২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফোঁপানো কান্না

-

কিছুটা মেঘলা আবহাওয়া ছিল। এমন মনোরম পরিবেশে হৃদ্যতা ও ভালোবাসার বদলে অস্থিরতা ও ক্ষোভ বিরাজ করছিল। এ ক্ষোভের ধরন বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এমন সময় খাজা জাফর নায়েকের কথা বলার ধরনে উপস্থিত ক্ষোভ ফোঁপানো কান্নার রূপ নিলো। তিনি বড় অসহায়ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আপনাদের নিন্দাজ্ঞাপন ও বক্তৃতায় আমার ক্ষুধার্ত সন্তানদের পেট ভরবে না। বুঝে আসছে না, সন্তানদের সাহায্য করব কিভাবে?’ খাজা জাফর নায়েক শ্রীনগরের মানুষ। ২০০২ সালে তার পৃষ্ঠপোষক ও বন্ধু খাজা আবদুল গনি লোনকে হত্যা করায় এতটাই হতাশ হয়ে পড়েন যে, শ্রীনগর ছেড়ে দুবাই চলে গেলেন। তার সাথে আমার সাক্ষাতের মাধ্যমই ছিলেন লোন সাহেব। উনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আজো খাজা জাফর নায়েকের সাথে সম্পর্ক অটুট থেকে গেছে।

নায়েক সাহেবের সাথে বেশির ভাগ সময় ফোনে যোগাযোগ হয়ে থাকে। শ্রীনগর থেকে চলে যাওয়া সত্ত্বেও তিনি পৈতৃক এলাকায় একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি যা কিছুই আয় করেন, তার অর্ধেকেরও বেশি ষাটজন এতিম শিশুর লালনপালন ও শিক্ষার পেছনে ব্যয় করে দেন। খাজা সাহেবের বেশ গর্ব। তার দাবি, মহিশুরের শাসক হায়দার আলী ও টিপু সুলতানও ‘কাশ্মিরি নায়েক’ ছিলেন। তাদের পূর্বপুরুষ সম্রাট আকবরের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কাশ্মির ছেড়ে চলে যান। যখনই জানতে চাই, টিপু সুলতানের কাশ্মিরি হওয়ার কী প্রমাণ আছে? তখন তিনি বলেন, মাওলানা মাহমুদ বেঙ্গালুরি মহিশুরের ইতিহাসে টিপু সুলতানের বংশ ‘নায়েক’ বলে উল্লেখ করেছেন।

এরপর একদিন ফোনে জানালেন, মুহাম্মাদ আদদিন ফওকও ‘তারিখে আকওয়ামে কাশ্মির’ (কাশ্মিরি জাতির ইতিহাস) গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে টিপু সুলতানকে ‘কাশ্মিরি নায়েক’ বলে উল্লেখ করেছেন। চলতি বছর ১১ মার্চ দৈনিক জংয়ে আমার ‘সম্মান, নাকি অপমান চাই?’ কলাম প্রকাশিত হলে খুব ভোরে নায়েক সাহেবের ফোন আসে। বললেন, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি ইসরাইলকে মেনে নেয়ার পক্ষের লোকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যদি ইসরাইলের ব্যাপারে আমাদের নীতি বদলে দিই, তাহলে কাশ্মির সঙ্কটের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে।’ ২৯ এপ্রিল, ২০১৯ ‘প্রধানমন্ত্রীর মাতম’ শিরোনামে আমার কলাম প্রকাশ করা হয়। সেখানে আজাদ কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক হায়দারের পক্ষ থেকে লাহোরের সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অশ্র“ ঝরানোর কথা ছিল। ওই দিন নায়েক সাহেব ফোনে জানান, তিনি দুবাই থেকে দোহা স্থানান্তরিত হচ্ছেন। তিনি বারবার অনুরোধ করছিলেন, ‘কাশ্মির সঙ্কটকে উপেক্ষা করবেন না। এ নিয়ে কথা বলে যাবেন; লিখে যাবেন। কেননা পাকিস্তান সরকার ও বিরোধী দল কাশ্মিরিদের শত্র“কে বন্ধু বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমে গেছে।’ তিনি বারবার কাশ্মিরে কোনো ‘বড় ধরনের বিপদে’র আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

