২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ড. সফর আলী আকন্দ : জীবন ও কর্ম

ড. সফর আলী আকন্দ -

মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জাতির কাছে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ সা:-এর প্রস্থানের পর নবী-রাসূল পাঠানো পদ্ধতি স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তার পর থেকে জ্ঞানীরাই নবী-রাসূলের উত্তরাধিকার। পৃথিবীকে আলোকিত ও বসবাসের উপযোগী করার মহান ব্রত পালন করছেন শিক্ষক সমাজ। আপনি সমাজে যেখানে যে অবস্থায় অথবা যে মর্যাদায় থাকেন না কেন আপনি কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র। আনুষ্ঠানিক হোক অথবা অনানুষ্ঠানিক হোক পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ একদিন কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র ছিল। সে ধারার আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক ছিলেন ড. সফর আলী আকন্দ। আমি তার তত্ত্বাবধানে ১৯৮৯ সালে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ থেকে পিএইচডি লাভ করি। আমার সাথে ড. আকন্দের সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অতিক্রম করে পারিবারিক সম্পর্কে উন্নীত হয়। অতঃপর দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তার স্নেহধন্য ছাত্র হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। আমার পরিবারের সব সদস্য তার পরম স্নেহে ধন্য।

ড. সফর আলী আকন্দ ১৯৩১ সালে ৭ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার তেলিকুঁড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম গালিম আকন্দ, মায়ের নাম রওশন জাহান বেগম এবং দাদার নাম মোয়াজ্জেম আকন্দ। তার দাদী ১৮৫৭ সালের সর্বভারতীয় প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত ও পলাতক সৈনিক তালেবর খাঁর মেয়ে। গ্রামের মক্তবের চাটাইয়ে বসে এক নিকটআত্মীয় শিক্ষকের কাছে ড. আকন্দের পড়ালেখা শুরু হয়। সেখান থেকে মোহনগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল ও আনন্দমোহন কলেজ কৃতিত্বের সাথে পাড়ি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ওই বিভাগ থেকে ১৯৫১ সালে বিএ সম্মান এবং ১৯৫২ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের রুমমেট ছিলেন এবং মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তার সহপাঠী ছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ১৯৬৫ সালে এমএ এবং ১৯৭০ সালে পিএইচডি লাভ করেন। তিনি অনার্স পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ১৯৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষে স্যার যদুনাথ সরকার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ এবং ১৯৫২ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউনিভার্সিটি প্রাইজ লাভ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ (১৯৬২-৬৪), একই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিল ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ, পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার আউটস্ট্যান্ডিং পাকিস্তান স্টুডেন্ট অ্যাওয়ার্ড (১৯৬৪-৬৫), লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমনওয়েলথ একাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপ (১৯৭৬-৭৭), ব্রিটিশ কাউন্সিল অ্যাওয়ার্ডস (১৯৭৯ ও ১৯৮৩), ১৯৭৮, ১৯৭৯ এবং ১৯৮৮ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ডস এবং ১৯৭১ সালে ভারতের রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিটিং ফেলোর সম্মান লাভ করেন।

ড. আকন্দ তার কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। অতঃপর ১৯৫৫-৭১ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতা করে ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৭৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১৯৭৫ পর্যন্ত এখানে শিক্ষকতার পর ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস)-এর যুগ্ম পরিচালক এবং সামাজিক ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আইবিএসের পরিচালক এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস (১৯৫৫-৫৮), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কর্মকর্তা ক্লাব (১৯৭০-৭২) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (১৯৭২-৭৩ এবং ১৯৮০-১৯৮৯), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস (১৯৮০-৮৯)-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৪-৮৭ ও ১৯৯০-৯৪), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৯-৯৩) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯০-৯৪) সিনেট সদস্য ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪-৭৫) সিন্ডিকেট সদস্য। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (১৯৭৭-৯২) বোর্ড অব গভর্নরস সদস্য ছিলেন। তা ছাড়া তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৫-৯৬) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৮১-৮৩) একাডেমিক কাউন্সিল ছিলেন।

একাডেমিক সেমিনার উপলক্ষে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি নেদারল্যান্ড অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সম্মেলন (১৯৭৬), ভারতীয় ইতিহাস সম্মেলন : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা (১৯৮১), আমেরিকান ইতিহাস সমিতির সম্মেলন : শিকাগো (১৯৬২), ফিলাডেলফিয়া (১৯৬৩), সানফ্রান্সিসকো (১৯৬৫) এবং নিউ ইয়র্ক (১৯৬৬)। দশম World conference on Anthropological and Ethnological, নয়াদিল্লি (১৯৭৮)। এই সংস্থার ১২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যুগোস্লাভাকিয়ায়। ওই সম্মেলনে ড. আকন্দ একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন : Anthropology: Its application and research in Bangladesh (১৯৮৮)।

১৯৮৮ সালে যোগ দেন শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এশিয়ার আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনে এবং সেখানে উপস্থাপন করেন : 'Problems of British Transfer of Power of Indian Hands in 1947'। এই সংস্থার ১২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে হংকংয়ে। সেখানে তিনি উপস্থাপন করেন 'Background of Historical Research in Bangladesh until the end of Nineteenth Century'। ভারতের নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনে উপস্থাপন করেন : 'The Partition of the District of Malda in 1947' (২০০৪)।

ড. আকন্দ তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে বহু জার্নাল, পুস্তিকা ও গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : দি জার্নাল অব দি আইবিএস, Studies in Modern Bengal, The District of Rajshahi : It's Past and Present, Rural Poverty and Development Strategies in Bangladesh, ‘বাঙালির আত্মপরিচয়’ ইত্যাদি। তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত 'Authentication Committee for the preparation of the documents on the History of Bangladesh war of Independence'-এর সদস্য (১৯৮২-৮৬) ছিলেন।

ড. আকন্দের বহু মূল্যবান ও বিরল গবেষণাকর্ম দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বহু এমফিল ও পিএইচডি গবেষকের গবেষণাকর্মের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রণীত গবেষণা গ্রন্থ Language Movement and the Making of Bangladesh ২০১৩ সালে University Press Ltd. থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং 'The Emergence of Bangaldesh : Regionalism to Nationalism' গ্রন্থটি একই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।

এ মহান ব্যক্তি ঢাকায় নিজ বাসভবনে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইন্তিকাল করেন। অতঃপর তাকে নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। আজ আমরা মহান রবের কাছে আমাদের শিক্ষকের জন্য ক্ষমা ও জান্নাত প্রার্থনা করছি।

লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement

সকল