত করা বৈ কোনো সমাধান দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমাদের বুঝতে হবে, মুসলিম অধ্যুষিত এবং বহু জাতি ও ধর্মের মানুষের নিবাস এই দেশটিতে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ আমাদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর থেকে নিস্তার পেতে বহু জাতি-ধর্মের মানুষের নিবাস এই বাংলাদেশে ‘মদিনা সনদ’-এর ভিত্তিতে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ব্যতীত আর কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। বুঝতে হবে- ধর্মকে যতই আমরা তাড়িয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চাই, ধর্ম ততই আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেবে।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল, কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement