২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রূপপুর থেকে ফরিদপুর

রূপপুর থেকে ফরিদপুর - ছবি : সংগ্রহ

সমাজের রন্ধ্রে রান্ধ্রে আজ দুর্নীতির ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতির কাছে সবাই আজ অসহায়। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সেমিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আয় বাড়ানোর হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। মাত্র ২৫৫ জন ব্যক্তির কাছে দেশের বেশির ভাগ সম্পদ আটকে আছে। বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ ও কানাডায় গড়ে উঠছে ‘বেগম পাড়া’। অন্য দিকে, বৈষম্যমূলক আয় বাড়ায় রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ শিল্প, টিভি চ্যানেল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক-বীমা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা খাত দ্রুত বর্ধনশীল এ দেশে। এগুলোতে ভর করে কিছু মানুষের পোয়াবারো। জনমানুষের অবস্থার সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। আয়বৈষম্যের কারণেই এত দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কিছু দিন আগে রূপপুরে বালিশ ক্রয় নিয়ে দুর্নীত হয়েছে, যা তদন্তাধীন রয়েছে। বালিশ শেষ না হতেই আবার শুরু হয়েছে ফরিদপুরের একটি হাসপাতালের পর্দা কেনায় দুর্নীতি। এক সেট পর্দার (১৬ পিস) দাম ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সরকার তো যথেষ্ট পরিমাণ বেতনভাতা দিচ্ছে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, শুধু পর্দা নয়, হাসপাতালটির বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে ৪১ কোটি টাকার। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সম্প্রতি এ ব্যাপারে তদন্ত করতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। ২০১২-১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফমেক হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও মালামাল সরবরাহ করে। অবিশ্বাস্য দামে ফমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্রয় করেছে ১৬৬টি চিকিৎসা যন্ত্র ও সরঞ্জাম। আমরা লক্ষ করে আসছি, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্রয় মানেই সেখানে ঘটছে বড় ধরনের দুর্নীতি। কয়েক মাস আগে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে লোপাট হয় সোয়া তিন কোটি টাকা।

বাংলাদেশে ধনী-গরিবের মধ্যে আয়বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় ছিল জিডিপির দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১০ সালে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল জিডিপির ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা কমে মাত্র ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে নেমে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তাদের তথ্য-উপাত্তে ধনীদের আয় বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাটি এর বিপরীত। কিছু মানুষের আয় ও সম্পদ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। অন্য দিকে, সরকারের পক্ষ থেকে দেশে প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নয়নের খবর প্রচার করা হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান। এটি কোনো কাজে আসবে না, যদি দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর আর্থিক দুর্গতির অবসান না হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্রয়ে দুর্নীতি ও অপচয় একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি সেজন্য অত্যন্ত জরুরি। ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ইতঃপূর্বে দুদকের এক সুপারিশে বলা হয়েছিল, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া হাসপাতাল পর্যায়ে যন্ত্রপাতি রিসিভ কমিটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে যন্ত্রপাতি গ্রহণের ব্যবস্থা, যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহের বিধান করা ইত্যাদি পদক্ষেপের কথাও বলা হয় দুদকের সুপারিশে। দুদকের আরো একটি গুরুতপূর্ণ সুপারিশ হলো, হাসপাতালে বিদ্যমান মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের হালনাগাদ তথ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক স্টক রেজিস্টারের সাথে একটি ডিসপ্লে যুক্ত করা যেতে পারে। হাসপাতালে ই-রেজিস্টার চালু করা যেতে পারে। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে দুদকের সুপারিশগুলো আমলে নেয়া উচিত। মোদ্দা কথা, সরকারি ক্রয়ের সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে যা কিছু করা প্রয়োজন তা করতে হবে। সেই সাথে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠামাত্র তার সুষ্ঠু তদন্ত করে নিতে হবে ব্যবস্থা। ফমেক হাসপাতালের ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতির বিষয়টিরও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।

এ দিকে, কৃষিতে চলছে দুরবস্থা। কৃষকের উন্নতির বদলে হচ্ছে ক্রমাবনতি। তাদের জীবনে নেমে আসছে চরম দারিদ্র্য। ধনকুবেরদের বেশির ভাগই গার্মেন্ট শিল্পের মালিক। কিন্তু ৩৫ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। অথচ দেশে জিডিপির হার দেখানো হচ্ছে ৮ শতাংশের ওপরে। সরকারি তরফ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে নজির সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতি সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, আয়বৈষম্য বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন পুরোটাই অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি এর সুফল জনগণের পর্যায়ে না পৌঁছে। সমিতিতে উপস্থাপিত এক প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর দখলে ২০১০ সালে ছিল মোট জিডিপির ৩৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে দেখা গেছে, ধনাঢ্য মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের কাছে জিডিপির ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আরো জানানো হয়, বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে ধনকুবেরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

দুর্নীতি সরকারের ভাবমর্যাদাকে ম্লান করে দিচ্ছে। বালিশ-পর্দা কেলেঙ্কারির ঘটনা মানুষের মুখে মুখে। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বই স্বাস্থ্য অধিদফতর কিনেছে ৭৫ হাজার ৫০০ টাকায়। দুর্নীতি হয়ে গেছে এখন হাস্যরসের বিষয়। লুটপাটে ওয়াসা ডুবতে বসেছে। বেসরকারি হিসাবে, সারা দেশে ডেঙ্গুতে প্রায় ২০০ মানুষ মারা গেছে। অকার্যকর ওষুধ ছিটিয়ে কয়েক শ’ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। কোরবানির চামড়া মানুষ মাটিতে পোঁতার ঘটনা ঘটেছে। দুধে সিসা পাওয়া যাচ্ছে। এসব আলামত ভালো নয়। মানুষের জীবন চরমভাবে অনিরাপদ, গুম-খুন নিত্যদিনের ঘটনা।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসন প্রকল্পের বালিশ কেলেঙ্কারি, ফরিদপুরের হাসপাতালে পর্দা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের বই ক্রয়ে অনিয়মের কথা আজ মানুষের মুখে মুখে। পুকুর খনন শিখতে বিদেশে যাবেন ১৬ কর্মকর্তা। এ জন্য ব্যয় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা। রূপপুরের বালিশকে তোশকের নিচে নিয়ে গেছে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি পর্দা কেনার ঘটনা। লুটপাট ও অনিয়মে ডুবতে বসছে ওয়াসা। মুন্সীগঞ্জে যশোলদিয়া থেকে পদ্মার পানি পরিশোধন করে ঢাকা সরবরাহের প্রকল্প শেষ হয়েছে আট মাস আগে; কিন্তু এখনো তা চালু হয়নি। সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হলেও পাঁচ মিনিটে পানির পাইপ ফেটে ভেস্তে গেছে পুরো প্রকল্প।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে চিত্র সরকার দেখাচ্ছে, এর সুফল মূলত সামান্য কিছু মানুষের উদরে চালান হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি এমন জায়গায় সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা বেশির ভাগ মানুষের কোনো কাজে আসছে না। এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে দুর্নীতি দমনে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, যারা নীতিনির্ধারণের জায়গায় রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে উঠছে দুর্নীতির অভিযোগ। এখন সংসদের ৬২ শতাংশ সদস্যই ব্যবসায়ী। অর্থবিত্তের জোয়ার বইছে উঁচু স্তরের ব্যবসায়ীদের ঘিরে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দেশের জনমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে বাস্তবে কিছু দৃঢ়পদক্ষেপ নিতে হবে।
ই-মেইল : likhonalife@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement