১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নতুন সড়ক পরিবহন আইন

-

নতুন সড়ক পরিবহন আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সেখানে গুরুত্ব পায়নি। একটি হচ্ছেÑ যানবাহনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার। আমি যখন এ লেখা শুরু করেছি, তখন টেলিভিশনে স্ক্রলে ভেসে উঠল ‘কুমিল্লায় মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে (যদিও দুর্ঘটনাকবলিত হওয়ার ফলে) তিনজন নিহত। আমাদের স্মরণে আছে, শোকাবহ ২১ ফেব্রুয়ারির প্রারম্ভে পুরান ঢাকার (চকবাজার) চুড়িহাট্টায় যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

সাম্প্রতিক সময়ে আরো একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা আমরা দেখেছি। গত ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি ফিরছিলেন পরিবারের ছয় সদস্য। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আনোয়ারা উপজেলার চাতরি বাজার এলাকায় পৌঁছালে বিকট শব্দে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ঘটনাস্থলে তিনজন নিহত হয় এবং আরো তিনজন গুরুতর আহত হয়। এ ব্যাপারে ইনট্রাকো সিএনজি লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দীনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, কিছু স্বার্থান্বেষী পরিবহন মালিক গ্যাস সিলিন্ডার টেস্ট না করে পাঁচ বা আট বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করার ফলে দেশবাসীকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে শুধু মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া বা পুনরায় টেস্ট না করানো নয়, তার পাশাপাশি খানাখন্দকে ভরা রাস্তা, অসম উচ্চতার স্পিড ব্রেকারও দায়ী। কেন না মসৃণ রাস্তা না হলে সিলিন্ডারের উপর যে চাপ বা প্রভাব পড়ে তাতে বিস্ফোরণের মতো মারাত্মক দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি এবং বেহাল অবস্থার সড়কগুলো নিয়মিত পরিচর্যার আওতায় আনলে উপরি উক্ত বিপদ থেকে দেশের মানুষ রক্ষা পেতে পারে।

দ্বিতীয় পয়েন্টটি হচ্ছে- গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন। অতর্কিতে বিকট হর্নের শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি কেড়ে নিতে পারে। এমনকি অজ্ঞান করে দিতে পারে। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণসীমা ৪৫ ডেসিবল পর্যন্ত। তার অতিরিক্ত শব্দ হলে মানব দেহে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে মস্তিষ্কের রোগ, কাজ করার সক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্রোধ বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, দুর্বলতা এবং হার্টের সমস্যা অন্যতম।

হাইকোর্ট থেকে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জরিমানার বিধানও আছে। তবুও অব্যাহতভাবে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট শব্দদূষণ বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জীবনে অন্ধকার নেমে আশার শঙ্কা বহুলাংশে বেড়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জরিমানার পরিমাণ কম হওয়ায় শব্দদূষণকারীরা বেপরোয়া। এ ব্যাপারে রাস্তায় চলাচলকারীদের হতে হবে অনেক বেশি সচেতন। যাতে হর্ন বাজিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়ার জন্য বলতে না হয়। এমনি পরিস্থিতিতে শব্দদূষণ তথা গাড়ির হর্নের শব্দ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন ও আইনের প্রয়োগ তরান্বিত করা খুবই জরুরি।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে গাড়ির হর্ন বাজানোকেও একটি জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে যাতে খুব প্রয়োজন না হলে হর্ন বাজানো না হয়। তাই সেখানে হর্নের শব্দ শোনা যায় কদাচিৎ। আমাদের দেশে হরহামেশা দেখা যায় গাড়ি সিগন্যালে, যানজটে কিংবা ধীরে চলা গাড়ির পেছনে পড়লে পাল্লা দিয়ে হর্ন বাজানো শুরু হয়। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ কিংবা তারো বেশি গাড়িচালকদের শব্দদূষণ সম্পর্কে জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না।

সড়ক পরিবহন আইন যা আগে ছিল এবং বর্তমানে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো আইনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারতম্য দেখা যাচ্ছে। যেমন রেজিস্ট্র্রেশনবিহীন এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংশ্লিষ্টতা সরাসরি মালিক পক্ষের সাথে। দু’টি ক্ষেত্রে পুরনো আইনে যেখানে জরিমানার পরিমাণ ছিল দুই হাজার টাকা, সেখানে নতুন আইন মোতাবেক রেজিস্ট্র্রেশনবিহীন গাড়িতে ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা এবং ফিটনেসবিহীন গাড়িতে ১২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। একইভাবে ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে ৫০০ টাকার জরিমানা ২০০ থেকে এক হাজার ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে করা হয়েছে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা। বিজ্ঞজনদের অভিমত হচ্ছে, ফিটনেসবিহীন গাড়ির সাথে জনজীবনের শতভাগ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বে¡ও সেখানে মাত্র ২৫ হাজার টাকা কোন যৌক্তিক মানদণ্ডে নির্ধারণ করা হলো। একজন গাড়িচালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা দেয়ার সামর্থ্য থাকলে তার জীবিকার ব্যবস্থা নিজেই করত।

নতুন সড়ক পরিবহন আইনে অবৈধ পার্কিং এবং হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালালে পাঁচ হাজার এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক জরিমানা আদায়। তবে এর সাথে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে দেশবাসীর মনে। সেটি হচ্ছে- রাস্তা পারাপারের সুবন্দোবস্ত করা। বর্তমানে দেশ আধুনিক প্রযুক্তির দিকে এগোলেও এক সময়কার জনপ্রিয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ জেব্রা ক্রসিং অনেকাংশে হারিয়ে গেছে। যেমনি হারিয়ে গেছে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থামানোর পদ্ধতি। মাঝে মধ্যে জেব্রা ক্রসিংয়ের পরিবর্তে ফুটওভারব্রিজ দেখা যায়। কিন্তু প্রবীণ বা বয়স্ক মা-বাবা, শিশু-কিশোর, অনেক তরুণ যাদের কোমর ব্যথা, হাঁটু ব্যথা আছে এমনি অনেকে ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করতে পারেন না। হবু মা ও শ্বাসকষ্টের কারণে বহু লোকের পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠাও সম্ভব হয় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জেব্রা ক্রসিং একটি প্রয়োজনীয় বিষয়।

জেব্রা ক্রসিং পারাপারের সময় ইঙ্গিত হিসেবে ক্রসিংয়ের দুই পাশে দু’টি খুঁটিতে হাঁটার চিহ্ন এবং বিশেষ ধরনের শব্দের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে বধির এবং সাদা ছড়িওয়ালা অনায়াসে রাস্তা পার হতে পারেন। তবে এ ব্যাপারেও চালকদের প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। উল্লিখিত বিষয়ে সুপরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা শতভাগ বাস্তবায়ন করা যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও তদসংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব। শোনা যায়, মন্ত্রী হিসেবে বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী সফল। কিন্তু সড়কে মৃত্যুর হানা এবং পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য কিছুতেই সফলতার লক্ষণ নয়।

সত্যিকারভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে সড়ক থাকত নিরাপদ। গাড়ি এবং গাড়িচালকের কাগজপত্র নিয়মিত পরীক্ষা করে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা রাখার দায়িত্ব সরকারি বাহিনীর। জনগণের জানমালের হেফাজত করাই এ বাহিনীর শপথ। অত্যন্ত খারাপ নজির হলেও এ কথা সত্য যে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সৎ, সাহসী ও সংযমি হলে টাকার বিনিময়ে পার পেয়ে যাওয়ার যে মানসিকতা দুষ্টচত্রের মাঝে বিরাজমান, তার অবসান হতো এবং আইন মেনে চলতেই হবে এমন মানসিকতা জন্ম নিত।

পাশাপাশি আরো একটি বিষয় গুরুত্ব বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক- যা নিরাপদ সড়ক ও সাধারণ যাত্রীদের স্বস্তি দিতে পারে, তা হচ্ছেÑ সুদক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন (ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণী) চালক। উদাহরণস্বরূপ পাঠাও, উবার চালকদের অনেকেই শিক্ষিত কিংবা মোটামুটি স্তরের শিক্ষিত এবং বিদেশ ফেরত তরুণ। যাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আবার গাড়ির মালিকও। তাদের মার্জিত ব্যবহার আর গাড়ি চালনায় সতর্কতাই বলে দেয় কিছুটা হলেও শিক্ষাদীক্ষা তারা নিয়েছে।

সর্বশেষ এআরআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- চালকের বেপরোয়া মনোভাব এবং অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোই ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। অর্থাৎ মূল কারণ শনাক্ত হয়েছে। এখন দরকার আইনের বাস্তবায়ন।
E-mail : sayedzulkarnain@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
কিমিচের একমাত্র গোলে আর্সেনালকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে বায়ার্ন বিরোধী দলকে ভাঙতে ষড়যন্ত্র করছে সরকার : ড. মঈন খান মোস্তাফিজের বিকল্প ভাবছে চেন্নাই, দলে ভিড়িয়েছে এক ইংলিশ পেসার বিদেশ যাওয়া হলো না আশরাফুলের, বাসচাপায় মামাসহ নিহত ‘সন্ত্রাসীদের ঘরে ঢুকে মারা’ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া মাতৃভূমি রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য : সেনাপ্রধান ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সাথে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ১ হাজার টাকার জন্য পেশাদার ছিনতাইকারীরা খুন করে ভ্যানচালক হারুনকে দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় : মতিউর রহমান আকন্দ টানা ১১ জয়ে ডিপিএলের প্রথম পর্ব শেষ করলো আবাহনী দেশে করোনায় আরো একজনের মৃত্যু

সকল