১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নৈতিক মান উন্নয়ন প্রসঙ্গে

-

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। বিবেক হচ্ছে এ শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড, যা শুধু মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। মানবতাবোধ, চেতনাবোধ, উদারতা, ধর্মীয় জ্ঞান ও পারিবারিক সুশিক্ষা নৈতিক মান উন্নয়নে সহায়তা করে। কিন্তু যখন এ বিষয়গুলোর ঘাটতি দৃশ্যমান হয় তখন অনিবার্যভাবে নৈতিক অধপতন বা অবক্ষয় পরিদৃষ্ট হয়, যা একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। এ ব্যাধি রোধকল্পে সমাজ ও রাষ্ট্র সক্রিয় না হলে গোটা জাতির মধ্যে তা ক্যান্সারের মতো পচন ধরিয়ে দেয়।

আমাদের তরুণ ও যুবসমাজ দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ। তারাই দেশ ও জাতির কাণ্ডারি। সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারলে তারাই আদর্শের ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা যদি এই উপযুক্ত সময়ে বিপথগামী হয় তাহলে দেশ অনিবার্যভাবে ধ্বংসের দিকে পা বাড়াবে। সুতরাং তাদের গড়ে তোলাতেই রয়েছে জাতির কল্যাণ। সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এ বিষয়টিতে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণে একটি অসভ্য, বর্বর ও উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে বিশ্বের বুকে একটি শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন।

‘সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। অতএব, মানুষের মধ্যে তারাই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়, যারা তার বান্দাদের কল্যাণ করে। কিন্তু মানুষ যদি ভুল রীতিনীতি, নানাবিধ অপসংস্কৃতি, স্বার্থপর অভিপ্রায় ও ভুল শিক্ষার জালে অভ্যস্ত হয় তাহলে সমাজ নৈরাজ্য, অনৈতিকতা, অরাজকতা, জালিয়াতি, উচ্ছৃঙ্খলতা, মিথ্যাচার ও যাবতীয় অবৈধ কার্যকলাপে নিমজ্জিত হবে এটাই স্বাভাবিক।

যুবসমাজই দেশের মেরুদণ্ড। তারাই যদি দুর্নীতি ও আদর্শহীনতার মধ্যে বেড়ে ওঠে তাহলে তাদের জীবনে অবশ্যই নৈতিক অধঃপতন আসবে। আমাদের যুবসমাজ আজ নৈতিক অধঃপতনের অতলতলে নিমজ্জিত। তাদের সামনে কোনো আদর্শ মানদণ্ড নেই। বেকারত্ব, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক দৈন্য, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, টেন্ডারবাজি, রাজনৈতিক কুপ্রভাব, অপসংস্কৃতি ইত্যাদি যুবসমাজকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছে। সর্বোপরি, সমাজে আজ যে মূল্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তা যুবসমাজকে প্রথমে আক্রান্ত করছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তারা দেখছে আদর্শ ও সেবার নামে প্রতারণা, রাজনীতির নামে মিথ্যাচার ও পেশিশক্তির ব্যবহার, গণতন্ত্রের নামে ভোট ডাকাতি। আজ তারা দিশাহারা, আদর্শভ্রষ্ট, সত্যভ্রষ্ট এবং ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যারা দেশ ও জাতির গৌরব, তাদেরই মাথায় ধরেছে পচন। আর এ জন্যই ধর্ষণ ও হত্যার মতো নৃশংস অপকর্ম থামানো যাচ্ছে না।

নৈতিক অবক্ষয়ের পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর তা জাতি ইতোমধ্যেই উপলব্ধি করতে পারছে। দেশে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ শিক্ষাঙ্গনে মহামারী দেখা দিয়েছে। মাথার পচন যেমন স্বল্প সময়ে দেহকে ধ্বংস করে, তেমনি আমাদের সার্বিক অবস্থা।

বহিঃশত্রু প্রিয় মাতৃভূমিকে হামলা তথা আক্রমণ করলে যেকোনো মূল্যে তা প্রতিহত করার জন্য যেমন ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, লক্ষ্য একটাই বহিঃশত্রুকে পরাস্ত ও উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া তেমনি বহিঃশত্রুর মতো নৈতিক অধঃপতন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার অভিপ্রায়ে আক্রমণ করে বসেছে। এ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ঘরে-বাইরে আদর্শের বিপ্লব সৃষ্টি করতে হবে। এ উপমহাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- বিপ্লব তথা আন্দোলনই ছিল একমাত্র অস্ত্র আর এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দেশবাসীর কল্যাণের লক্ষ্যে সদিচ্ছা। নৈতিক অবক্ষয় নামক আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমাদের এখন প্রয়োজন, এ সদিচ্ছাকে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল।

মহানবী সা: বলেন, ‘ওয়া ইন্নামা বুয়িস্তু মোয়াল্লেমা’ অর্থাৎ ‘আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ তিনি নিজ জাতি ও সমাজের প্রতিটি সঙ্কটময় মুহূর্তে নিজ নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও মানবীয় গুণাবলি দিয়ে সমাজকে প্রভাবিত ও আকৃষ্ট করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত গোত্র, পর্যুদস্ত গোষ্ঠী ও অনাথ পিতৃহীনের পুনর্বাসন-সংস্কার ইত্যাদি সর্বপ্রথম তিনি শিখিয়েছেন। ‘হিলফুল-ফুজুল’ তার সামাজিক কর্মকাণ্ডের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা ও জনপ্রিয়তার লাইম লাইটে উঠে আসা একজন উদীয়মান জননেতা ও যুবব্যক্তিত্বের সুচিন্তিত কর্মকৌশলের প্রমাণ।

যে সময় তিনি এসেছিলেন তখন অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ধর্মহীনতা, গোত্রীয় সঙ্ঘাত, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হত্যা, মদ, জুয়া, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের প্রচলন, পৌত্তলিকতা, জড়তা, কন্যা সন্তানের জীবন্ত কবর, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও প্রকৃতি পূজার মতো ঘৃণ্য ও পাশবিক কার্যাবলিতে পরিপূর্ণ ছিল আরব্য সমাজ। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন : "The term 'Jahiliyah' usually rendered time of ignorance or barbarism, in reality means the period in which Arabia had no dispensation, no inspired, Prophet, no revealed book" এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে আবির্ভূত হয়ে তিনি আল্লাহর সাহায্যে ও নিজের অপরিসীম ত্যাগ ও অধ্যবসায়ের সমন্বয়ে সমগ্র আরববাসীকে এমন এক নতুন পথ ও মতের অনুসারী করেন যার ভিত্তিতে শতধাবিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করেন। সব প্রকার অনাচার, কদাচার, মদ, জুয়া, ধর্ষণ, লণ্ঠনসহ অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ সমাজ থেকে বিদূরিত হয়। সমগ্র আরব্য সমাজ উৎসবের পরিবর্তে নৈতিকতার পথে এবং ধ্বংসের পরিবর্তে কল্যাণ ও মুক্তির পথে ধাবিত হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক চিত্র বা অবস্থা কি জাহেলি যুগের চেয়েও অধিকতর খারাপ? যদি হয়ে থাকে তাহলে মহানবী সা:-এর পদাঙ্ক, পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল অনুসরণই শ্রেয়। আর যদি অত বেশি গুরুতর না হয়ে থাকে তাহলে নৈতিকতার বিপ্লব সাধন সহজ সাধ্য নয় কি? তিনি জাবাল-উল-আরাফাতের শীর্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করে যে ঐতিহাসিক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন, তাতেই রয়েছে মানবজাতির সামগ্রিক মুক্তি ও কল্যাণ। তার সব কাজ, পদক্ষেপ এবং মুখনি:সৃত বাণী ভাণ্ডারকে বাস্তবায়ন করলে সমাজ থেকে চিরতরে নির্মূল হবে দুর্নীতি ও দুঃশাসন, খুন, গুম, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অপসংস্কৃতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক দৈন্য, অপহরণ, প্রতারণা, স্বেচ্ছাচারসহ সব ধরনের অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ।

আজকের এ নৈতিক অবক্ষয় পরিবেশে যেখানে প্রাধান্য লাভ করেছে নৈতিকতাবিবর্জিত জীবন, মানবতা ও মূল্যবোধের অধঃপতন, সেখানে তাঁর প্রবর্তিত জীবনাদর্শ এনে দিতে পারে কাক্সিক্ষত নৈতিক বিপ্লব তথা চিরশান্তি।


আরো সংবাদ



premium cement