২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও নেতানিয়াহুর ক্ষমতার মোহ

-

ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ইসরাইলের সামরিক আগ্রাসন নতুন করে আবার শুরু হয়েছে। পশ্চিমাদের মদদে প্রতিষ্ঠিত এই দখলদার রাষ্ট্রটি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর অব্যাহত বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিনের বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ ৩৪ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।

গত ১২ নভেম্বর ইসরাইল বিমান হামলা চালিয়ে ইসলামী জিহাদের কমান্ডার বাহা আবু আল আতা এবং তার স্ত্রী আসমাকে হত্যা করে। ইসরাইলি যুদ্ধবিমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থানরত ইসলামী জিহাদি সদস্য আকরাম আল আজুরিকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে তাকে এবং তার ছেলেকেও হত্যা করে। এই টার্গেট কিলিংয়ে আরো ১০ জন আহত হয়। ইসরাইলি গণমাধ্যম জানায়, গাজা সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে ইসরাইল। এই সেনা ইউনিটে রয়েছে আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ইউনিট, সামরিক গোয়েন্দা এবং হোমফ্রন্ট কমান্ডের সদস্যরা। বিশ্লেষকদের অভিমত হচ্ছে, ইসরাইলের হোমফ্রন্ট কমান্ডের সেনাদের সাধারণত দেশের গুরুতর সঙ্কট ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু আকস্মিকভাবে ইসরাইল গাজায় এই আগ্রাসন শুরু করার কারণ কী?

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইসরাইলে বর্তমানে সরকার গঠনে যে অচলাবস্থা বিশেষত নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় টিকে থাকার অনিশ্চয়তার কারণে নতুন করে সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। জানা গেছে, নেতানিয়াহুর এক সময়ের উপদেষ্টা শ্লোমো ফিলবার প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রাষ্ট্রীয় সাক্ষী হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, তাকে হয়রানি করতে সহযোগীকে নির্দেশ দিয়েছেন নেতানিয়াহু। অন্য দিকে আরব জোটের সমর্থন পাওয়া যেকোনো সরকারকে অবৈধ প্রমাণিত করতে নেতানিয়াহু আদাজল খেয়ে নেমেছেন।

নেতানিয়াহু বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার কাছে রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার চেয়েও বেশি। তিনি নিজেকে ইসরাইল রাষ্ট্র ও ইহুদি জনগণের সুরক্ষায় নিয়োজিত ইতিহাসের নির্বাচিত দূত বলে মনে করেন। নেতানিয়াহুর অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। দায়িত্ব হারালে তাকে যে কেবল বিচারের মুখোমুখি হতে হবে তা নয়, তিনি জানেন বিচারের মাধ্যমে হয়তো কারাগারেও যেতে হতে পারে।

উল্লেখ্য, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়। গত এপ্রিল ও সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত দু’টি নির্বাচনে দেখা গেছে, ভোটাররা নেতানিয়াহুর ওপর থেকে আস্থা ও বিশ্বাস হারাচ্ছে। নেসেটের ৬৫ আসনের বেশির ভাগ জনসাধারণ তাকে আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাচ্ছে না। তার জন্য আরো খারাপ খবর হলো, তিনি সরকার গঠন করতে না পারলেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী বেনিগান্টজ জয়েন্ট লিস্টের সমর্থনে আরবদের সাথে সংখ্যালঘু সরকার গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গাজায় নতুন করে ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। কেবল তুরস্ক অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে। দেশটি ইসরাইলকে তার রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বন্ধ করার এবং দখলদারিত্বের রাষ্ট্রনীতির অবসান ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছে। গাজায় দুই দিন অব্যাহত ইসরাইলি হামলার পর উভয় পক্ষ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়েছে। মিসরের মধ্যস্থতায় ইসরাইল সামরিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়ার পর গাজা থেকে ইসলামিক জিহাদ রকেট নিক্ষেপ বন্ধ করেছে বলে জানিয়েছে। মিসর, জাতিসঙ্ঘ ও ইসলামী জিহাদ সূত্রে এ খবর জানা গেলেও ইসরাইল অস্ত্রবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। মিসরের মধ্যস্থতায় গাজার অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলেও দুই দিন পর আবারো হামলা শুরু করে ইসরাইল।

ইসরাইলের দাবি, অস্ত্রবিরতি চলাকালে হামাসের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক দফা রকেট হামলা চালানো হয়। জানা যায়, ইসরাইলি হামলায় ইসলামী জিহাদের একজন নেতা ও তার স্ত্রী নিহত হওয়ার পরই গাজা থেকে ইসলামী জিহাদ রকেট হামলা শুরু করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের রকেট হামলায় কেউ হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ইসরাইল জানিয়েছে, প্রথমে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা রকেট ছোড়া বন্ধ করলে তারাও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ করবে। জাতিসঙ্ঘের মধ্যপ্রাচ্য শান্তিবিষয়ক দূত নিকোলাই ম্লাদেনভ বলেন, জাতিসঙ্ঘ ও মিসর উভয় পক্ষই গাজাকে ঘিরে বিপজ্জনক পরিস্থিতি ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়েছে। তিনি এক টুইট বার্তায় উভয় পক্ষকে ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান জানান। ইসরাইল বেসামরিক অবকাঠামোতে বোমা হামলা চালিয়ে বেসামরিক লোকদের হত্যা এবং তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিচ্ছে।

খুবই হতাশাজনক বিষয় হলো, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ সমন্বয়কারী নিকোলাই ম্লাদেনভ চলমান সঙ্ঘাতের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ ও যুদ্ধবিরতির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বলে জানালেও তার বক্তব্যে দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর পক্ষে নির্লজ্জ ওকালতির বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেছেন, জনসংখ্যার কেন্দ্রস্থলে বেপরোয়াভাবে রকেট ও মর্টার নিক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই এটি বন্ধ করতে হবে। তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন, ‘বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।’ তার এই বক্তব্যে তিনি ইসরাইলি বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা চালানোর বিরুদ্ধেই বলেছেন।

অথচ ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়ে সেখানে ৩৪ বেসামরিক লোককে হত্যা ও শতাধিক লোককে মারাত্মকভাবে আহত করার বিরুদ্ধে তিনি টু-শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একইভাবে ইসরাইলে রকেট হামলা চালানোর নিন্দা করেছে। পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলোতেও গাজা হামলার ব্যাপারে একপেশে ও বিভ্রান্তিমূলক খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। ফরাসি পত্রিকা লা মন্ডে ইসরাইলি লাইনেই সংবাদ পরিবেশন করে যচ্ছে। দুঃখজনক খবর হলো, গাজায় ইসরাইলি হামলায় বহু ফিলিস্তিনি হতাহত হলেও ফরাসি পত্রিকায় তা স্থান পায়নি।

নেতানিয়াহু তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে এবং গাজায় হামলা চালিয়ে তার দুর্নীতি ও সরকার গঠনের ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে তার নেতৃত্বের অপরিহার্যতা প্রমাণ করার জন্যই নেতানিয়াহু এখন বেপরোয়া। ইসরাইলি জনগণ নির্বাচনে তাকে প্রত্যাখ্যান করার পর তার ছলচাতুরী ও ধূর্ততার কাছে কি আত্মসমর্পণ করবে, নাকি তারা নেতানিয়াহুর অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে?


আরো সংবাদ



premium cement