জুনের প্রথম সপ্তাহে মক্কায় ওআইসির কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে আমার পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ হলো। ওই কনফারেন্সের সমাপনীতে যে ‘মক্কা ঘোষণা’ জারি করা হয়, তাতে কাশ্মিরের কোনো উল্লেখ ছিল না। ৩ জুনের কলামে (২৪ জুন মক্কায় পরাজয় শিরোনামে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত) লিখেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বক্তৃতায় কাশ্মিরের উল্লেখ ছিল, কিন্তু মক্কা ঘোষণায় ছিল না। পাকিস্তান মক্কায় কাশ্মিরের মামলায় হেরে গেছে। আমার ওই কলামে কিছু সরকারি ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাকে ‘ভুল’ প্রমাণ করার জন্য ওআইসির ওয়েব সাইটে বিদ্যমান এক দীর্ঘ ঘোষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, এতে কাশ্মিরের উল্লেখ বিদ্যমান। অথচ গত ২৭ রমজানে যে ঘোষণা সাংবাদিকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে কাশ্মিরের কোনো উল্লেখ ছিল না। সরকার নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য নিজেদের পক্ষে সম্পাদকীয় লিখিয়েছে। আর যখন কিছু সরকারি ব্যক্তিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, তারা কাশ্মির বিষয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় গালিগালাজের মাধ্যমে আমাকে চুপ করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এটা এমন একটা বিষয়, যাকে কেন্দ্র করে কিছু সরকারি লোকের সাথে আমার সম্পর্কের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

ধীরে ধীরে তারা জেদ ও একগুঁয়েমির মাধ্যমে পিছিয়ে না আসার অবস্থানে পৌঁছে যায়। কিছু বাস্তবতা এমন, যা পরিবর্তন করা কারো সাধ্যে নেই। ২৫ জুলাই এর কলামে (ট্রাম্পের চেয়েও বড় নেতা শিরোনামে নয়া দিগন্তে ২৯ আগস্ট প্রকাশিত) ইমরান খানের আমেরিকা সফর নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলাম, মোদি কাশ্মির সঙ্কটের সেই সমাধানই চাচ্ছেন, যেমনটা ট্রাম্প আফগানিস্তানে চাচ্ছেন। মোদি চাচ্ছেন, পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবের আলোকে কাশ্মির সঙ্কটের সমাধানের ওপর জোর দেয়া ত্যাগ করুক এবং কূটনৈতিক আত্মসমর্পণকে নিজের সফলতা অভিহিত করে আনন্দে গান গাওয়া শুরু করুক। এটা সেই ফর্মুলা যে বিষয়ে জেনারেল মোশাররফ ও মনমোহন সিং একমত হয়েছিলেন এবং হুররিয়াত কনফারেন্সের প্রবীণ নেতা সায়্যিদ আলি শাহ গিলানি যাকে কাশ্মিরিদের সাথে ‘গাদ্দারি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মনে রাখবেন, ভারত যখনই পাকিস্তানের সাথে আলোচনা শুরু করবে, তখন বেশ শক্ত অবস্থান অবলম্বন করার পর এ বাঁকা কথা বলবে যে, অধিকৃত জম্মু-কাশ্মির তার কাছেই থাকুক আর পাকিস্তান আজাদ কাশ্মির নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুক।

২৫ জুলাই এ কলাম প্রকাশিত হলে খাজা জাফর নায়েক আবার ফোন করেন। তিনি বললেন, ‘এখন তো অন্ধ ব্যক্তিও দেখতে পাচ্ছে, মোদি কাশ্মিরে কোনো একটা অভিযান চালাবেন। যখন হই চই হবে, তখন পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় বসার জন্য প্রস্তুতির কথা প্রকাশ করে সারা বিশ্বকে সমালোচনার জবাব দেবেন এবং পরিশেষে ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’কে স্বতন্ত্র সীমানা হিসেবে অভিহিত করে মোশাররফ ও মনমোহন সিংয়ের ফর্মুলাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’

খাজা সাহেবকে আশ্বস্ত করলাম, এমনটি কখনো হবে না। ৫ আগস্ট, ২০১৯ (কাবুল কাশ্মির ও করাচি শিরোনামে নয়া দিগন্তে ২২ আগস্ট প্রকাশিত) আমার কলামে আমি লিখেছি, ভারতের নিপীড়ক শাসক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে সেটিই করতে যাচ্ছে, যা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে করা হয়েছিল। ভারত সরকার কাশ্মিরিদের প্রদত্ত সাংবিধানিক গ্যারান্টি বিলুপ্ত করে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যকে ভাগ করার পরিকল্পনা করছে, যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় ভারত সরকার ৩৭০ এবং ৩৫-এ ধারা বিলুপ্ত করলে খাজা সাহেব ফোনে বললেন, আপনি কয়েক মাস ধরে লিখে যাচ্ছেন, কাশ্মিরে ‘কিছু একটা’ হতে যাচ্ছে। অথচ আপনার সরকার ঘুমিয়ে আছে। একেই বলে, ‘মহিষের সামনে বীণা বাজানো।’ এটা বলে তিনি ফোন বন্ধ করে দিলেন।
ঈদুল আজহার দিন দুপুরবেলা খাজা জাফর নায়েককে কয়েক বার ফোন দিলাম। কিন্তু তার ফোন বন্ধ পেলাম। সন্ধ্যার সময় তার ফোন এলো। বললেন, ‘হায় আজ যদি টিপু সুলতান বেঁচে থাকতেন, আমরা তার নেতৃত্বে লড়াই করতে করতে জীবন দিয়ে দিতাম।’

আমি বললাম, এটা আবেগপূর্ণ কথাবার্তার সময় নয়। আমাদের কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। খাজা সাহেব ফেটে পড়লেন। বললেন, নিন্দাজ্ঞাপন আর বিবৃতি-ভাষণ ছাড়া আর কী করেছেন আপনারা? কূটনৈতিক সম্পর্ক তো আগেও সীমিত করা হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আগেও পত্র লেখা হয়েছিল। ‘সমঝোতা এক্সপ্রেস’ও কয়েকবার বন্ধ হয়েছে। এসব পদক্ষেপ দ্বারা কি আমার এতিম শিশুদের সাহায্য করতে পারব, যারা শ্রীনগরের এতিমখানায় কয়েকদিন ধরে বন্দীদের মতো আটকে আছে এবং তাদের খাদ্য শেষ হয়ে গেছে? আমি অপারগতা প্রকাশ করার ভঙ্গিতে বললাম, আপনিই বলুন, পাকিস্তান সরকার কী করবে? তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘যদি কিছু করতে না পারে, তাহলে অন্তত ঈদের দিনে বিরোধীদলের নারীদের জেলে নিক্ষেপ করে নিজেদের তামাশা প্রকাশ করত না, মিকা সিংকে করাচিতে এনে ড্যান্স করাত না। ভারতের জন্য আকাশসীমাই বন্ধ করে দিত।’ এরপর তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন। বললেন, ‘আপনার সরকারের প্রতি আমাদের আশা-ভরসা নেই। আশা-ভরসা রয়েছে শুধু সেনাবাহিনী ও জনগণের প্রতি। পাকিস্তানি জনগণ নিয়ন্ত্রণ রেখার দিকে লং মার্চ করুক এবং লোহার বেড়াকে উপড়ে ফেলুক। আমরাও অধিকৃত এলাকার দিকে মার্চ করব।’ এরপর তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। আর ফোনে শুধু ফোঁপানো কান্না শুনতে থাকি।

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৫ আগস্ট সংখ্যা থেকে ভাষান্তর- ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement