২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্নীতির ‘পারমাণবিকীকরণ’

-

হালফিল বাংলাদেশে দুর্নীতি আর দূরের নীতি নয়। বেশ জেঁকে বসেছে। কিছু দিন ধরে দেশে বালিশ নিয়ে কত কাণ্ডই না ঘটাল। নালিশ গিয়ে গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ‘মহামূল্যবান’ বালিশ নিয়ে কথা!

বালিশকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে ধুন্ধুমার কমেন্টস, তর্ক-বিতর্ক, নিন্দা সমালোচনার ঝড়। রীতিমতো সুনামি হয়ে গেছে। বালিশ নিয়ে যে অভিনব, নজিরবিহীন ও চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি হয়েছে, সেই লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে এ সংক্রান্ত দুইখান তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে গৃহায়ন অধিদফতরের কমিটি ৬২ কোটি টাকা এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদনে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার টাকা লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ যে দুর্নীতি, তার অভিযোগে নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ সুপারিশের পাশাপাশি ওই পরিমাণ অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। ১৬ জুলাই ২০১৯ অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে এ দুটি প্রতিবেদন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেয়া হয়েছে। ২১ জুলাই ছিল রিটের শুনানির দিন।

এ ঘটনার একটু পেছন ফিরে দেখি আমরা। ঈশ্বরদীর রূপপুরে আবাসিক ভবনের জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে- গত মে মাসে এমন প্রতিবেদন বের হয়েছিল খবরের কাগজে। তারপর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কী ছিল সংবাদপত্রের সেই প্রতিবেদনে, যা নিয়ে এতই হুলস্থুল কাণ্ডকীর্তি? ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল : ‘প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া নয়টি ভবনের ৯৬৬টি ফ্ল্যাটের জন্য আসবাব কেনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে একটি ২০ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কেনা ও তা ভবনে উঠাতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। ২০তলা ওই ভবনটির প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য প্রতিটি বালিশ কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা করে। ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা করে কেনা প্রতিটি রেফরিজারেটর উপরে উঠাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ টাকা। একেকটি ওয়াশিং মেশিন কেনা হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা দরে। ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার ৪১৯ টাকা করে।...”। বিশদ পরিসংখ্যানে পাঠকের মাথা গুলিয়ে যেতে পারে।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,‘অভিযুক্ত কর্মকর্তারা মালপত্র কেনায় দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণপূর্ত শিডিউলে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণের কথা বললেও বাস্তবে দেখা যায়, তারা কিছু ফ্যাক্টরস যেমন শ্রম, পরিবহন, সানড্রি এবং উঠানো বাবদ অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক মূল্য ধরেছেন বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আসবাব পরিবহন এবং বিভিন্ন তলায় উঠানো এবং সেটিং গণপূর্ত পাবনা বিভাগ প্রণীত প্রাক্কলিত মূল্যের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আলোচ্য ৯টি ভবনের আসবাব ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য পাবনা গণপূর্ত বিভাগ প্রণীত এবং রাজশাহীর অতিরিক্তি প্রধান প্রকৌশলী কর্তৃক অনুমোদিত মূল্য ২৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। অপর দিকে, কমিটি প্রণীত ওই কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ১৬৯ কোটি ২৭ লাখ ৯ হাজার টাকা। যা অনুমোদিত প্রাক্কলিত মূল্য ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা কম।’

গৃহায়ন অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘প্রকল্পের যে ব্যয় দেখানো হয়েছে তা বাজারমূল্যের চেয়ে ৬২ কোটি টাকা বেশি। ইতোমধ্যে ৩৬ কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট খাতে পরিশোধ করা হয়েছে। যে টাকা বাজারমূল্য থেকে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে, প্রকল্পের পরবর্তী প্যাকেজের সঙ্গে সমন্বয় করে কেটে রাখতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও অধিদফতরের প্রতিবেদনে দুর্নীতির জন্য ৩৪ জনকে দায়ী করা হয়। বড় ছোট রুই-কাতলা এ ঘটনায় যুক্ত। তারা অবশ্য এখনো মুক্ত। অভিযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান। তবে শেষতক কতখানি সফল হবে সেই প্রক্রিয়া আল্লাহ মালুম!

দুর্নীতি এখন আর ব্যক্তি খাতে নয়, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উন্নীত (!) হয়েছে। এই যে নির্লজ্জ জোচ্চুরি, একে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ যদি বলি, ভুল হয় কি? সরকারি পর্যায়ে এই যদি হয় আস্থা, দায়িত্বশীলতা ও বিশ্বস্ততার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাহলে কেমন সোনার বাংলা আমরা পেতে চলেছি, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলার মাটিতে এই দুর্নীতিবাজদের বিচার কতটুকু শেষ পর্যন্ত হবে, আদৌ হবে কিনা, তা নিয়ে নিঃসংশয় হতে পারছি না আমরা। কথায় বলে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। গত বছরের (২০১৮) তুলনায় এবার চার ধাপ অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। টিআই-এর এবারের সূচক অনুযায়ী বিশ্বের সবচাইতে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে সোমালিয়া। আর সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ হলো ডেনমার্ক। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের সমান অবস্থানে রয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং উগান্ডা। দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৭ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭ নম্বরে। সেখানে ২০১৮ সালে চার ধাপ পিছিয়ে গিয়ে এখন ঠাঁই হয়েছে ১৩ নম্বরে।

টিআই বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিআইয়ে-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুর্নীতির কারণগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এসব কারণ হচ্ছে : দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারের সাথে বাস্তবায়নের অমিল, হাই প্রোফাইল লোকজনের দুর্নীতি চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় না আনা, সরকার ও রাজনৈতিক দল এক হয়ে যাওয়া, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি, ভূমি-নদী-খাল-বিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা, অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া, দুর্বল জবাবদিহি, দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব, অস্বীকারের সংস্কৃতি, দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করা ইত্যাদি।

শুধু বালিশকাণ্ড নয়, আমাদের চার দিকে দুর্নীতির খবর। জাতির কাঁধে চেপে বসেছে সিন্দাবাদের দৈত্য হয়ে। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে যে কেলেঙ্কারি হয়েছে, তাতে নাম আসছে সাবেক একাধিক এমডিসহ কোল মাইনিং কোম্পানির দুই ডজন কর্মকর্তার। দুদক এখন মাঠে নেমেছে। পেট্রোবাংলা তদন্তে কয়লা দুর্নীতির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল সিস্টেম লসের কারণে কয়লার ঘাটতি হয়েছিল। দুদকের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, দুর্নীতির কারণেই ঘটেছিল ওই ঘটনা। এক লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েবের ঘটনা জনসমক্ষে চলে আসে। দুদক নিয়েও প্রশ্নের কাঁটা খচখচ করে জনমানসে। বেড়ায় যখন ক্ষেত খায়, জনগণ তখন অসহায় বোধ করে। ক্রেস্টে সোনা জালিয়াতি, মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদÑকত ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় কবর থেকে কঙ্কাল চুরির মতো লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে। গাজীপুরে কঙ্কাল চুরি ঠেকানোর জন্য শুরু হয়েছে কবর পাহারা দেয়ার কাজ। আমাদের মরেও কী তাহলে শান্তি নেই?


আরো সংবাদ



premium cement
চুয়াডাঙ্গায় হিট‌স্ট্রো‌কে যুবকের মৃত্যুর ৭ ঘণ্টা পর নারীর মৃত্যু ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াল, যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৬ শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু বাকৃবির এক্স রোটারেক্টরর্স ফোরামের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠিত পাবনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু ১

সকল