২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্নীতি সন্ত্রাস ও উন্নয়নের ত্রিভুজ

-

দুর্নীতি সন্ত্রাস ও উন্নয়নের সমন্বয়ে মারাত্মক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। সন্ত্রাসীরা খুন-গুম ইত্যাদি পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা দেদার দুর্নীতি করে যাচ্ছে। সরকারি মুখপাত্ররা উন্নয়নের ফিরিস্তি বয়ান করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। আন্দোলন-অক্ষম বিরোধীদলগুলো অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে আয় বৈষম্য এবং দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে। সরকার শুধু পদ্মা সেতুর গড়ে ওঠা পিলার এবং বসানো স্প্যানের সংখ্যা গণনা করে উন্নয়নের বার্তা ঘোষণা করছে। বহুল আলোচিত বিভীষিকাময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও উন্নয়ন এ তিনটি বাহু নিয়ে যেন এক ভয়ঙ্কর ত্রিভুজ সৃষ্টি হয়েছে দেশে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে ঢুকলে যেমন জাহাজ-বিমান সবকিছু হারিয়ে যায়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তেমনি দুর্নীতি সন্ত্রাস ও উন্নয়নের বাংলাদেশী ট্রায়াঙ্গেলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা নিরাপত্তা সবকিছু।

ঘটমান দুর্নীতি সন্ত্রাস কিংবা উন্নয়নের বিশদ বিবরণের প্রয়োজন নেই- সবাই সবকিছু জানেন এবং বোঝেন। দুর্নীতি যারপরনাই লাগাম ছাড়া সর্বনাশা রূপ ধারণ করেছে। টিআইবির মতো সংস্থাগুলো দলিল প্রমাণসহ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিবরণ মিডিয়ায় প্রকাশ করছে। ফলে সরকার এসব দুর্নীতি বাজদের ধরতে বাধ্য হচ্ছে। অবশেষে যেন সরকার বুঝাতে পেরেছে যে লাগাম না টানলে এই দুর্বৃত্তরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধ্বংস করে ফেলবে। আর অর্থনৈতিক পরিকাঠামো যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে যাবে। তাই এদের বিরুদ্ধে সরকার উঠেপড়ে লেগেছে।

সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে ওই একই কথা। সম্প্রতি সন্ত্রাসীরা বুয়েটিয়ান আবরারকে হত্যা করে তাদের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করল। এদের না আটক করে জনমতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস বা ইচ্ছা ক্ষমতাসীনদের আছে বলে বিজ্ঞ মহল মনে করেন না। যে কারণে ক্যাসিনো কাণ্ডের হোতাদের না ধরে উপায় ছিল না, সে কারণেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হওয়া সত্ত্বেও আবরারের খুনিদের আটক করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- গণরোষের বিস্ফোরণ ঠেকাতেই সরকার দুর্নীতিবাজ জুয়াড়ি সন্ত্রাসী ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করছে। যে যাই বলুক বা মনে করুক সরকারের এই পদক্ষেপের ফলেই কিন্তু জনগণ মুখ খুলতে শুরু করেছে। জনগণ দাবি করছে এই অরাজকতার অবসান হোক। সরকারও জনগণের সাথে তাল মিলিয়ে বুঝাতে চাচ্ছে যে, সরকার আর কোনো সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বরদাস্ত করবে না। এমনকি নিজের দলের অপরাধীদের কাউকেই সরকার কোনো ছাড় দেবে না। নীতিবাগীশরা বলেন যে, সন্ত্রাসী অপরাধীদের কোনো দল নেই, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওপরমহলের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া কি কেনো ভালোমন্দ কিছু ঘটবার উপায় আছে? সরকারি দলের নামধারী আটককৃত অপরাধীরা সরকারের অজান্তে এতসব অপকর্ম এতদিন ধরে চালিয়ে আসছে এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।

বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি অত্যন্ত কঠিন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের কাছে চীন ভারত ও আমেরিকাকেন্দ্রিক কূটনৈতিক সমীকরণটা প্রহেলিকায় পরিণত হয়েছে। প্রায় সতেরো লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আটকা পড়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্যে চীন ও ভারত সফর করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে চীন অবস্থান পরিবর্তন করেনি। এমনকি ভারত ও জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট দানে বিরত থেকে বাংলাদেশকে হতাশ করেছে। অথচ ভারত তার চাহিদামতো সবকিছুই বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে।

সম্প্রতি চুক্তি থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলো ভারত। এ দেশে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেল। সরকার মিয়ানমার, মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করল। বাংলাদেশ কিন্তু আগে চুক্তি মোতাবেক পাঁচ শত টন ইলিশ ভারতে রফতানি করে দাদাদের দুর্গাপূজার ইজ্জত রক্ষা করল। অথচ গত কোরবানি ঈদের সময়ের ভারতীয়রা বাংলাদেশে কোনো গরু রফতানি করেনি। যদিও এর ফলে বাংলাদেশের গরু কোরবানি থেমে থাকেনি। বাংলাদেশীরা নিজস্ব খামারগুলোয় উৎপাদিত গরু-ছাগলের মাধ্যমেই কোরবানির ঈদ এবং সাংবাৎসরিক গোশতের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতীয়দের গরু না পাঠানোটা এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য শাপেবর হয়েছে।

তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। এখানেও ওই একই অবস্থা। বাংলাদেশের নাকের ডগায় তিস্তা চুক্তির মুলা ঝুলিয়ে ভারত আমাদের ফেনী নদী থেকে তাদের ‘খাওয়ার জল’ পেয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যেকোনো বিবেকবানের মনে একটা প্রশ্ন জাগবে গঙ্গাচুক্তি সত্ত্বেও শুষ্ক মওসুমে কখনোই চুক্তি মোতাবেক পদ্মায় পানি না দিয়ে, তিস্তা চুক্তি হিমাগারে রেখে দুই দেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া চুয়ান্নটি নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমি বানানোর মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েও বাংলাদেশের কাছে ফেনী নদী থেকে খাওয়ার জল চাইতে দাদাদের কি লজ্জাবোধ হয়নি।

ভারত চাইলে বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিতে হয়। সম্প্রতি ভারত আবার সরাসরি ট্রানজিট চেয়েছে এবং সেটা তারা পেতেও চলেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো সমস্যাই তো ভারতীয়দের কাছ থেকে সমাধান করে নেয়া সম্ভরপর হচ্ছে না। ভারতের এমন অদ্ভূত বন্ধুত্বের নাগপাশে নাভিশ্বাস উঠেছে বাংলাদেশের। এ দেশের নীতিনির্ধারকেরা কি স্বদেশের স্বার্থটুকু রক্ষার জন্য কার্যকর কিছু করবার তাগিদ বোধ করছেন না?

তৃতীয় দফায় এই বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মনে করা হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী। টিভির টক-শোর অনেক পণ্ডিতব্যক্তি এমন কথা বলছেন। বাংলাদেশে তিনি অসাধ্য সাধন করছেন বললেও কম বলা হয়। এ পর্যন্ত তার পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপূর্বক বেশির ভাগ আসামিদের ফাঁসি নিশ্চিত করেছেন। যুদ্ধ অপরাধীদের সব জেলে ঢুকিয়েছেন ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। দুই বারের নির্বাচিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী থাকায় দুর্বল বিরোধী দলগুলো আজ তার সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো প্রোগ্রাম বা আন্দোলন করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি তিনি নিজের দলের এবং পরিবারের দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসীদের দল থেকে বহিষ্কার করে জেলে ঢুকিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য নজিরবিহীন। শুধু তার ঐকান্তিক সদিচ্ছা ও সাহসেই আজ পদ্মা সেতু বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হতে চলেছে। বিশ্বের দরবারে আজ বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন শুধুমাত্র তার নেতৃত্বের কারণেই প্রশংসিত হচ্ছে। এসব কারণে অনেকেই তার মধ্যে তার পিতার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার উষালগ্নে ভারতীয়দের প্রভু সুলভ আচরণে লাগাম টেনেছিলেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিষেধাজ্ঞা ভেঙে করাচিতে ও আইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাস পাঠকরা অবগত আছেন প্রবাসী সরকার এবং ভারত এর মধ্যে স্বাক্ষরিত দাসত্বসূচক সাত দফা চুক্তি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে যথাযথভাবে স্বাধীন করেছিলেন। তিনি ভারতকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানে আটকেপড়া হাজার হাজার বাঙালি সেনাসদস্যদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কারণে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নিতে ইন্দিরা গান্ধীকে বাধ্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভারতীয়দের বাধা উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে কাজ করার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন।

বাংলাদেশ এখন সার্বিকভাবে অত্যন্ত জটিল সময় অতিক্রম করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন রোহিঙ্গা সঙ্কট আরো ঘনীভূত ও দীর্ঘায়িত হতে চলেছে। ট্রানজিট, ফেনী নদীর পানিসহ আরো অনেক বিষয়ে ভারতের ‘বন্ধুসুলভ’ চাপাচাপি বাংলাদেশকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার ফলে চীনের সাথেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শীতল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান স্থিমিত হয়ে এসেছে। জুয়াড়ি সন্ত্রাসীদের অপকর্ম আবার শুরু হাওয়ার আশঙ্কা করছে ভুক্তভোগীর জনগণ। আর এই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা যে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের তলোয়ার শানাচ্ছেন তা বলাই বাহুল্য। এমন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তার পিতার মতোই শক্তি-সামর্থ্য ও দেশপ্রেমের নজির স্থাপনের সুযোগ এসেছে। সম্প্রতি তিনি মিডিয়াতে বলেছেন বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি শেখ হাসিনা কারো সাথে করতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যার ওই বক্তব্যকে স্বাগত জানায় এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বদেশের স্বার্থ রক্ষাকারী সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রত্যাশা করে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল