১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর...

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর... - ছবি : নয়া দিগন্ত

নাতি তাহান। শহরের প্রতিষ্ঠিত ইংলিশ স্কুলের স্ট্যান্ডার্ড টু-এর শিক্ষার্থী। মাসিক ব্যয় ১৫ হাজার টাকার মতো। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে এসএসসি পর্যন্ত তার দাদার যে টাকা ব্যয় হয়েছিল, সে টাকা দিয়ে আজকাল ভালো এক জোড়া ইলিশ মাছও পাওয়া যায় না। তার পরও দাদা ও নাতির পাঠের মধ্যে কোথায় যেন মস্ত বড় এক শূন্যতা। শূন্যতার কারণ ও রহস্যের সন্ধানে মনপবনের ঘোড়ায় চড়ে মুহূর্তে পৌঁছে যাই ১৯৬৪ সালের সোনারগাঁওয়ের প্রত্যন্ত এলাকায়। দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে, হ্যামিলনের বংশীবাদকের পেছনে যেভাবে ইঁদুরবাহিনী জোটে, ঠিক সেভাবে আমরাও জুটেছিলাম প্রধান শিক্ষকের পেছনে। ১৯০০ সালে স্থাপিত বারদী হাইস্কুল এবং পানাম জিআর ইনস্টিটিউট। উভয় প্রতিষ্ঠানের মাঝামাঝি একটি হাইস্কুলের প্রয়োজনীয়তা বহু আগে থেকে ছিল। পরিশেষে স্থানীয় আলহাজ নেকবর আলী মুন্সি তার স্বত্ব-দখলীয় মধুঠাকুরের বাড়ি স্কুলের জন্য দান করে দেন। দানকৃত ৬.৬১ একর জমির ওপর বাড়ি, গোটা চারেক শানবাঁধানো ঘাটসহ এক জোড়া পুকুর, মাঠ, শতাধিক আম, কাঁঠাল, লিচু গাছসহ জানা-অজানা ফলমূলের বাগান নিয়ে ভূমির ওপর ১৯৫৭ সালে মঞ্জুরি প্রাপ্ত বৈদ্যেরবাজান এন এ মেমোরিয়েল হাইস্কুল। হাইস্কুল টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক আহসান উল্লাহ।

৬.৬১ একর ভূমির মধ্য ভাগে কমবেশি এক একর ভূমির ওপর মধুঠাকুরের একতলা ইমারত। প্রচলিত আছে, তার কোনো এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল ভাওয়ালের রাজার সাথে। তাই রাজকীয় হালে নির্মিত বর্গাকার ইমারতের মাঝখানে মাঠ। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির আদলে বাড়িঘেরা মাঠ, যা পূজাপার্বণসহ নাট্যমঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চব্বিশের বেশি কক্ষবিশিষ্ট ঠাকুর বাড়ির পশ্চিমাংশ শিক্ষকদের আবাসস্থল, দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে লাইব্রেরি এবং অপরাপর অংশ শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়।

প্রতিষ্ঠান চালু রাখার জন্য শিক্ষার্থী আবশ্যক। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্কুলের মাঠে শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজসহ নানা রকম খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। তখন বাজনার তালে তালে কুচকাওয়াজ ছিল আমাদের কাছে বিস্ময়। মুগ্ধ নয়নে কুচকাওয়াজের বিস্ময় দেখার জন্যই মেঘনার পূর্বপাড় কুমিল্লার চর এলাকা থেকে চলে আসতাম ঠাকুরের বাড়ি। তখনকার মেঘনা এখনকার মেঘনার মতো শান্ত ছিল না। বদর পীরের নাম না নিয়ে কেউ মেঘনা পাড়ি দিতে সাহস পেত না। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ দেখাকালেই স্কুলে পড়ার স্বপ্ন দেখতাম। ঠাকুর বাড়ির স্কুলে পড়তে হলে থাকতে হবে লজিং (থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে ছাত্র পড়ানো)। আগে লজিংয়ের ব্যবস্থা, পরে লেখাপড়া। যে লজিং থাকে তার নাম মুন্সি। ডিসেম্বরের শেষ দিকেই বাইরের ছাত্র সমাগম শুরু হয়ে যায়। হিন্দু অধ্যুষিত গরিব এলাকা। স্কুলে নেই বোর্ডিং এবং আশপাশে নেই লজিং। স্কুল কমিটির লোকজনসহ নিরুপায় শিক্ষকমণ্ডলী এক ঝাঁক বহিরাগত শিক্ষার্থী নিয়ে বের হয়েছেন লজিংয়ের খোঁজে। বংশীবাদকতুল্য প্রধান শিক্ষক আগে আগে আর ইঁদুরবাহিনীতুল্য আমরা পেছনে পেছনে।

ত্রিবেনী পার হয়ে ঝাউচর থেকে অভিযান শুরু। ঠাকুরবাড়ি থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে- এখন যেখানে মেঘনা উপশহর, সেখানে ছিল ঝাউচর গ্রাম। শুষ্ক মওসুমে জমির আলের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ আর বর্ষায় নৌকা ছাড়া যাতায়াতের সুযোগ ছিল না। প্রধান শিক্ষক বিএ বিটি। ইংরেজিতে পারদর্শিতার বিষয়ে এলাকায় তার অনেক নামডাক। সুদর্শন প্রধান শিক্ষক সুন্দর করে কথা বলতে পারতেন। টিনের ঘর, প্রকাণ্ড উঠান ও বড় খড়ের স্তূপ দেখলেই মালিকের খোঁজ নিতেন। সালামসহ বাড়ির মালিক সামনে এলেই চেপে ধরতেন লজিংয়ের জন্য। আমাদের দেখিয়ে বলতেন, এখানে শতাধিক শিশু। আপনার যাকে পছন্দ, একজন রাখতেই হবে। বাইরের ছাত্র ছাড়া স্কুল চলবে কী করে?

চেপে ধরতেন স্কুল কমিটির লোকজনসহ শুভাকাক্সক্ষীরাও। কেউ কেউ ‘অনুরোধে ঢেঁকি গেলা’ হয়ে বাছাই শুরু করতেন। ঝাউচর, খাসেরচর ও কালিরচর- তিনগ্রাম হাঁটতে গিয়েই দিন শেষ। মাঝে মধ্যে পানি ও মুড়ি চিবান ছাড়া পেটে আর কিছু পড়েনি। এভাবে আরো কয়েক এলাকায় কয়েকদিন হাঁটার পর অনেকের লজিং হলেও আমার ওপর কারো নজর পড়েনি।
আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় লালুকা। ঠাকুর বাড়ির কাছে হাড়িয়া এলাকায় থাকেন। খুঁজে বের করি লালুকাকে। তার নিজের বাড়ি নেই, শ্বশুরবাড়িতে ছোট্ট দোচালা ঘর তুলে থাকেন। শ্বশুরেরও নিজের বাড়ি নয় সেটা। চার-পাঁচ সন্তান নিয়ে দিনমজুরি করে দিন পার করেন লালুকা।

শ্বশুরবাড়ির লোকজনও গরিব। আমার বাবা খরচ হিসেবে চাল দিতে রাজি। অনেক বোঝাবুঝির পর চাল ছাড়াই চার পরিবার মিলে লজিংয়ের ব্যবস্থা হলো। বাড়ির দক্ষিণ ভিটায় সামন্ত আমলের জরাজীর্ণ বিল্ডিং। শ্যাওলাধরা বিল্ডিংয়ের নানা স্থানে বট-শ্যাওড়ার শিকড়-বাকড় গজিয়ে রয়েছে। বাকি তিন ভিটায় তিনটি কাঁচা ঘর। উঠানের মাঝখানে বড় একটি আমগাছ। লালুকার শ্বশুর-শাশুড়ি যে চৌকিতে শোয়, সে চৌকির একপাশে আমার শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পড়ার জায়গা তখনো ঠিক হয়নি। চাচার শাশুড়ি অর্থাৎ আমার নানী মানসিক রোগী। মাঝে মধ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ফিরিয়ে আনতে হয়। সারাক্ষণ বিড়বিড় করতেন, গুনগুনিয়ে গান গাইতেন এবং নিজে নিজেই কথা বলতেন। ‘পাগলি’ নানীর বিছানার পাশেই ঘুম গেলাম। শিশুর হইচইয়ে ঘুম ভাঙে সকালে। আমগাছের গোড়ায় একপাল শিশু হোগলা পিঁড়ি পেতে কার আগে কে বসবে, এ নিয়ে হইচই। সবাই আরবিশিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের ‘মুন্সি’ আমি। মুন্সির পাঠদান দেখার জন্য আশপাশে অপেক্ষমাণ কয়েকজন উৎসাহী মুরব্বি। ‘নতুন মুন্সি’র খবর পেয়ে পড়তে আসেন পাশের বাড়ির শিক্ষার্থীও। তাদের মধ্যে কাঠের ফ্রেমের ওপর কুরআন শরিফ নিয়ে বসে রয়েছেন আমার বয়সী এক মেয়ে। রাতে পড়াতে হবে বাংলা।

সূরা-কালামসহ বাংলা পড়াতে না পারলে কিসের ‘মুন্সি’? লালুকার ঘরের বেড়ার সাথে তক্তা ঝুলিয়ে জলচৌকিতে বসে আমার পড়ার ব্যবস্থা। এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বছর দেড়েক পার করার পর চলে যাই আনন্দবাজার এলাকায়। ওখানে ছিলাম এক মেম্বারের বাড়িতে। তার ছিল তাঁতের কাপড়ের ব্যবসায়। যে ঘরে আমার থাকা ও পড়া, সে ঘরেই ছিল ডজনখানেক তাঁতকল। হস্তচালিত তাঁতীদের কেউ কেউ তাঁতের তালে তালে গান ধরতেন। তাঁত আর গান একসাথে শুরু হলে পড়ার ঘরটি বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। এর বছরখানেক পর চলে যাই এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। তাদের মাঠ ভরা জমি ও হাট ভরা ব্যবসায়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই ব্যবসায়ী, দুই ভাই কৃষক। কৃষক দুই ভাই মাঝে মধ্যে আমাকে মাঠের কাজে নিয়ে যেতেন। আমার সাপ্তাহিক খরচ বরাদ্দ ছিল এক টাকা। বুধবার বাবা আনন্দবাজার হাটে আসতেন। বাবাকে পাওয়ার জন্য ক্লাস কামাই করেই ছুটে আসতাম হাটে। বাবার দেখা পেলে উনি টাকা দেয়াসহ আমাকে নিয়ে বসাতেন ঘোষ দোকানে। হাইস্কুলে আসার আগে মাঝেমধ্যে দুধ বিক্রি করতে আসতাম আনন্দবাজার। দু’আনা তিন আনা সের দরে দুধ বিক্রি করে সওদাপাতি কিনে হিসাব করে বাকি টাকা বাবার হাতে বুঝিয়ে দিতাম। লম্বা গলার ঘোষ আমাদের দুধ কিনতেন। বাবার সাথে আমাকে দেখলেই একগ্লাস দই ও বড় একটা রসগোল্লা দিতেন। বাবা বলতেন, ‘খাইতে পারলে আরো একটা রসগোল্লা ল’।’ আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিতাম, আর লাগবে না।

ঠাকুরবাড়ি থেকে আনন্দবাজার তিন কিলোমিটার। কোথাও উঁচুনিচু, কোথাও আঁকাবাঁকা, মাঝখানে একটি খাল। খালের ওপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। রাস্তার দুপাশে ফুলকপি, বাঁধাকপি আর টমেটোর ক্ষেত। সকালে গুড় দিয়ে চারটি রুটি খেয়ে স্কুলে আসি। আড়াইটার দিকে ছুটির পর ক্ষিধায় পেটের নাড়িভুড়ি হজম হতে শুরু করত। সাঁকো পার হয়ে ডান দিকে নগরজোয়ার ও বাম দিকে ঘোষপাড়া। নগরজোয়ারের কদমা, মুড়ালি, গজা, নিমকি, তিল্লা, বাতাসা এবং ঘোষপাড়ায় রসগোল্লা, আমৃতি, চিনির জাম ও চমচম তৈরির কারখানা। এসব কারখানা থেকে মুখরোচক খাবারের ভেসে আসা গন্ধে মাথা আউলিয়ে যেত। কখনো কখনো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তার দু’পাশের কাঁচা টমেটো খেতে শুরু করতাম।

কনকনে শীত শুরু হতেই শুরু হয় যাত্রা ও পালাগান। আলোমতি ও প্রেমকুমারের যাত্রা শুরু হলে ছেলে-বুড়ো কারো মাথা ঠিক থাকে না। লজিং বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি বেরিয়ে যেতাম। অন্ধকার রাত, কাঁচা রাস্তা, ছয় কিলোমিটার দূরে বাস্টমবাগ নতুন বাজার। সব বাধাবিপত্তি পার হয়ে যাত্রার বন্দনা শুরু হওয়ার আগেই পৌঁছে যেতাম টিকিট ঘরে। চৌদ্দ পয়সার টিকিট কেটে ঢুকে যেতাম প্যান্ডেলে। রাতভর যাত্রা দেখে দিনভর পরীক্ষা। পরীক্ষার হলে ঝিমুনি দেখলেই চুল ধরে মাথা নুইয়ে পিঠের ওপর ধাড়–ম-ধুড়–ম মার। ঝিমানি না ছুটা পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক মার থামাতেন না।

নিজে খেলতে না পারলেও ছিলাম ফুটবল খেলার সমঝদার। স্কুল প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলা দেখতে চলে যেতাম পানামনগর কোদালিয়ার মাঠে। কাঁটাযুক্ত বন-বাদাড়ের পাশের রাস্তা দিয়ে ফিরতাম গভীর রাতে। রেডিওতে বিশ্বকাপের ধারাবিবরণী শোনার জন্য চলে যেতাম আনন্দবাজার মিছির আলী ভাইয়ের চায়ের দোকানে। ঝাঁপখোলা দোকান ভরে রাস্তাও ভরে উঠত লোকজনে। ভোরে নদীর তীরে এক মহিলা পিঠা বিক্রি করতেন। সর্ষেবাঁটা ও শুঁটকির ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা আর নারকেল গুড় লাগানো গরম ভাপা পিঠা প্রতি পিস এক আনা। সপ্তায় দু’-একটা মুখে দিতাম।

বর্ষায় একমাত্র বাহন নৌকা। আট-দশজন মিলে ছোট নৌকা আর হাতে হাতে বৈঠা। অন্য নৌকার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই নৌকা তলিয়ে যেত। নিজে ডুবসাঁতারসহ প্রাণপণ চেষ্টা করে বই রক্ষা করতাম। বর্ষার শেষে নদীর পাড় জাগতে শুরু করে। গোসল করতে নেমে গলাজলে গেলেই পাড়ের পানিতে গর্ত। বর্ষার পানিতে তলিয়ে যাওয়া, ইঁদুর ও মাছরাঙা পাখির করা গর্তে মাছ ঢোকে। বিশেষ করে বড় আকারের মোটা বাইলা মাছকে আমরা বলতাম ‘গাউত্যা’ বাইলা। গর্তে অবস্থান করে বলেই এ নামকরণ। গলাজলে গিয়ে পা দিয়ে গর্ত চিহ্নিত করতাম। ডুব দিয়ে চিহ্নিত গর্তে হাত ঢুকালেই ‘বাইলা’। তীব্র স্রোত কখনো কখনো গর্তে হাত ঢুকানো অবস্থায় শরীর উল্টিয়ে দিত। শরীর উল্টিয়ে, দম ফুরিয়ে গেলেও মাছ না নিয়ে ভাসতাম না।

মাঘ-ফাল্গুনে শান্ত ও ছোট হয়ে পড়ে মেঘনা। খেলতে খেলতে চলে যেতাম মাঝনদীতে। নদীর ওইপাড় কুমিল্লা জেলা। একবার সাঁতার কাটতে কাঁটতে নদীর ওইপাড় যেতে শুরু করি। কুমিল্লার পাড় নদীভাঙন এলাকা। ভাঙন এলাকার কাছে পৌঁছতেই, এক জেলে কুমিরের ভয় দেখায়। কয়েক দিন আগে সে না কি মেঘনায় কুমির দেখেছে। ডুব দিয়ে চোখ মেললেই কালো কুচকুচে পানি। মাঝে মধ্যে ভুঁস করে ভেসে ওঠে শুশুক। ভাবতে গেলে এখনো ভয়ে শিউরে উঠি। ঝুঁকি নিয়ে সাঁতরিয়ে কুমিল্লাপাড়ে গেলেও ফিরে আসার জন্য একজনও নদীতে নামতে চায় না। অনেক অপেক্ষার পর নৌকায় করে ফিরেই দেখি, আরেক বিপদ। ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে সামনে লজিং বাড়ির আবদুল্লাহ দাদা। কারণ, আমাদের টিমে ছিল চতুর্থ শ্রেণীপড়ুয়া আমার এক ছাত্র। দুরন্ত প্রকৃতির ছাত্রটি সবার দোহাইও নিষেধ উপেক্ষা করেই মেঘনা পাড়ি দিয়েছিল। গোসল করে সময়মতো না ফেরায় সাঁতার কাটার খবর বাড়িতে পৌঁছে যায়। বাড়িতে খবর পৌঁছে যায় যে, চরের ‘মুন্সি’ শিশুশিক্ষার্থী নিয়ে নদী সাঁতরিয়ে ওই পাড়ে চলে গেছে। শুনেই পড়ার ঘর থেকে স্যুটকেসসহ আমার বই-পুস্তক বাইরে ফেলে বাড়ির ঘাটে হালুয়া পাঁচন হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দাদা। আমাকে দেখেই, ‘চোরা শালা, আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন। লজিং ক্যান্সেল। ঘরেও ঢুকতে পারবি না। সব কিছু বের করা আছে। এখান থেকেই বিদায় হ। আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় আর যেন তোর ছায়াও না দেখি।’

এসএসসি পরীক্ষার আর মাত্র এক বছর। এ সময় লজিং নিয়ে টানাপড়েন! ভাবা যায় না। ঠাকুরবাড়ির পূর্ব দিকের পুকুরের উত্তর পাড়ে নির্মাণাধীন নতুন বিল্ডিংয়ের পশ্চিম দিকের দুই রুমের কাজ শেষ। বিশালাকৃতির রুমের একটিতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি, অপরটি খালি। স্থানীয়ও দূরের কয়েকজন সচ্ছল শিক্ষার্থী খালি রুমে আশ্রয় নিয়েছে। বাবাকে সম্মত করে আমিও ঢুকে পড়লাম। কম দামের রেডিমেড চৌকি ও ছোট্ট একটি টেবিল নিয়ে পড়ায় মন দেই। রান্না লালুকার বাসায়ই। এত দিনে লালুকাও চলে গেছেন রিফুজি ক্যাম্পে। স্কুল থেকে এক কিলোমিটার দূরে নদীর পাড়ে ক্যাম্প। সকালে গুড়-বাতাসা দিয়ে মায়ের দেয়া মুড়ি-চিড়ায় নাশতা। লালুকার বাড়িতে লাঞ্চ করে টিফিনবক্সে করে রাতের খাবার নিয়ে আসতাম। রাত গভীর হলে টিন থেকে শুকনো খাবার নামিয়ে চিবুতাম আর পড়তাম। ঠাকুর বাড়ির স্কুলের প্রথম বিজ্ঞান গ্রুপ আমাদের ব্যাচ। তখন ভালো শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ত। স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর আমরা কয়েকজন বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য পাশের সদাসদী হাইস্কুলে চলে যাওয়ার উদ্দেশে টিসি চাইলাম। এতে প্রধান শিক্ষকের টনক নড়ে। টিসি দেয়ার পরিবর্তে তড়িঘড়ি তিনি বিজ্ঞান শাখার অনুমোদন আনেন। একজন আইএসসি টিচার দিয়ে বিজ্ঞান শাখার ক্লাস শুরু।

ইলেকট্রিক ম্যাথ করাতেন একজন বিএসসি (প্লাক্ট) টিচার। এমএ পাস টিচার দূরের কথা, বিএ পাস টিচারই দুর্লভ ছিলেন। আবেগের বশে বিজ্ঞান বিভাগ নিলেও জীববিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য বিষয় পড়ার সময় মাথার মগজ টগবগ করে ফুটত। অঙ্ক বোঝার জন্য ছুটে যেতাম রশিদ স্যারের কাছে। গিয়ে দেখতাম, স্যার গেণ্ডারি ক্ষেতের পাতা ছাঁটাই করছেন। পাতা ছাঁটাইয়ে হাত লাগাতাম। ঘণ্টাখানেক ছাঁটাইয়ের পর একটা অঙ্ক বোঝার সুযোগ পেতাম।

পরীক্ষা ঘনিয়ে এলো। নতুন সমস্যা হলো পরিচ্ছদ নিয়ে। লুঙ্গি পরে সারা বছর ক্লাস করলেও এসএসসি ফাইনাল এক্সাম বলে কথা। নারায়ণগঞ্জ শহরে পরীক্ষার সেন্টার। লুঙ্গি নো এলাউড। প্যান্ট একখানা লাগবেই। ঢাকার গুলিস্তান ছাড়া আর কোথাও প্যান্ট পাওয়া যায় না। বাবার কাছ থেকে ২০ টাকা আদায় করে ফুপার সাথে ঢাকা রওনা হলাম। সাথে ফুপাত ভাই শামসুদ্দিন। সেও একখান প্যান্ট কিনবে। গুলিস্তান সিনেমা হলের তিন পাশেই প্যান্টের দোকান। বাঁশ-কাঠির আলনায় ভাঁজ করা অনেক প্যান্ট। এর মধ্য থেকে ১০ টাকায় পছন্দমতো একটা প্যান্ট কিনে ফেলি। শামসুদ্দিনের জন্য এ দোকান ও দোকানে প্যান্ট খুঁজছি। এমন সময় পেছন থেকে ডাকেন ফুপা। প্যান্ট দেখতে বারণ করে পকেট দেখিয়ে বলেন, টাকা নেই। দেখি এক সাইড দিয়ে পকেট কাটা। সবারই মন খারাপ। ঢাকার রামপুরায় ফুপার বোনের বাড়ি। রাতে থাকতে গিয়ে দেখি পাশের মাঠে যাত্রার প্যান্ডেল। প্যান্ট কেনার পর থেকেই তা পরিধানের জন্য মন উশখুশ করছিল। নতুন প্যান্ট পরে ফুরফুরে মন নিয়ে হোগলার ওপর আয়েশ করে বসতে গেলেই হাঁটু বরাবর ঠাস করে ফেঁসে যায় প্যান্ট।

নিবন্ধ শুরু করেছিলাম যে পাঠপদ্ধতি দিয়ে, শেষ করছি সে বিষয় দিয়েই। নাতি তাহান স্ট্যান্ডার্ড টু- RADIANT READING Gi 'GULLIVER IN THE LAND OF LITTLE PEOPLE' যত ভালো বোঝে, বাংলায় তত খারাপ। খাতায় নম্বর কম দেখে বাংলা বই হাতে নিয়ে ‘আমাদের দেশ’ কবিতা বোঝাতে গিয়ে নিজেই হতবাক। কবিতার একাংশে ‘নদী বয়ে যায়’ ও ‘জেলে ভাই ধরে মাছ’ উল্লেখ রয়েছে। তাহান কবিতাটি পড়তে চায় না। কারণ, নদী ‘বয়ে’ গেলে বই ভিজে যাবে। ‘জেলে’ চোর থাকে, মাছ থাকে না।’ ‘জেলে’ এবং ‘বয়ে যাওয়া’ শব্দের অর্থ জানা নেই বলেই এ অবস্থা। শুধু বাংলা নয়, অঙ্কেও কাঁচা। ‘এক হাতে পাঁচ আঙুল হলে দুই হাতে কয় আঙুল?’ উত্তর দিতে গেলেই আউলিয়ে যায় মাথা।

স্রষ্টার সৃষ্ট প্রকৃতির ভেতর কেটেছে আমাদের শৈশব। যেদিকে পা বাড়াতাম, সেদিকেই শিক্ষালয় আর যেখানে উঁকি দিতাম, সেখানেই শিক্ষক। বিশ্বজোড়া শিক্ষালয়ের শিক্ষকরা কখন কী শিখিয়ে গেছেন, ইয়ত্তা নেই। রেখে আসা সেই বিশ্বজোড়া শিক্ষালয়ের কথা মনে পড়তেই ছুটে যাই পাঁচ দশক আগের মধুঠাকুরের বাড়ি। পথঘাট, নদী, ছড়ানো ছিটানো জনপদ আগের মতো নেই। শহরের মতোই শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে গাড়ি করে স্কুলে আসে। বাড়ি গিয়ে আবার মোবাইল, ফেসবুক, নেট কিংবা টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখতে বসে পড়ে।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement