১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হুজুগে বাঙ্গাল, হিকমতে চীন

-

শৈশব-কৈশোর শিরোনামের প্রবাদ বাক্যটি ছাড়াও শোনা যেত, ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখি, মাত্র চল্লিশ হাজার’। প্রাপ্ত বয়সে বাস্তব জীবনে পা দিয়ে তবেই বুঝতে পারা গেল বাক্য দু’টির মর্মার্থ। উপরন্তু এও বুঝতে তখন বাকি থাকেনি যে, আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমূলক দু’টি দুর্নামের মধ্যে একটি হলো অকারণে সচরাচর এবং স্বার্থসিদ্ধির বা কখনো নিজেকে কেউকেটা বোঝানো ছাড়া মাত্রারিতিক্ত মিথ্যা বলা। অপরটি হলো, তোষামোদপ্রিয়তার পাশাপাশি অত্যধিক আবেগ ও তৎক্ষণাত বিশ্বাসপ্রবণতার জন্মগত ব্যাধি।

অতিরঞ্জন ও প্রশংসায় কাউকে আকাশচুম্বী করতে অভিধানের কোনো বিশেষণই যেমন ভুলেও বাদ দিতে চাই না, তেমনি কাউকে পাতালপুরী করতে বিশেষণের বিশেষণ ধার করেও প্রয়োগ করার চেষ্টায় পারতপক্ষে ব্যর্থ হতে চাই না। এ রোগ প্রাচীন যুগ থেকে গোটা উপমহাদেশীদের সংক্রমিত করে রেখেছে। পক্ষান্তরে, ইউরোপীয় ও আমেরিকানেরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মূলত খ্রিষ্টীয় বাইবেলের উক্তিকে প্রবাদবাক্যের মতো সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োগের চেষ্টা করে থাকেন : 'Render unto caesar the things which are caesar's' অর্থাৎ যার যা প্রাপ্য তাকে তা দেয়া। অতিরঞ্জন, কল্পনা ও ভাবাবেগের বালাই না থাকায় তাদের কথা ও লেখা যতটা বিশ্বাসযোগ্য বলে অন্য সবার কাছে বিবেচ্য হয়, ততটা এমনকি গোটা উপমহাদেশীয় বেশির ভাগের ক্ষেত্রেও আমাদের হয় না। কারণ, তাদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে পক্ষপাতদুষ্ট মতামতের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারক বলে মনে হওয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে যুদ্ধকালীন অবস্থায় হিটলারি যুগে গোয়েবলসের অপপ্রচারের রীতি আধুনিক শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের কারণে অকার্যকর। তবে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের প্রয়াস ছাড়াও ব্যক্তিস্বার্থে মিথ্যা ও অপপ্রচার অন্তত আমাদের সমাজে যেন এক স্বাভাবিক প্রথা।

প্রায় দুই-আড়াই শ’ বছর আগে আমাদের এ স্বভাবের কথা বলেছেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮) এবং ১৮৭৬ সালে লন্ডনে প্রথম প্রকাশিত ‘বাখরগঞ্জের ইতিহাস’ নামক বইয়ে লেখক এইচ বেভারেজ। এ ছাড়াও তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের সভাপতি ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার (১৮৪০-১৯০০) ১৮৭১ সালে প্রকাশিত তার ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে আমাদের এ স্বভাবের উল্লেখ করেছেন ভিন্ন উপমার মাধ্যমে। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমি দেখেছি একজন তার মায়ের মৃত্যুর মিথ্যা কথা বলে পথচারীর কাছে কাফনের কাপড় কেনার টাকা চাইতে। সত্তর দশকের শেষ দিকে নিজ গ্রামের যুগী সম্প্রদায়ের বোনা নতুন কাপড়ে রঙ পাকা হওয়ার বিশ্বাসে তাদের গুজব রটানোর সত্যতাও জেনেছি।

কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশে ছোট শিশুর স্বপ্নে সর্বরোগের মহৌষধ পাওয়ার অপপ্রচারে ঘটেছে হাজার হাজার ঔষধ-প্রত্যাশীর সমাগম। সেতুতে শিশু মুণ্ডের প্রয়োজনীয়তার গুজব নতুন কিছু নয়। মানতস্বরূপ বাংলায় শিশু বলি এই সেদিনের কথা। বর্তমানেও এর কথা মাঝে মধ্যেই জানা যায় ভারতীয় টিভি চ্যানেল সোনি ৮-এর ক্রাইম প্যাট্রোল অনুষ্ঠানে। ঐশ্বরিক ক্ষমতাধারী বলে সেখানে বিবেচিত ‘সাধু বাবা’র এমন প্রস্তাবে অন্ধবিশ্বাসী ভক্ত-স্বজনদের সম্প্রতি আধুনিক ভারতে এক অবিশ্বাস্য সত্য বৈকি!

মানুষ পিটিয়ে হত্যার ভারতীয় ব্যাধিতে আমরাও সংক্রমিত। সেখানে কখনো কখনো মারা হয়েছে আমাদের সীমান্তে এবং সম্প্রতি গরুর গোশতের কারণে। আর আমাদের এখানে কখনো বা ডাকাত ও ছেলেধরা সন্দেহে। তবে হত্যার ধরনটি অভিন্ন হলেও মানসিকতায় রয়েছে হিমালয়তুল্য পার্থক্য। অর্থাৎ আমাদেরগুলো অসাম্প্রদায়িক আর ভারতেরগুলো সাম্প্রদায়িক। এর একটা অতীত উদাহরণ হলো, ১৯৭১ সালের ৮ জুন ওয়াশিংটন স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ। এতে বলা হয়েছে, ‘কলেরা রোগের দ্রুত মহামারী লাগানোর চেষ্টায় এর জীবাণু ভর্তি একটি বোতল ভারতের কৃষ্ণনগর রেলস্টেশনে স্থানীয় পানি সরবরাহে ঢালার কথিত অভিযোগে প্রায় ৫০০ লোক এক মুসলমানকে পাকিস্তানি চর বলে পিটিয়ে হত্যা করে।’ এ সংবাদটি তখন আলোচিত হয় আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদে (ভারত সরকারের Bangladesh Documents, VOL-1, page-550)|

ব্রিটিশ রাজনীতিজ্ঞ ও বক্তা এডমন্ড বার্কের (১৭২৯-১৭৯৭) 'Superistition is the religion of feeble minds.' (ভ্রান্ত বিশ্বাসই দুর্বলচিত্ত ব্যক্তির ধর্ম) কথাটি যেন আমাদের ক্ষেত্রে বহুলাংশে সত্য। প্রায় দেড় শ’ বছর আগের বইয়ের তথ্যে বলা হয়েছে যে, ‘হিন্দুধর্মের বিস্তারের সাথে সাথে নদনদী পুরাতন নাম ত্যাগ করিয়া নতুন নাম ধারণ করিতেছিল। বগবতীর (দেবী) কর্ণফুল পতিত হওয়ায়, কর্ণফুলী, ভগবতীর ফেনী (অলঙ্কারবিশেষ) পতিত হওয়ায় ফেনী, শঙ্খ পতিত হওয়ায় শঙ্খ এবং নাসিকা পতিত হওয়ায় সুগন্ধা নদীর নাম হয়েছে বলে ছিল সকলের ভ্রান্ত বিশ্বাস।’ হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের বহু কল্পনা আর বিশ্বাসের একটা ঐতিহাসিক প্রভাব রয়েছে আমাদের সমাজে। ফলে কিছু শুনলে তার সত্যতা যাচাই না করে বিশ্বাস না করা বা অন্যকে না বলার ইসলামী বিধান থাকা সত্ত্বেও গাঁজাখুরি অর্থাৎ অলীক, গুজব অর্থাৎ রটনা এবং অপপ্রচার বলতে অসত্য প্রচারের প্রবৃত্তিতে আমরা যেন আজও সেই ‘হুজুগে বাঙালি’ রয়ে গেলাম।


আরো সংবাদ



premium cement