২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

নীতি-নৈতিকতার অধঃপতনে নিপীড়নের ঊর্ধ্বগমন

-

ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে বিশ্ব-সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। গত ১০০ বছরে বিশ্বে অসাধারণ উন্নতি সাধিত হয়েছে, কিন্তু আধুনিক সভ্যতার বিপরীত স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমেই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়, নষ্ট হচ্ছে মূল্যবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও শৃঙ্খলা। ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। ফলে অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজব্যবস্থা। বিশ্বে যত উন্নতি সাধিত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সভ্যতা মানুষের কল্যাণ বয়ে এনেছে ঠিক, তেমনি ভয়াবহ ক্ষতিও ডেকে এনেছে। শত বছরে পৃথিবীতে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছে, তৃতীয়টির অপেক্ষায় আছে।

এ ছাড়াও আধিপত্য বিস্তারের জন্য রুয়ান্ডা, ইরান-ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, সুদানসহ অনেক দেশেই চলছে যুদ্ধ, জাতিগত নিধন নিয়ে বসনিয়া, চেচনিয়া, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ অনেক দেশেই হয়েছে গৃহযুদ্ধ, এ ছাড়া আরো অনেক লড়াইয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্যা মানুষ। বিশ্বনেতারা নীরব। জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি বা অন্য কোনো সংগঠিত জাতি গোষ্ঠীর বা জোটের মধ্যেও এসব ঘটনা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা বা উচ্চবাচ্য নেই। সবার কাছে মনে হচ্ছে যেন এসব সাধারণ ঘটনাই।

মানুষ মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, বিশ্বাস করাটাই অপরাধ, আইন না মানাটাই বাহাদুরি। পেশাজীবী-আইন প্রণয়নকারীদের আচরণই খুবই বেদনাদায়ক। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে যদি নীতি, সততা ও আদর্শবর্জিত হয়, তাহলে মানবিকবোধ কমে। এতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, উগ্রতা, হিংস্রতা, অনৈতিকতার প্রসার লাভ করে। একজন শিক্ষক, বিচারক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষক এবং চিকিৎসকের সততা ও নৈতিকতার মাত্রা এক হলেও তাদের অসততা ও অনৈতিকতার কর্মফলের মাত্রা কোনো সভ্য সমাজের জন্য এক নয়। আদর্শচ্যুতির কারণে চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা, ন্যায়রীতি এবং মননশীলতার বিনষ্ট করে। সংশ্লিষ্ট পেশায় সততা ও নৈতিকতা অতীব গুরুত্ব সকলের কাছে। এদের সবার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকে আজীবন ‘নৈতিকতা’ শব্দটি।

শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে না পড়িয়ে অতিরিক্ত টাকার লোভে কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে বেশি পছন্দ করেন। কম পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়তা পেতে শিক্ষার্থীরা যা পছন্দ করে তারা তাই করেন। শিক্ষকতা পেশা থেকে অন্য পেশায় মনোনিবেশ করেন। নিজের অপরিপক্বতা শিক্ষার্থীর ওপর চাপিয়ে দেয়াটা অনেকটা স্বভাব সুলভ আচরণ। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার কেন্দ্র। এখানে হওয়ার কথা জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান বিতরণ। আমরা কী খুঁজে পাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে! আমরা কি বুঝি কোচিং সেন্টার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য! নৈতিকতা শিক্ষা দেন শিক্ষকেরা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করেন। সেই শিক্ষকদের অনেকেই নারী নীপিড়নসহ চরম নৈতিক বিবর্জিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। একটি পদের জন্য একজন শিক্ষক যে কারো কাছে গিয়ে নিজেকে পদদলিত করে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান। শিক্ষকেরা শুধু চাকরির জন্য কাজ করেন না, তারা কাজ করেন সমাজ পরির্বতনের জন্য। এ পেশায় এসে অন্য পেশার সুযোগ-সুবিধার তুলনা করা বৃথা।

লোভী চিকিৎসকেরা কমিশনের জন্য রোগীদের অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে বাধ্য করান, ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা ভিজিট দিয়েও দুই মিনিট কথা বলা যায় না। অনেকসময় সব কথা না বলতে পারার কারণে রোগী মানসিক দিক থেকেও স্বস্তি পায় না; একসাথে চার থেকে পাঁচজন রোগী চেম্বারের ভেতরে অবস্থান করার কারণে অনেক সময় রোগীর গোপনীয়তাও রক্ষা হয় না।

মানুষের সর্বশেষ আস্থার জায়গা বিচারালয়। মানবীয় গুণাবলি নীতি-নৈতিকতাকে সামনে রেখে দেশের আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় অনেক কঠিন এ কাজ। তাদের কাজের প্রতিফলনই আমাদের সামাজিক-ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে একটি সামগ্রিক চিত্র ফুটে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রেই আইনের সহায়তার জন্য গিয়ে মহা বেড়াজালে আটকে থাকে।

অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে জীবন বিনাশ করার কাজে লিপ্ত থাকেন। কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে সাময়িক মুনাফা নয়, শুধু আজীবনের জন্য মুনাফা করতে চান। শিক্ষাকে পণ্য করে ইচ্ছেমতো শিক্ষক বানিয়ে পাস-ফেল নির্ধারণ করে দেন। দুর্নীতিবাজ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিইও বা প্রধান হওয়ার অনুমতি পায় বা সনদ জালিয়তকারীরা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অনুমোদন পায়Ñ তাহলে তখন নৈতিকতা গৌণ হয়ে যায়।

একটি সরকারের আস্থার জায়গা মন্ত্রণালয়ের অধিদফতর, যা জনগণকে সঠিক দিকনির্দেশনার বা পরামর্শের মাধ্যমে সরকারের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যথাযথ ভাবে না পারলেও সরকারকে বেকাদায় ফেলবে না। কিন্তু খাদ্যে ভেজালের নামে দুই-তিনটা বিভাগ থেকে দমনের নামে যা হয়েছে তা কি আমাদের সম্মান বাড়াচ্ছে। মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের মধ্যে অনেকসময় সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়, যার ফল ভোগ করতে হয় জনগণের বা সমালোচনা শুনতে হয় সরকারের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষক, কতটা রক্ষা করে চলেন! আর আমরা যখন চার পাশের লোকদের এ কর্ম দেখি, আমরা কিন্তু তখন মনের অজান্তেই নিজেদের প্রতারিত হওয়ার জন্য এবং অন্যকেও প্রতারিত করার জন্য প্রস্তুত করি। ফন্দি করি কিভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে সেই টাকা শোধ না করে বা ঋণ নিয়ে কিভাবে পরিশোধ না করে থাকা যায়। আমরা দেখেও না দেখার ভান করি, অন্যায় দেখলেও পাশ কেটে চলি। আমরা যেন দিন দিন আমাদের নীতি ও নৈতিকতা গুটিয়ে নিচ্ছি।

বিকৃত ঘটনা বাড়ছে কেন? অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নেতিবাচক সংবাদ। তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা বা লাভের জন্য প্রচার মাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপনা হয় তা অন্যতম কারণ। কিছু কোম্পানি পত্রিকা, ইন্টারনেট টেলিভিশনে নানা প্রকার অশ্লীল বা চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যৌন উদ্দীপক ক্ষতিকর ওষুধ বিক্রি করে পুরুষদের বিকৃত রুচির দিকে উৎসাহিত করছে পক্ষান্তরে এসব ওষুধ সেবন করে যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে অনেকে। এসব উত্তেজক ওষুধ পুরুষদের কার্যক্ষমতা কিছু সময়ের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টি করে মাত্র। ক্ষমতা বাড়াতে কোনো ভূমিকাই পালন করে না। একপর্যায়ে বিকৃতি সৃষ্টি করে এবং অবশেষে কার্যক্ষমতায় পুরাপুরি অক্ষম করে ফেলে। ইন্টারনেটে বিভিন্ন অশ্লীল ছবি, ইন্টারনেটে মাধ্যমে মোবাইলে পর্নোগ্রাফিও এর অন্যতম প্রধান কারণ।

যারা সমাজের মান্যজন, তাদের নীতি-নৈতিকতা, আচার-আচরণ প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। সাধারণ মানুষ তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের, সমাজ সচেতনদের কথাবার্তা, ন্যয়বিচার খুব সতর্কতার সাথে বলতে বা করতে হয়। সমাজনীতি ও পরিবার নীতি, তরুণ সমাজের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে যদি নীতিকথা উচ্চারিত হয়, তবে তার প্রতিফলন দ্রুত ঘটে। কারণ, সরকারের প্রশাসনযন্ত্র এগুলো মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে সক্ষম। সরকারের উদ্যোগে সমাজের অভিভাবক-শ্রেণীকে নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ার উদ্যোগ নেয়া সম্ভব।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবার ও সমাজের নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত আলাদা কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। পরিবারের অভিভাবকদেরও নিজের সন্তান ও অন্যান্য সদস্যের আচার-আচরণ এবং চলাফেরার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। সন্তানের মানসিক গঠনের প্রথম পাঠই শুরু হয় পরিবার থেকে। সুষ্ঠু পারিবারিক বলয় থাকলে সন্তানও সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অনাকাক্সিক্ষত অনেক ঘটনা ও দুর্ঘটনা কখনো কখনো ঠেকানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে প্রশ্রয় না দিয়ে, সবার স্বার্থে, সমাজের অবক্ষয় রোধের লক্ষ্যে দলীয় বিবেচনা স্বজনপ্রীতি না করে এসব ঠেকানোর মতো উদ্বুদ্ধকরণমূলক ব্যবস্থা নেয়া গেলে তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। মনে রাখা দরকার এ ধরনের ঘটনা যে কারো পরিবারে হতে পারে।
লেখক : উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা,  সাদার্ন ইউনিভার্সিটি
E-mail: sarwarjahan@gmail.com,


আরো সংবাদ



premium cement