২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আবরার ফাহাদ হত্যা ও অপরাজনীতি

-

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হলো। যারা এতে জড়িত তারাও মেধাবী। আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে আবরারসহ ২০ জন মেধাবী ছাত্রের জীবন নষ্ট হয়ে গেল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল- আবরারকে মারধর করে শিবির বা জঙ্গি বলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। পুলিশ জঙ্গি ধারায় মামলা করে আহত অবস্থায় তাকে জেলহাজতে পাঠাত। আমরা জনগণ পত্র-পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে জানতে পারতাম, আবরার নামে একজন ‘জঙ্গি’কে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে গ্রেফতার করেছে। এই গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে পুরস্কৃত করা হতো। এই হত্যাকারীরা জন্মগতভাবে বাবা-মায়ের কাছে থাকা অবস্থায় কিংবা বুয়েটে ভর্তি হওয়ার আগে সন্ত্রাসী ছিল না। অর্থের লোভেও হয়নি। এই ছেলেগুলো ছাত্র পড়িয়ে বা কোচিংয় করিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারত। তবে কেন সন্ত্রাসী বা হত্যাকারী হলো?

এই প্রশ্ন হত্যাকারীদের বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের। তারা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারা মনে করেছিলেন, এটা ষড়যন্ত্র। টিভিতে ভিডিওফুটেজ দেখে হত্যাকারীদের বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা অবাক। বাবা-মায়েরা মনে করেছিলেন, তাদের ছেলেরা ভালো ছাত্র, ভালো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তাদের অভাব দূর করবে। পাড়া প্রতিবেশীরা মনে করেছিলেন, এদের কারণে এলাকার ও দেশের মানসম্মান বৃদ্ধি পাবে। কেন তারা সন্ত্রাসী ও হত্যাকারী হলো? বর্তমানে কেউ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে না কোনো কিছুর মাধ্যমে। প্রকাশ করলে প্রসাশন ও এক শ্রেণীর নেতার কাছে তিনি হয়ে যান ‘শিবির, জামায়াত বা জঙ্গি’। আবরারের ক্ষেত্রে তাই হতো যদি সে গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে থাকত। তখন তাকে শিবির বা জঙ্গি হয়ে কারাগারে থাকতে হতো। আবরারের ছোট ভাই ঢাকা কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আমরা জনগণ পত্র-পত্রিকায় দেখে হয়তো প্রশাসনের কথা বিশ্বাস করতে হতো। দেখতে যেতাম না আবরার ফেসবুকে কী লিখেছে? তখন গণমাধ্যমে আজকের মতো ভূমিকা পালন করত না। আবরাব ফেসবুকে দেশের স্বার্থের ফেনী নদীর পানি চুক্তির পর লিখিছে- ফেসবুকে অনেক বিষয়ের ওপর লিখেছিল যা তার মৃত্যুর পর টিভির মাধ্যমে জানতে পারি। সব কিছু প্রকাশ পেলেও পর্দার অন্তরালে থাকা ব্যক্তিদের রক্ষার জন্য সরকারি দলের লোকজন এমন কি খোদ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা সব দায়দায়িত্ব ঘাতক মেধাবী ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দিলে পর্দার অন্তরালে থাকা ব্যক্তিদের রক্ষা করা হবে।

আবরার হত্যার পর থেকে টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে টকশোতে আলোচনায় বলা হয়- বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপছাত্ররাজনীতি ও অপরাজনীতি শুরু হয়েছে। ওই সময় থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকমণ্ডলী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এ কথাগুলো কি সত্য? আলোচকেরা ভুলে গেছেন, রেসকোর্স ও পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কী ঘটেছিল। কাদের কারণে ছাত্রলীগ দুই ভাগ হলো। কাদের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই স্থানের কোনো স্থানের সম্মেলন উদ্বোধন করার কথা না থাকলেও হঠাৎ ঠিক সময় রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে ‘মুজিববাদী’দের সম্মেলন উদ্বোধন করলেন। ওইদিন কাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে মিছিল সহকারে পল্টনে সম্মেলনের স্থানে আক্রমণ করে প্রধান অতিথিসহ আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজসহ গণ্যমান্য অতিথিদের ছাত্রলীগ কর্মীরা আঘাত করে। আহত প্রধান অতিথিসহ ৫০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলেন। পুলিশ সে সময় কোনো মামলা নেয়নি কেন? তখনো জাসদ গঠন হয়নি, সেহেতু এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও ছাত্রলীগার। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়- বঙ্গবন্ধুসহ কোনো মন্ত্রী বা নেতা ওই আহতদের দেখতে যাননি। কারা ডাকসুর ব্যালটবাক্স হাইজ্যাক করেছিল ১৯৭৩ সালে? এই হাইজ্যাকের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের মধ্যে একজন বর্তমানে জাতীয় পাটির সংসদ সদস্য।

’৭৪ সালে ঢাবি মহসিন হলে ‘মুজিববাদী’ ছাত্রলীগের সাতজন ছাত্রনেতাকে একই দল থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ’৭২-৭৫ সালে জেলায়, মহুকুমায় ও বেশির ভাগ থানা শহরে শাসক দলের নেতৃত্বে টর্চার সেল তৈরি হয়েছিল কেন? প্রগতিশীল ছাত্র-ব্যক্তিত্বদের সেখানে ধরে নিয়ে এসে অত্যাচার করে আহত বা হত্যা করা হতো। ভোট চাইতে গিয়ে লাশ হতে হয়েছিল। ভোটকেন্দ্র দখলের রাজনীতি ওই সময় শুরু। খন্দকার মোশতাককে জেতানোর জন্য দাউদকান্দির ভোটকেন্দ্র থেকে ব্যালটবাক্স হেলিকপ্টারে নিয়ে এসে ঢাকায় মোশতাককে ‘বিজয়ী’ ঘোষণা করা হয়েছিল কেন? ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের কারসাজিতে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। ওই দুর্ভিক্ষে কত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল? ’৭৩-এর শুরুতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায় তোপখানা রোডে। সে গুলিতে দুইজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ১৯৭২ সালে যুবলীগ গঠন করা হলে পাক আমলের কুখ্যাত এনএসএফের নেতাকর্মীসহ (পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার অনেকে) অনেকে যুবলীগ ঢুকে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের ওপর নির্যাতন করেছিল। কাদের কারণে স্বাধীন হওয়ার পর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে লোভী, লুটেরা, সুবিধাভোগী, লেজুড়বৃত্তিকারীরা বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করে রেখেছিল?

অপছাত্ররাজনীতি ও অপরাজনীতি চলছে অতীত থেকে। এ বিষয়ে সময়ের সাথে সাথে কৌশল, প্রয়োগ-পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে মাত্র। ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত অপছাত্ররাজনীতি ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করতে পারত। এখন এটা কেউ করতে পারে না বা সাহস করে না। টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে আমরা দেখতে পারছি, আবরার হত্যা নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল মিছিল করতে গেলে ছাত্রলীগের ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে কিভাবে তাড়া করল। গত ২০ অক্টোবর ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে বসে থাকা ছাত্রদলের নেতাদের ওপর আক্রমণ করে ১৫-১৬ জনকে আহত করল। প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিষদবর্গ কি টেলিভিশন দেখেন না? অপছাত্ররাজনীতি ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে আদর্শিকভাবে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন ও লড়াই করার মতো সাহস বর্তমানে ছাত্র ও যুবসমাজের নেই। সরকার সবসময় উন্নয়নের ও শান্তির কথা বলে, গুম, জেলের ভয় দেখিয়ে প্রকৃত সংগ্রাম থেকে বিরতে রাখার চেষ্টা করছে। বিশেষত, ১৯৯০ সাল থেকে শিক্ষক, ডাক্তার ও অন্যান্য পেশাজীবীদের সরকারি রাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তি করতে দেখা যাচ্ছে। সবাই বিদেশে ভ্রমণ করতে চায়, ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়, অর্থ ও সম্পদের মালিক হতে চায়। সে কারণে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, ক্ষমতালোভী বুদ্ধিজীবীরা নতজানু হয়ে তারা সরকারের লেজুড়বৃত্তি করতে থাকে। তারা সরকারের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ও কর্মীদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। এ কারণে ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে উৎকোচের প্রস্তাব দিতে সাহস পায়।

আমরা এসবের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে, দেশ স্বাধীন করিনি। যুদ্ধের সময় জনগণ ও আমরা যে দেশ চেয়েছিলাম, সেই দেশ আনতে পারিনি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, বহলবাড়ীয়া, মিরপুর, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement