তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার ইতিকথা
- অধ্যাপক মো: মসিউল আযম
- ২০ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:২৫
বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে দেশবাসী তথা যশোরবাসীর কাছে এটা বিশেষ স্মরণীয় দিন। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক তুমুল ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল চৌগাছা সীমান্তের জগনাথপুর গ্রামের মাঠে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটে। দেশে প্রথম শত্রুমুক্ত হলো যশোর জেলার চৌগাছা। তাই এই দিনটি জাতির ইতিহাসে বড় গৌরবের দিন। স্বাধীনতার পর এই গ্রামের নামকরণ করা হয় মুক্তিনগর।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামেরই ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে আলতাফ হোসেন শহীদ হন এই জগন্নাথপুরের যুদ্ধে।
শহীদ আলতাফ হোসেন সরদার ১৯৫২ সালের ১৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ও মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। বড় ভাই আমীর হামজা (৭২) এই শহীদ পরিবারের হাল ধরেছেন। শহীদ আলতাফ চুড়ামনকাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরে হাইস্কুল থেকে ১৯৬৯ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশের পর ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হন। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে যান এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে উচ্চ প্রশিক্ষণ নেন বিহারের চাকুলিয়া সেনানিবাস ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। স্কুল জীবনে আলতাফ ছিলেন কৃতী ফুটবল খেলোয়াড়। হা-ডু-ডু খেলাতেও তার জুড়ি ছিল না। একটি মজার গল্প শোনান বড় ভাই আমীর হামজা। বাড়ির পাশেই চুড়ামনকাটি হাইস্কুলের বিরাট খেলার মাঠ।
মাঠে ছেলেরা খেলায় মশগুল। এই সময় পার্শ্ববর্তী সেনানিবাস থেকে কয়েকজন পাঞ্জাবি কুস্তিগীর সেনা মাঠে মহড়া দিতে আসে। এদের একজন বাঙালি ছেলেদের প্রস্তাব দেয় তার সাথে কুস্তি লড়তে। তার বিশাল চেহারা দেখে ভয়ে কেউ রাজি হয়নি। কিন্তু আলতাফ লড়তে চাইলেন। বড় ভাই তাকে নিষেধ করলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। তাদের কুস্তি খেলা দেখতে দর্শকদের ভিড় জমে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে পাঞ্জাবি সেই কুস্তিগীরের পা উঁচুতে উঠিয়ে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন তিনি। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। ঘটনাটি তখন এলাকায় লোক মুখে রাষ্ট্র হয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল। হানাদাররা তাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। বাবা রজবালী সরদার একটি গাছি দা নিয়ে ছুটে যান প্রতিহত করতে। অবস্থা বেগতিক দেখে দৌড়ে পালিয়ে তিনি বাড়ির পাশে গোরস্থানে কবরের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন। হানাদাররা কবরখানা তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে সন্ধান পেয়ে তাকে সেই কবরের মাঝেই ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। শহীদ আলতাফ ছিলেন ১২ জন যোদ্ধার কমান্ডার। তার আরো বীরত্বের কাহিনী শোনান সহযোদ্ধা মহিউদ্দিন সরদার।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন (৬২) ১৯৭১ সালে ঢাকায় ভাই হাফিজ উদ্দীনের বাসায় থেকে ওয়েস্টা অ্যান্ড স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়তেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বড় সন্তান মাসুদুল আলম বিসিএস ক্যাডার (প্রশাসন)। বর্তমানে তিনি মেহেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে যুব শিবিরে প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে সীমান্তের বয়রা ক্যাম্পে ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হুদা ও মেজর আবুল মঞ্জুরের কাছ থেকে অস্ত্র গ্রহণ করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে আলতাফ ও মহিউদ্দিন দেশের অভ্যন্তরে অভিযানে অংশ নেন। এর মধ্যে মথুরাপুর বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস ও মেহেরুল্লানগর রেলস্টেশনে অগ্নিসংযোগ উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন অভিযান শেষে আলতাফ ও মহিউদ্দিন দু’জনই আলতাফের খালার বাড়ি জগন্নাথপুর গ্রামে রাত্রি যাপন করছিলেন।
মিত্র বাহিনীর ৩০০ জনের একটি কোম্পানি সীমান্ত অতিক্রম করে জগন্নাথপুরে এসে জানতে পারে, গ্রামে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে। ক্যাপ্টেন তাদের কাছে প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চান। দু’জনের একপর্যায়ে আদেশ দেন বেলচা দিয়ে পরিখা খননের জন্য। মাত্র ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে তারা ২টি পরিখা খনন করে ফেলেন। এতে ক্যাপ্টেন খুশি হয়ে আলতাফকে একটি এসএলআর এবং মহিউদ্দিনকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল প্রদান করেন।
২১ নভেম্বর সকাল ৭টা। ক্যাপ্টেন বাইনাকুলার দিয়ে দূরে দেখতে পান পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি ট্যাংকের পাশে বসে নাশতা করছে। তিনি ও মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চান, সব পরিখা খনন সমাপ্ত হয়েছে কি না। মহিউদ্দিনের হাতে একটি রকেট লাঞ্চারসহ থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল কাঁধে। সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই শত্রুদের ট্যাংকে আঘাত করার ফলে ট্যাংকের চেইন বিচ্ছিন্ন হয়ে সেটি অচল হয়ে পড়ে। ওই মুহূর্তে অগণিত মর্টারের শেল এসে যুদ্ধের ময়দানে চার দিকে পড়তে থাকে।
বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট যুদ্ধরত অবস্থায় হঠাৎ একটি মর্টারের শেল এসে আলতাফের ঘাড়ে আঘাত হানে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেখানেই শহীদ হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা! আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন সরদার (৬৭), তাকে বলা হতো ছোট আলতাফ। শহীদ আলতাফ ছিলেন দীর্ঘদেহী ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা মানুষ। শৈশবকালে সরদার গোষ্ঠীর এই দুই ছেলেকে এলাকার সবাই বলাবলি করতেন এরা দু’জন মানিকজোড়। একসাথে খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়া, গোসল করা, সিনেমাও দেখতেন। দশম শ্রেণী পর্যন্ত একই স্কুলে সহপাঠী ছিলেন। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর গল্প করেই রাত ভোর হয়ে গেছে তাদের। দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে একই সাথে ভারতে গিয়ে টালিখোলা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প হতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। পরে বিহারের চাকুলিয়া থেকে উচ্চ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ওই সময়ে তাদের গ্রামের আরো ২৩-২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণে ছিলেন।
প্রশিক্ষণকালীন সময়ে কমান্ডার সবার বিনোদনের জন্য একদিন প্রীতি ফুটবল খেলার আয়োজন করেন। সীমান্তের এপার থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দল বনাম ছাতিয়ানতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল। ছাতিয়ানতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল ৩-১ গোলে বিজয় অর্জন করে। ওই খেলায় শহীদ আলতাফ ২ গোল ও মহিউদ্দিন ১ গোল করেন। আমৃত্যু দুই আলতাফের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। আলতাফ শহীদ হওয়ার পর অপর বন্ধু ছোট আলতাফ খুবই কান্নাকাটি করেন। যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর জগন্নাথপুর গ্রামে লাশ মাটিচাপা দিয়ে সেখানে একটি চিহ্ন রাখা হয়। যুদ্ধের সময় তার গায়ে ছিল খয়েরি রঙের সোয়েটার। এটা হয়েছিল তার দাফনের কাপড়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাস পর শহীদ আলতাফের হাড়গোড় এনে পুনঃ দাফনের ব্যবস্থা করেন। তারই সহযোদ্ধা বন্ধু আলতাফ একটি বস্তায় ভরে তা বয়ে আনেন। ছাতিয়ানতলা চুড়ামনকাটি স্কুলের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এই মাজার নির্মাণে ইট, সিমেন্ট ও রাজমিস্ত্রির খরচ তিনি নিজে বহন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বন্ধুত্বের প্রতি এই সম্মান, ভালোবাসা, দরদ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার পর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্যোগ নেন। কলেজের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে আলতাফের জীবন আত্মোৎসর্গ করায় ম্যাগাজিনে তার একটি ছবির প্রয়োজন পড়ে। কলেজ কর্তৃপক্ষ শহীদের আত্মার স্মৃতির প্রতি এটি উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ লিপিটি রচনা করেন কামরুজ্জমান আজাদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কারোর করুণা বা দয়ার দান নয়। শহীদ আলতাফের মতো নাম না জানা লাখো শহীদের এক সাগর রক্ত ও স্বজনহারা মা-বোনদের অশ্রু ও ইজ্জতের বিনিময়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বহু কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা তাই আমাদের অমূল্য সম্পদ।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা