২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চামড়া শিল্পের দায় কে নেবে?

-

দেশের ইতিহাসে গত ৩১ বছরের মধ্যে এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ছিল অনেক কম। দেশের দ্বিতীয় প্রধান রফতানি খাত চামড়া শিল্প। পোশাক শিল্পের পর এ খাত থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। এই শিল্পের কাঁচামালের দামে যদি ভয়াবহ রকম ধস নামে, তাহলে এর প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর পড়বে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। চামড়ার ব্যবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এবারের চামড়ার দাম স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। দাম না পেয়ে অনেকেই কোরবানির পশুর চামড়া ফেলে দিয়েছেন।

অনেকেই কোরবানির পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। এমন ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরা, খুলনা, নীলফামারী, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। চামড়া কেনার লোক না পাওয়ায় সারা দিন অপেক্ষার পর বাধ্য হয়ে কোরবানির পশুর চামড়া মাটির নিচে পুঁতে ফেলেন। খুচরা চামড়া ব্যবসায়ী ও মওসুমি কাঁচা চামড়ার সংগ্রহকারীরা ন্যূনতম দর দিয়েও ট্যানারি মালিক এবং পাইকারদের কাছে চামড়া সংগ্রহকারীরা চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাগে-দুঃখে ও হতাশায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কের ওপর চামড়া ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে যান। এ অবস্থা অনেকেই বলছেন সিন্ডিকেট, কেউ বলছে অন্তরালের খেলা।

এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল এক কোটি ১০ লাখের মতো। এর জন্য ৪২ লাখ গরু প্রস্তুত ছিল। বাকিটা ছাগল, মহিষ কোরবানি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়ার বাজার ধস নামার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্য দিকে, কম দামে চামড়া কিনতে পারায় এবং কাঁচা চামড়া বিদেশে রফতানির অনুমতি মেলায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নেবে আড়তদার, ব্যবসায়ী, ট্যানারি মালিকেরা।

তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাভ যাবে আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। চামড়া রফতানি হলে ট্যানারি মালিকেরা আর কম দামে এদের কাছ থেকে চামড়া কিনতে পারবেন না। জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনা চামড়া এ বছর ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা দামের খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৫০ টাকায়। আর এ বছর এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায় কেনা কোরবানির চামড়া এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পেরেছেন এমন কোনো সংবাদ শোনা যায়নি। আর যত টাকা দিয়ে খাসি কিনুক না কেন, স্বল্প মূল্যে তা বিক্রি করতে হয়েছে। সারা বছরই জবাই করা গবাদিপশু থেকে চামড়া আসে। তবে মুসলিমপ্রধান এই দেশে ঈদুল আজহার সময় প্রায় ৪০ শতাংশ চামড়া আসে।

এবার গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সারা দেশে খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা। বিগত বছরগুলোতে নামাজের পরপরই রাজধানীসহ বড় বড় শহরে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অসংখ্য খুচরা ও মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর ভিড় দেখা গেলেও এবার তাদের দেখা মেলেনি।

কাঁচা চামড়ার খুচরা ও মওসুমি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ট্যানারির মালিক ও পাইকারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে সরকার নির্ধারিত দরে চামড়া কেনায় নেমে পড়ত। কিন্তু এবার খুচরা-পাইকারি ব্যবসায়ীরা অগ্রিম কোনো টাকা পায়নি। এমনকি, ট্যানারি মালিক ও পাইকারদের কাছে কোনো দর পায়নি। কাঁচা চামড়ার খুচরা ও মওসুমি ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা পেত, কিন্তু এবার পায়নি। এ কারণে তারা অল্প দামে চামড়া কিনেছেন। যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কম। অতীতে কোরবানির আগে সরকারের কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যেত; কিন্তু এবার শুধু চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া ছাড়া কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ঈদুল আজহার আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে চামড়া ক্রয়, সংগ্রহের জন্য ঋণ দেয়া হতো, কিন্তু এবার তা দেয়া হয়নি।

এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আমাদের হাতে এই মুহূর্তে চামড়া কেনার মতো টাকা নেই।’ ফলে মওসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সব চামড়া এবার কিনতেই পারব না। ঈদের পর ১৪ আগস্ট ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, কাঁচা চামড়ার রফতানির সরকারি সিদ্ধান্তে শতভাগ দেশীয় চামড়া শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। এ খাতে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে।

কাঁচামাল না পেলে এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিপুল জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে; দেখা দিতে পারে শ্রমিক অসন্তোষ। তাই কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। অন্য দিকে, বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়িক কারসাজি রয়েছে। আবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, চামড়ার দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে জানা দরকার। তবে এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। এক হলো- বড় ধরনের সমন্ব^য়ের অভাব। ট্যানারি মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের আলোকে বোঝা যায়, তারা এবার অর্থায়নের অভাব অনুভব করছেন এবং কাঁচা চামড়ার রফতানি সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের কাছে ব্যবসাবান্ধব ও শিল্পবান্ধব মনে হয়নি।

এখানে যথাযথভাবে সরকারি তদারকির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যদি ঈদুল আজহার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বৈঠক করে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তাহলে চামড়া শিল্পে এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পারত। অন্য দিকে, সরকারের দুজন মন্ত্রী সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা বলেছেন। সরকারের চৌকস গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সে আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত এবং সিন্ডিকেটের কারসাজি থাকলে তার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত। এখানে কেমন জানি সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। কেন আজ আমাদের এই চামড়া শিল্পের বিপর্যয়? এখন কে নেবে এর দায়ভার? তাই চামড়া শিল্পের রক্ষায় এর প্রকৃত কারণ বা রহস্য উদঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো, এবারের কোরবানির চামড়া খুব একটা কেনাবেচা করা সম্ভব হয়নি। বেশির ভাগ চামড়া ক্রয়-বিক্রয় না করতে পেরে নষ্ট হয়ে গেছে। ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। যদি সিন্ডিকেটের লোকজন কিছু চামড়া ক্রয় করত, তা হলে কিছু চামড়ার দাম পাওয়া যেত। এখানে যেন অদৃশ্য রহস্য থাকতে পারে। এটা একটি দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। এগুলো দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত। আল কুরআনের কোরবানির চামড়া দান করার ক্ষেত্রে যে আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : পশুর চামড়া বিক্রির টাকা গরিব, মিসকিন, অসচ্ছল, অভাবী, দুঃখী, দুস্থ ও এতিমদের দান করতে হয়।

এবার কোরবানির চামড়া নায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারেনি। এর ফলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে উল্লিখিতরা। দেশের রফতানি আয়ের বড় খাত চামড়া শিল্প। যে শিল্প থেকে রফতানি আয় আসে সেই শিল্পকে কোনো মতেই অবহেলা করা ঠিক নয়। চামড়ার জন্য সরকার সুনির্দিষ্ট শিল্প এলাকা করেছে। সেই নতুন এলাকার শিল্পগুলো স্থানান্তর করা হয়েছে, কিছু কাজ অসম্পন্ন রেখেই। শিল্পমালিকরা উৎপাদনে যেতেই কারখানার পরিপূর্ণ পরিবেশ না পান, তাহলে একটি রফতানিমুখী শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, এটা আগেই চিন্তা করা উচিত ছিল। সরকারি কাজের অংশ বর্জ্যশোধনাগার দুই বছরে নির্মাণ সম্পন্ন হলো না। এর দায় কে নেবে। এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারের নৈতিক সমর্থন দরকার। আর এই সঙ্কটের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার। রফতানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে একমাত্র পথ। এ শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান আসে কোরবানির ঈদে। চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখা শুধু নয়, বিকশিত করতে হলে এ শিল্পের সাথে সাথে জড়িতদের বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে পাট শিল্প যেমন ধবংস হয়ে গেছে, তেমনি চামড়া শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement