শিক্ষক পেটানোর ‘বিদ্যাচর্চা’
- মো: তোফাজ্জল বিন আমীন
- ১১ নভেম্বর ২০১৯, ২০:১১
শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়। কারণ, তারা জাতির আগামী দিনের কর্ণধার মানুষ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষকদের সম্মান দেখাতে বেয়াদব ছেলেটাও আদর্শ ধরে রাখতে শিক্ষকের সামনে কাঁচুমাচু করে উঠে দাঁড়ায়, সেখানে কিভাবে পিতৃতুল্য শিক্ষককে ছাত্রলীগের কর্মীরা পুকুরে ফেলে দেয় তা বোধগম্য নয়! ছাত্রলীগের অপকর্মে ছাত্র রাজনীতির সোনালি অতীত আজ প্রশ্নবিদ্ধ। কবি কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার কথাটি প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে গেল। কবিতার বিষয়বস্তু ছিল এ রূপ- দিল্লির এক মৌলভী (শিক্ষক) বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়াতেন। একদিন ভোরের বাদশাহ লক্ষ করলেন, তার পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছেন আর শিক্ষক তার পা নিজেই পরিষ্কার করছেন। এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর বাদশাহ আলমগীর দূত মারফত ওই শিক্ষককে কাছে ডেকে নিয়ে আসেন। তারপর বাদশাহ ওই শিক্ষককে বলেন- আমার পুত্র আপনার কাছ থেকে তো সৌজন্য না শিখে উল্টো বেয়াদবি আর গুরুজনের প্রতি অবহেলা শিখছে। ব্যাপারটি কী বলুন তো? কারণ সেদিন দেখলাম, আমার পুত্র শুধু আপনার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর আপনি নিজেই আপনার পা পরিষ্কার করেছিলেন। আমার পুত্র কেন আপনার পায়ে পানি ঢালার পাশাপাশি পা ধুয়ে দিলো না- এ কথা মনে হলেই আমি ব্যথা অনুভব করি। বাদশাহ আগমগীরের মুখ থেকে এ কথা শোনার পর ওই শিক্ষক উচ্ছ্বাসের সাথে বলে উঠলেন- আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির; সত্যিই তুমি মহান, উদার, বাদশাহ আলমগীর।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক পরিবর্তন এনে থাকে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, সেখানে শিক্ষকের ওপর একের পর এক হামলা আর লাঞ্ছনার বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পৃথিবীতে যারা বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তারা সবাই মাতাপিতার প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলেই তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে আজো লেখা আছে (যেমন- ইবনে সিনা, ইমাম আবু হানিফা রহ:, ওমর খৈয়াম, ইমাম আল-গাজ্জালি, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, জামালউদ্দিন আফগানি প্রমুখ। আমরা যখন উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর তখন সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা হত্যা, খুন ধর্ষণ, চাঁদাবাজির মহা উৎসব চালিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক এক দশকের শাসনক্ষমতায় ছাত্রলীগের দুষ্কর্ম-দুনার্ম যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার রেশ না কাটতেই ২ নভেম্বর দুপুরে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দীন আহম্মেদকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার ঘটনার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে মারধরের দৃশ্যটিও দেশবাসী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যাণে দেখেছে। প্রতিটি ঘটনার সাথে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে আছে। একটি জাতীয় দৈনিকে অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন বলেছেন, বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের নেতারা আমার কাছে অন্যায় দাবি নিয়ে আসত। তাদের অন্যায় দাবিকে আমি কখনো পাত্তা দিতাম না। সেজন্য তারা আমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। ক্লাসে পর্যাপ্ত হাজিরা না থাকলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেয়া হয় না। এটাই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম। অথচ দু’জন ছাত্র এই নিয়ম ভাঙার জন্য আমাকে চাপ দেয়। আমি তাদের অন্যায় আবদার না মানার কারণে আমার ওপর চড়াও হয় এবং টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেয়।
নিকট অতীতে ধর্মীয় বিষয়ে কটূক্তির কারণে নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তিকে যখন কান ধরে ওঠবসের সাজা দিয়েছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য তখনো আমরা শিক্ষকের অধিকার ও অপমানের কথা বিবেচনা করে নিন্দা জানিয়েছি। কিন্তু রাজশাহীর অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দিয়েছে তারই কিছু নামধারী বেয়াদব ছাত্র। শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করানোর বিচারের দাবিতে সোস্যাল মিডিয়ায় যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, রাজশাহীর ঘটনায় কিন্তু সেভাবে প্রতিবাদ চোখে পড়েনি। অথচ রাজশাহীর ঘটনা কোনো অংশেই কম গুরুতর নয়। একজন অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দেয়ার ঘটনায় সচেতন শিক্ষক মহলের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গুম, খুন, অপহরণের এই দেশে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা যদি সেলুকাস দেখতে পেত; তাহলে আফসোস করে বলত- কী বিচিত্র ছাত্রলীগ! দুর্নীতির অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগের দাবিতে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচির ওপর আকস্মিক হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হামলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক, সাংবাদিকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হয়। অথচ ভিসি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ না করে উল্টো ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
বাংলাদেশের সর্বত্র চরম অনাচারের রাজত্ব চলছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে দেশের প্রচলিত আইনকানুন রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিছু মানুষ অমানুষে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক পেটানোর ঘটনা দেশে নতুন তা কিন্তু নয়। গত জুলাই মাসেই চট্টগ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের কিছু সদস্য। তার অপরাধ ছিল, নিয়মিত ক্লাস না করায় তিনি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে দেননি। মে মাসে পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা চলার সময় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে দুই শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতা কিছু সময়ের জন্য জব্দ করার অপরাধে মাসুদুর রহমান নামে এক শিক্ষকের ওপর কলেজের গেটেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। কয়েক দিন আগেই টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিবাদে ৫৬ জন শিক্ষক প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিসিকে পিটিয়ে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মাহবুব উল্লাহকে রাস্তায় মারধর করে টেনেহিঁচড়ে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জাফর ইকবালের কান্নাভেজা হৃদয়ের কথা নিশ্চয়ই দেশবাসী এখনো ভোলেনি। সেদিন জাফর ইকবাল বলেছিলেন, আমার গলায় ফাঁস দেয়া উচিত। কারণ, যে স্লোগান দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, সেই একই স্লোগান দিয়ে শিক্ষকের ওপর হামলা করেছে ছাত্রলীগ। অথচ শিক্ষকের ওপর হামলা, লাঞ্ছনার বেশির ভাগ ঘটনারই বিচার হয়নি। শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়। অথচ শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকের ওপর হামলা চালানো, হুমকি দেয়া ও লাঞ্ছনা করার ঘটনা মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে ক্ষমতা ও স্বার্থকেন্দ্রিক প্রতিহিংসার রাজনীতিই মূলত দায়ী। ওপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই জাতির মেরুদণ্ডের ওপর চরম চপেটাঘাত। এমনটিই যদি চলতে থাকে, তাহলে সমাজে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড তা অর্থহীন হয়ে পড়বে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা